ছেলের দাম বেশি, মেয়ের কম

1

পূর্বদেশ ডেস্ক

নিঃসন্তান দম্পতির সন্তানের আকাক্সক্ষা পূরণে গড়ে ওঠা শিশু চোর চক্রের কাছে ছেলে শিশুর দাম লাখ টাকার বেশি। এর চেয়ে কিছুটা কম দামে বিক্রি হয় মেয়ে শিশু। এই চক্রে হাসপাতাল-ক্লিনিকের আয়া, রোগী ভাগিয়ে নেওয়া দালাল, কতিপয় চিকিৎসক ও আইনজীবী, গৃহকর্মী, একাধিক সন্তানের জনক, সৎ মা-বাবা, মাদকসেবী, মানব পাচারকারীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। শিশু চুরির যেসব ঘটনা জানাজানি হয়, মামলা হয় বা গণমাধ্যমে আসে, তার চেয়েও বেশি খালি হয় মায়ের বুক।- বাংলানিউজ
২০১৮ থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২২টি শিশু চুরির তথ্য পাওয়া যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে। জানা গেছে এসব শিশু চুরির ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে অবাক করা খবরও। শ্রমিক অধ্যুষিত নগরের বাকলিয়া ও ইপিজেড, হালিশহর, চকবাজার, লালখান বাজার, মোহরা-কালুরঘাট এলাকায় শিশু উদ্ধারের মাধ্যমে ধরা পড়ে ১০-১২টি চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্য।
শিশু চুরি করতে গিয়ে আটক হওয়া ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তি মতে, দলে মূল ভূমিকায় থাকে হাসপাতাল কেন্দ্রিক সদস্যরা। তারা টাকার ভাগ পায় বেশি। এরপর আছে হাত বদলকারী। চক্রের কেউ খোঁজে ক্রেতা, কারো দায়িত্ব দর-দাম করা। ক্রেতা পেলে কারও কাছ থেকে নেওয়া হয় অগ্রিম টাকা। শিশু চোরদের কাছে নবজাতক ছেলের সাংকেতিক নাম ‘জামাই’, মেয়ে শিশুর নাম ‘বউ’।
শিশু চোর চক্রের অধিকাংশই চট্টগ্রামের বাইরের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে যারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যায়, তাদের জামিনের জন্য এই চক্রই ঠিক করে রাখে আইনজীবী। এছাড়া শিশু কেনার পর দম্পতিরা কতিপয় আইনজীবীর মাধ্যমে অভিভাবকত্ব অর্জন ও ছেলেশিশু দত্তক নেওয়ার জন্য স্ট্যাম্প করে নেন।স্বামী-স্ত্রী মিলে সন্তান বিক্রি: স্বামী-স্ত্রী মিলে সিদ্ধান্ত নেন অনাগত সন্তানকে বিক্রি করবেন। গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাম করে জানতে পারেন- যমজ সন্তান আসছে। সন্তানদের বিক্রি করার জন্য লোকও পেয়ে যান। পাঁচলাইশের পলি হাসপাতালে সন্তান জন্মদানের পরপরই ছেলে শিশুকে ৩ লাখ আর কন্যা শিশুকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন এক দম্পতি।
সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. সাদ্দাম। সংসারে আছে স্ত্রী ও দুই কন্যা। পুত্র সন্তানের আশায় তৃতীয়বারও জন্ম নেয় কন্যা সন্তান। পরপর তিন কন্যার জন্ম হওয়ায় সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে বিক্রি করে দেন সাদ্দাম। ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মনিপুর গ্রামের বাসিন্দা নাসিমা আক্তার। ২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর যমজ ছেলে-মেয়ে জন্ম দিয়েছিলেন নাসিমা। জন্মের পরই ছেলে মারা যায়। নবজাতক মেয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিল। অসুস্থ সেই শিশুকে হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডে ফেলে রেখে আরেক প্রসূতি আসমা উল হুসনার নবজাতক নিয়ে পালিয়ে যান নাসিমা। হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তাকে শনাক্ত করা হয়। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৫ দিন বয়সী ওই নবজাতককে উদ্ধারের পাশাপাশি নাসিমা ও তার মাকে গ্রেপ্তার করে।
হাসপাতালকেন্দ্রিক ভয়ঙ্কর চক্র: হাসপাতাল-ক্লিনিকে নবজাতক চোর চক্রের সদস্যরা প্রসূতিদের প্রতি নজর রাখে সার্বক্ষণিক। যেসব প্রসূতি খুব গরীব কিংবা দেখাশোনার লোক নেই, তারা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় সহজেই। এই চক্রের নারী সদস্যরা আয়া, চিকিৎসকের সহকারী সেজে সহানুভূতি লাভের জন্য প্রসূতির পাশে থাকে। কখন সিজারিয়ান বা স্বাভাবিক প্রসব হবে-সে সময় অনুযায়ী তারা প্রস্তুতি নেয়। এই চক্রের আরেক দল প্রসূতিকে বাথরুমে পাঠিয়ে, সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর কথা বলে বা ঘুমের সময়কালে নবজাতককে হাসপাতালের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। এরপর আরেক দল ক্রেতার হাতে পৌঁছে দেয়। অনেক সময় চক্রের সদস্যরা প্রসূতির মৃত সন্তান হয়েছে বলে প্রচার চালায়। এদের কথা বিশ্বাস করে অনেকে হাসপাতাল-ক্লিনিক ছাড়েন। অথচ তারা ঘুণাক্ষরেও টের পান না, তাদের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
২০১৮ সালের ১৭ এপ্রিল। জীবিত কন্যা শিশুর বদলে মৃত ছেলে শিশু গছিয়ে দেওয়া হয়েছিল নগরের গোলপাহাড় এলাকার বেসরকারি চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে। এ সময়েই গায়ে অ্যাপ্রন জড়িয়ে ডাক্তার সেজে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে শিশু চুরি করতে এসেছিল মীরসরাইয়ের নিজামপুর কলেজ এলাকার মো. জাফরের ছেলে রাজু ও বরিশালের বাকেরগঞ্জের শাহরিয়ার মাহমুদের স্ত্রী ফারজানা আক্তার মনি।
চুরি করা শিশু পাচার: বায়েজিদ বোস্তামি থানাধীন রউফাবাদ রাজা মিয়া কলোনি থেকে চুরি করা দেড় বছর বয়সী শিশু আরজুকে পাচারের সময় ভারত সীমান্তবর্তী হবিগঞ্জ জেলা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট আবিদা সুলতানা নামের এক বছর বয়সী শিশুকে চুরি করে নিয়ে যায় বাবা মনির হোসেন ও সৎ মা রোজিনা বেগম। ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে পতেঙ্গা থানা পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। ১৬ সেপ্টেম্বর নগরের কাজির দেউড়ি সার্কিট হাউজের পাশে ফুটপাতে পড়ে থাকা বাজারের ব্যাগ থেকে একমাস বয়সী এক শিশু কন্যাকে উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুটি চট্টগ্রাম গ্রামার স্কুলের শিক্ষক মানিক চক্রবর্তীর। মেহেদীবাগের বাসা থেকে শিশুটি চুরি হয়। হাটহাজারীর ছিপাতলী এলাকায় নিঃসন্তান রীমা আক্তারের হেফাজত থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, শিশুটিকে চুরি করে নিয়ে দুই লাখ ২০ হাজার টাকায় নিঃসন্তান ওই নারীর কাছে বিক্রি করেছিল তারা।
২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন পাঁচদিন বয়সী এক নবজাতক চুরি হয়। নগরের ইপিজেড এলাকা থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে চুরি হওয়া তিন বছর বয়সী এক শিশুকে ফেনী থেকে উদ্ধার করার পর পুলিশ জানিয়েছে, ১৫ দিনের মধ্যে শিশুটি চারবার হাতবদল হয়েছে এবং তিনবার বেচাকেনা হয়েছে। প্রতিবার হাত বদলে দাম বেড়েছে শিশুটির।
সিএমপির তৎকালীন উপ-কমিশনার (বন্দর) শাকিলা সোলতানা বলেন, সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা মূলত নি¤œ আয়ের লোকজনের সন্তানদের টার্গেট করে তাদের বাচ্চা চুরি করে এবং নিঃসন্তান দম্পতিদের কাছে বিক্রি করে। যেসব শিশু ছোট এবং কথা বলতে পারে না, তাদের টার্গেট করে, যাতে সহজেই চুরি করে বিক্রি করে দেওয়া যায়। চুরি হওয়া অনেক শিশু রাস্তাঘাট বা দোকানের পাশে খেলাধুলা করে। অপহরণকারীরা তখন চিপস-চকলেটের লোভ দেখিয়ে বাচ্চা চুরি করে। অপহৃত অনেক শিশুকে ফেনী, নোয়াখালী ও ল²ীপুর সহ সীমান্তবর্তী জেলায় নিয়ে পাচারের চেষ্টাও হয়।
চলতি বছরের ২৬ ফেব্রæয়ারি ছেলের আশায় শিশু চোর চক্রে জড়িয়ে ধরা পড়েন ৫ মেয়ের বাবা দুলাল মিয়া। নগর থেকে চুরি হওয়া ১৫ মাস বয়সী ছেলে শিশুকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক দম্পতির হেফাজত থেকে উদ্ধার করে র‌্যাব এ তথ্য জানায়। যাদের কাছ থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়, তাদের নিজেদের পাঁচটি মেয়ে আছে। শুধুমাত্র একটি ছেলের আশায় তারা চোরের কাছ থেকে ১ লাখ টাকায় শিশুটিকে কিনে নেয়।
র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব আলম বলেন, হাসপাতাল ও রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ঘুরাঘুরি করে দুলাল। শিশুর স্বজনদের নানাভাবে ভুলিয়ে আটকে রাখে। এরপর শিশুর ছবি পাঠায় প্রত্যাশিত ক্রেতার কাছে। তাদের পছন্দ হলে শিশু চুরি করে তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এভাবে ক্রেতার পছন্দমতো শিশু চুরি করে বিক্রি করতো দুলাল মিয়া।
শিশুর খোঁজে আদালতে: প্রায় ১৪ বছর আগে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল থেকে দুই শিশু চুরির মামলায় হাসপাতালের আয়া দীপালি দাসকে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ যাবজ্জীবন কারাদÐ দেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম ফেরদৌস আরা।
২০১৯ সালের ২৭ মে কাজীর দেউরি এলাকা থেকে শেফালী বেগম নামে এক নারীর দুইমাস বয়সী শিশু চুরি হয়। বাচ্চাটি চুরি করে ইকবাল ও আফসার। এরপর শিশুটিকে পারভীন আক্তারের হেফাজতে রাখা হয়। পরে সুজিতের মধ্যস্থতায় শিশুটিকে নিঃসন্তান পবনের কাছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয় আফসার। বাচ্চাটি নেওয়ার সময় আফসারের সঙ্গে ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে পবনের চুক্তি হয়।
চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকার মমতা মাতৃসদন-২ হাসপাতালে ২০২২ সালের ২৬ আগস্ট সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে এক শিশুর জন্ম হয়। ২৯ আগস্ট নার্স সেজে ওয়ার্ডে যান এক নারী। ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলে শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালের নিচে নেমে পালিয়ে যান তিনি।
চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী সুজন কান্তি দে বলেন, ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আইনে একজন অভিভাবক আইনি প্রক্রিয়ায় একটি শিশুর দায়িত্ব নিতে পারেন। মুসলিম আইনে সন্তান দত্তক নেওয়া যায় না, নেওয়া যায় অভিভাবকত্ব। তবে হিন্দু আইনে পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রে দত্তক নেওয়া যায়। হিন্দু পুরুষ বিবাহিত, অবিবাহিত বা বিপত্নীক, দত্তক নিতে পারবেন। আবার একজন অবিবাহিত নারী সন্তান দত্তক নিতে পারেন না। বিবাহিত নারীর ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি দরকার হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অনেক সময় অভাব ও সন্তান লালন-পালনের মতো আর্থিক দুরবস্থার কারণে মা-বাবাও নবজাতককে অন্যের হাতে তুলে দেন। এছাড়া যাদের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় না, যারা অবৈধ সম্পর্কে জড়িত হয়ে গর্ভপাত ঘটায় কিংবা বহুবিবাহ করে, যারা সন্তানহীন, কর্মহীন বা নেশাগ্রস্ত-তারাই শিশু বেচাকেনায় সম্পৃক্ত হয়। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রসূতি ওয়ার্ডে যে ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা দরকার, তা নেই। অদক্ষ নার্স-আয়া সহ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মরত লোকজন বাড়তি আয়ের লোভে এ কাজে জড়ায়।