রতন কুমার তুরী
দেশের শিক্ষা পদ্ধতি যেভাবেই তৈরি করা হোকনা কেনো, তা যদি ছাত্র-শিক্ষক আর অভিভাবকরা না বুঝে কিংবা পদ্ধতিটি বিষয়ে শিক্ষকদের গভীর জ্ঞান না থাকে তাহলে সে শিক্ষা পদ্ধতি হবে গৎবাঁধা এবং মুখস্থ নির্ভর। আমরা বিগত কয়েকটি শিক্ষা পদ্ধতি পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই কিছু ক্ষেত্রে এ শিক্ষা পদ্ধতির বিষয়াদি খোদ শিক্ষকরা পর্যন্ত বুঝতে সক্ষম হয়নি। পরবর্তীতে অবশ্য শিক্ষকরা নিজেরাই চর্চার মাধ্যমে বিষয়টি বুঝতে সক্ষম হয়েছিল। কোনো একটা শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার আগে প্রথমে যে বিষয়টি প্রয়োজন তাহলো শিক্ষকদের অবগত করা এবং ওই শিক্ষা পদ্ধতির ওপর তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া। প্রয়োজনবোধে শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এ প্রশিক্ষণটা যদি শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগের আগে করা যায় তাহলে শিক্ষকরা সাচ্ছন্দ্যে শিক্ষার্থিদের পাঠদান করাতে পারবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি প্রণীত হওয়ার পর আমরা কখনও এতে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করতে দেখিনি অথচ শিক্ষা পদ্ধতিকে বাস্তবায়ন করতে অভিভাবকদেরও কিছুটা দায়িত্ব রয়েছে। শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগের পর প্রতিটি জেলা উপজেলায় অভিভাবকদের নিয়ে শিক্ষা পদ্ধতি বিষয়ে অবহতি করণ সমাবেশ করা গেলে যে কোনো শিক্ষা পদ্ধতি আরো কার্যকর হতো। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হোকনা কেনো ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে সম্পর্কের মেলবন্ধন স্থাপিত না হলে তার মানোন্নয়ন অনেকটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করানোর পর সে শিক্ষার্থি বাড়িতে তা চর্চা করছে কীনা তার খোঁজখবর একমাত্র অভিভাবকদের নিকট থেকে নেয়া যায়। সেক্ষেত্রে শিক্ষক যদি অভিভাবকের সাথে একটা চমৎকার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন তাহলে শিক্ষার্থিরা কোন জায়গায় ভুল করছে তা সহজে বের করা যায়। তবে যেসব শিক্ষার্থির যথেষ্ট জানার আগ্রহ থাকে তাদের ভুল অনেকটা কম হয়। তারা শিক্ষকের কাছ থেকে যে কোনো কিছু আদায় করে নিতে সক্ষম হয় তাদের নিজ গুণে। দূর অতীতে মাস্টার মশাইরা ছাত্র-ছাত্রীরা রাতে বাড়িতে পড়ছে কীনা তা দেখতে যেতো। এ সুযোগে শিক্ষার্থির পিতা-মাতার সাথে কথা বলে আসতো। তবে মাস্টার মশাইদের শিক্ষার্থিদের যাওয়ার সময় ক্ষণ কোনোটাই পূর্বপরিকল্পিত থাকতোনা হঠাৎ করেই একটা পাড়ায় ঢুঁ দিতো এবং সেখানে বসবাসরত ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে যেতো। এমন আচমকা মাস্টার মশাইদের ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ি পরিভ্রমণ দেখে পাড়ার সব মানুষ অবাক হয়ে যেতেন এবং মাস্টার মশাইদের শ্রদ্ধা আর আপ্যায়নের কোনো ত্রæটি করতেননা। এর ফলে শিক্ষার্থিরা লেখা পড়ায় মনোযোগী হতো।
এমন পদ্ধতি অবলম্বনের ফলে সেসময় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালো ফলাফলও করতো। এখনও সে পদ্ধতির প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। এমন পদ্ধতি অবলম্বন করলে এখনও যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালো ফলাফল আশা করতে পারে। বর্তমানে ক্যাডেট কলেজগুলো সেই পুরোনো পদ্ধতিকে একটু রিফর্ম করে ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেলে রেখে নিবিড় পরিচর্চার মাধ্যমে আশাতীত ভালো ফলাফল করছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ভালো শিক্ষার্থিরা আরো কীভাবে ভালো করতে পারে সে বিষয়ে জোর দেয়া হয় বেশি। কিন্তু গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অপেক্ষাকৃত কম জিপিএ পাওয়া অসংখ্য সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থির কথা মোটেও চিন্তা করা হয়না। এদের নিয়ে গ্রামীণ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পথ চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। এসমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থিরা পরীক্ষায় কীভাবে ভালো করবে সেটা নিয়ে শিক্ষকদের চিন্তার কোনো শেষ থাকেনা। প্রান্তিক পর্যায়ে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ত্রিভূজ সম্পর্কের মাধ্যমে ভালো ফলাফল করতে পারে। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক এমন বলিষ্ঠ এবং চমৎকার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলুন যে সম্পর্কে কোন খাত থাকবেনা। ছাত্র শিক্ষকের কাছে অবলীলায় সবকিছু শেয়ার করতে পারবে। শিক্ষার বিষয়ে শিক্ষক যেটুকু দিতে চান শিক্ষার্থি যেনো তা সম্পর্কের জোরে সবটুকু গ্রহণ করতে পারেন।
আমরা প্রান্তিক কিংবা গ্রামীণ পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লক্ষ্য করেছি অভিভাবকদের ডাকলেও আসতে চাননা। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেও অভিভাবকদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনা। যার ফলশ্রæতিতে একজন অভিভাবক কোনো দিনও জানতে পারেননা তার সন্তানটির ঘাটতি কোথায়। যদি অভিভাবকগণ একটু সচেতন হয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে তার সন্তানটির লেখা পড়ার খোঁজখবর নেয় তাহলে তিনি জানতে পারতেন তার সন্তানটির লেখাপড়ায় কতদূর এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা মূলতঃ শিক্ষার্থিদের লেখাপড়ার মানোন্নয়নে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের সম্পর্কেই বেশি প্রাধান্য দিতে চাইছি। এ তিন জনের সুন্দর সম্পর্কের মাধ্যমে যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী।
তাই আসুন সবাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের সম্পর্কের ত্রি-মাত্রিক মেলবন্ধন গড়ে তুলি এবং প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়তা করি।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক