ছোট্ট শিশু মুনতাহা হত্যা আমাদের অপরাধী করে

2

মো. দিদারুল আলম

সিলেটের কানাইঘাটে নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর ছয় বছর বয়সী শিশু মুনতাহা আক্তার জরিনের ভোরে গলায় রশি প্যাঁচানো অবস্থায় বাড়ির পাশের একটি ডোবা থেকে ০৯ নভেম্বর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করে থানায় নিয়ে এসেছে পুলিশ। এ সময় পাশের ঘরের মারজিয়া নামে এক নারী একেকবার একেক রকম কথা বলতে থাকেন। মারজিয়া মুনতাহাকে পড়াতেন। দিনের একটা বড় সময় মারজিয়া তার সঙ্গেই থাকতেন। পূর্ব শত্রুতার জেরে মুনতাহার সাবেক গৃহশিক্ষিকা তাকে অপহরণ করে হত্যা করে। সুমিকে গৃহশিক্ষিকা থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় মুনতাহার পরিবারের ওপর তার ক্ষোভ তৈরি হয়। এছাড়া সুমির ওপর চুরির অপবাদ দেওয়ার ক্ষোভ থেকে এ হত্যাকাÐ ঘটতে পারে। তাকে বিভিন্নভাবে জেরা করা হলে ওই রাতেই তার মা মুনতাহার মরদেহ ডোবা থেকে পুকুরে নিয়ে ফেলার সময় স্থানীয় একজন দেখে ফেললে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় অপর একজন তাকে ধরে ফেলে। পরে পুলিশ গিয়ে ওই নারী ও তার মাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে এবং লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ওসমানী হাসপাতালে পাঠায়।
গত ৩ নভেম্বর সকালে বাবার সঙ্গে স্থানীয় একটি ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফেরে মুনতাহা। পরে প্রতিদিনের মতো আশপাশের বাড়িতে শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে যায়। কিন্তু বিকেল হলে বাড়িতে না ফিরলে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। এরপর থেকে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পায়নি পরিবার। ফুলের মতো নিষ্পাপ, মিষ্টি হাসির ছোট্র শিশু মুনতাহা। বাবার সঙ্গে বিরোধ ছিল, আর সেই বিরোধের আগুনে প্রাণ হারালো এই ছোট্ট মেয়েটি। কোনো দোষ ছাড়াই, নিষ্পাপ এক শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। একজন মানুষ কতটা হিং¯্র, কতটা পাষাণ হতে পারে, তা এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। মুনতাহাকে প্রথমে গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। তারপর নিষ্ঠুরতার সীমা অতিক্রম করে তার ছোট্ট দেহটি ডোবার কাদার মধ্যে পুঁতে রাখা হয়। যেন তার নিস্পন্দ, নীরব শরীরটা পৃথিবীর আলো থেকে দূরে, মাটির গভীরে হারিয়ে যায়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
মুনতাহার অপরাধ কী ছিল? কেন এমন নিষ্ঠুরতার শিকার হলো সে? একটি শিশু যার দুনিয়ার কোনো দোষ, কোনো অপরাধ ছিল না, কেন এমন নির্মম পরিণতি তার কপালে জুটলো? বাবার সঙ্গে পারিবারিক দ্বন্ধের খেসারত একটি শিশুর জীবন দিয়ে মেটানো হলো। কতটা হৃদয়হীন হলে, কতটা অমানবিক হলে এমন বর্বর কাজ একজন মানুষ করতে পারে? এমনই অমানবিক ঘটনা আমাদের সমাজে আরও কতবার ঘটে চলেছে, যেখানে ব্যক্তিগত বিরোধের শিকার হচ্ছে শিশু-কিশোররা। মুনতাহার মতো আরও কত শিশুই বা আছে, যারা পারিবারিক কলহের বলি হচ্ছে! আমাদের সমাজ কি পারবে এই অমানবিকতা থেকে মুক্তি পেতে? শিশুরা কি পাবে নিরাপদ জীবন, ভালোবাসায় ভরা শৈশব? ছোট্র শিশুটির এই নির্মম পরিণতি আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়।
সময়ের বিবর্তনে সমাজের নৈতিক এবং মানবীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই পাষাণ যুগে যারা সমাজের কল্যাণ চান তারাও অজানা আতঙ্কে অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখ খুলতে ভয় পান। সমাজ বিধ্বংসী কাজগুলো নীরবে সহ্য করেন। এভাবে সহ্য করতে করতে অনেক অন্যায়-অনাচার এখন স্বাভাবিক রীতি-রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে মানুষের বিবেক এবং বোধের জায়গাগুলো কেন যেন মূক ও বধিরতার রূপ লাভ করছে। অপরদিকে মানবীয় চরিত্রে মনুষ্যত্বহীনতা, অমানবিকতা, বিবেকহীনতা, পাশবিকতা, হৃদয়হীনতা, কদর্যতা এবং অসুন্দরের প্রকাশ ঘটলে তাকে মানবীয় মূল্যবোধ বলে অভিহিত করা যায় না। আমাদের চারপাশে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যে বহিঃপ্রকাশ দেখছি, এতে মানবীয় সমাজের ভিত্তিমূল নড়ে উঠছে। জীবন এবং মানবীয় মূল্যবোধের বিচারে আজকের সমাজকে কতটুকু মানবিক এবং সভ্য বলা যায় তা একটি মোটা দাগের প্রশ্ন।
সারাদেশে শিশুদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত (৪ বছর ৯ মাস) ৮ হাজার ৮৩২ জন শিশু সহিংসতার শিকার। যার বিপরীতে মামলা হয় ৪ হাজার ৬৭৫টি। সাজা পায় মাত্র ২৪ জন অপরাধী। এই সময়কালে ২ হাজার ৫৯০ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। ধর্ষণের শিকার হয় ৩ হাজার ৫৯৬ জন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৫৮০ জন। এ সময় ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ১৫-১৯ বছরের মেয়েদের বাল্যবিবাহ ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
সময়ের বিবর্তনে সমাজের নৈতিক এবং মানবীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই পাষাণ যুগে যারা সমাজের কল্যাণ চান তারাও অজানা আতঙ্কে অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখ খুলতে ভয় পান। সমাজ বিধ্বংসী কাজগুলো নীরবে সহ্য করেন। এভাবে সহ্য করতে করতে অনেক অন্যায়-অনাচার এখন স্বাভাবিক রীতি-রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে মানুষের বিবেক এবং বোধের জায়গাগুলো কেন যেন মূক ও বধিরতার রূপ লাভ করছে। অপরদিকে মানবীয় চরিত্রে মনুষ্যত্বহীনতা, অমানবিকতা, বিবেকহীনতা, পাশবিকতা, হৃদয়হীনতা, কদর্যতা এবং অসুন্দরের প্রকাশ ঘটলে তাকে মানবীয় মূল্যবোধ বলে অভিহিত করা যায় না। আমাদের চারপাশে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যে বহিঃপ্রকাশ দেখছি, এতে মানবীয় সমাজের ভিত্তিমূল নড়ে উঠছে। জীবন এবং মানবীয় মূল্যবোধের বিচারে আজকের সমাজকে কতটুকু মানবিক এবং সভ্য বলা যায় তা একটি মোটা দাগের প্রশ্ন।
আমরা চাই মুনতাহা হত্যাকাÐের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। অপরাধীদের এমন শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে আর কেউ এ ধরনের হত্যাকাÐ আর ঘটাতে না পারে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক