জগৎজ্যোতি দাস

1

মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভাটি বাংলার গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন এবং তার অবদানের জন্য পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে। জগৎজ্যোতি দাস হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে ১৯৪৯ সালে ২৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জীতেন্দ্র দাসের কনিষ্ঠ পুত্র। স্কুল জীবনেই জগৎজ্যোতি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে (মেনন গ্রুপ) যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিশেষ দায়িত্ব পালনে ভারতের গৌহাটির নওপং কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অবস্থানকালে অনেকগুলো অঞ্চলের ভাষা আয়ত্ত করেন এবং ধীরে ধীরে নকশালপন্থীদের সঙ্গে জড়িত হন। এখানে অস্ত্র গোলাবারুদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন।
জগৎজ্যোতি ১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলা ও হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়ানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেন। যোগ দেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইকো-১ ট্রেনিং ক্যাম্পে। বাংলার ভাটি অঞ্চলের সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোণা এবং হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ৫ নং সেক্টর। এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান তৎকালীন মেজর শওকত আলী। ৫ নং সেক্টরকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের দায়িত্ব প্রাপ্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অধীনে প্রথমত জগৎজ্যোতি বিভিন্ন আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় গেরিলা দল, যার নাম দেওয়া হয় ফায়ারিং স্কোয়াড ‘দাস পার্টি’। জগৎজ্যোতির শেষ যুদ্ধের অন্যতম সঙ্গী আবদুল কাইয়ুমের বয়ানে জানা যায়, দাস পার্টি নামটি জনগনের দেওয়া নাম নয়, দাস পার্টির অফিসিয়াল দলিল ছিল এবং পার্টি কমান্ডার হিসেবে জগৎজ্যোতি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। বদলপুর অপারেশন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি একটি বড় সাফল্য। জগৎজ্যোতির সঙ্গে ছিল বানিয়াচংয়ের মোহাম্মদ আলী মমিন, আমির হোসেন, খালেক মাস্টার, হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া, আজমিরীগঞ্জের রাশিদুল হাসান চৌধুরী কাজল, মতিউর রহমান, নিত্যানন্দ দাস, ইলিয়াছ চৌধুরী, আ. রশীদ, নিপেন্দ্র দাশ, ছাতকের আয়ুব আলী, আ. মজিদ ও দিরাই উপজেলার আহবাব হোসেন এবং নীলু। জগৎজ্যোতির দল আজিমিরীগঞ্জ, মারকুলি, গুঙ্গিয়ারগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। বদলপুরে শত্রুসেনারা দাস পার্টির প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। গুলি ছোড়ার জন্য হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জগৎজ্যোতির পাশে ছিল ইলিয়াস নামে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা। পাক ক্যাম্প থেকে ২০০ গজ দূরে রাজাকার/পাক সেনাদের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে দাস পার্টি। রণাঙ্গনে পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে এক পর্যায়ে জ্যোতি তার দলকে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়ে একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে নিজে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য জ্যোতি সহযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মমিনকে নির্দেশ দেন যাতে অন্যরা তাদের জীবন বাঁচিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায়। এরপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন মাত্র দুইজন, জ্যোতি ও ইলিয়াছ। হঠাৎ ইলিয়াছ পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন। জ্যোতি পিছু না হটে তার মাথার লাল পাগড়ি খুলে শক্ত করে ইলিয়াসের বুকে এবং পিঠে বেঁধে দেন, যাতে তার রক্তক্ষরণ থেমে যায়। ইলিয়াছ সেই অবস্থায় মেশিনগান নিয়ে ক্রমাগত গুলি ছুড়তে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ম্যাগজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করাতে ১টি গুলি জগৎজ্যোতির চোখে বিদ্ধ করে এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭২ সালে মরণোত্তর বীরবিক্রম উপাধি লাভ করেন।

কমিউনিস্ট কর্মী ও লেখিকা অঞ্জলি লাহিড়ী জগৎজ্যোতি দাসকে নিয়ে জগৎজ্যোতি উপন্যাসটি লেখেন যা ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সাহিত্য প্রকাশ থেকে বের হয়। লেখিকা অঞ্জলির শিলঙের বাড়িতে জগৎ জ্যোতি ও অন্যান্য মুক্তি যোদ্ধারা আশ্রয় পেয়েছেন এর আগে। তাজুল মহম্মদ তাঁর সিলেটের যুদ্ধকথা বইতে দাস পার্টির অভিযানের কথা বর্ণনা করেছেন। হবিগঞ্জের নাট্যকর্মী রুমা মোদক তাকে নিয়ে মঞ্চনাটক নির্মাণ করেন ‘জ্যোতিসংহিতা’, যা ঢাকা, সিলেটসহ ভারতে বহুবার প্রদর্শিত হয়। লেখক হাসান মোরশেদ জগৎজ্যোতি দাস এর দাস পার্টি নিয়ে লিখেছেন দাস পার্টির খোঁজে নামের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বইটি। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে দাসপার্টি। এখানে শহিদ জগৎজ্যোতি দাসের জীবনীর সঙ্গে তারই হাতে লেখা ডায়েরি থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংঘটিত বিভিন্ন অপারেশনের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এবং দাসপার্টির সকল সদস্যের যুদ্ধজীবন সংকলিত হয়েছে।