ছাত্রনেতা মনোয়ারের চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলন আজো ইতিহাস হয়ে আছে

1

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেনের জীবনী আলোচনায় চট্টগ্রামে তাঁর আশির দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনের কথাই বেশি মনে পড়ে। তিনি যদিও পরবর্তীকালে লন্ডন গিয়ে লিংকনস-ইন থেকে বার-এট-ল ডিগ্রি নিয়ে সেখানেই আইন চর্চায় নিয়োজিত হয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তথাপি তিনি দেশে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন করে গিয়েছিলেন, সেটাই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। একজন ছাত্র হয়ে মনোয়ার যে আন্দোলনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন, তাতে তিনি রাজনৈতিক নেতাদেরকেও হারিয়ে দিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক দল তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ, অনশন, অবস্থান, মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে, কিন্তু কোন নাগরিক সংগঠনও সামাজিক ও নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য এ ধরনের কর্মসূচি পালন করে সেটা আশির দশকের পূর্বে চট্টগ্রামে জানা ছিল না। আশির দশকে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পতিত হয়ে চট্টগ্রাম শহরের নাগরিক জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছিল। রাস্তাঘাটের করুণ অবস্থা, খোয়া উঠে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়ে গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল শহরের রাজপথ এবং অলিগলিও, সেখানে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি জমে রাস্তায় স্থানে স্থানে পুকুর ও ডোবা সৃষ্টি হয়ে যেত। যানজটে জান পেরেশান হয়ে শহরে বাস করে মানুষের আফসোসের সীমা ছিল না। খাল, নালা ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে জোয়ারের পানি উঠে নিম্নাঞ্চল সবসময় প্লাবিত থাকত। বাসা বাড়িতে পানি উঠে পরিবারের সদস্যরা গাদাগাদি করে একটি খাটের উপর বসে নির্ঘুম রাত্রি যাপন করত। চুলা জ্বলত না, হোটেল থেকে এনে খাওয়া-দাওয়ার পালা চুকাতে হত। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিকেয় উঠেছিল। বর্ষাকালে শহর ডুবে সাগর হয়ে যেত, রাস্তায় নৌকা চলাচল করত, মানুষ জাল মেরে পোলো দিয়ে মাছ ধরত। চাক্তাই খাল ছিল শহরের পানি চলাচলের প্রধান নিকাশি ব্যবস্থা। এক সময় চীনে যেমন হোয়াংহো নদী ভরাট হয়ে সেখানকার অধিবাসীদের জন্য অভিশাপ হয়ে উঠলে হোয়াংহোকে ‘চীনের দুঃখ’ বলা হতো। চাক্তাই খালও ভরাট হয়ে ঠিক তেমনি ‘চট্টগ্রমের দুঃখে’ পরিণত হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে শহরের কয়েকজন সচেতন নাগরিক প্রথমে ‘চাক্তাই খাল খনন সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করেছিলেন। যারা এ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাকলিয়ার এম কফিলউদ্দিন, ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন, শাহরিয়ার খালেদ প্রমুখ। কফিলউদ্দিন ’৭৩ খ্রিস্টাব্দের এমপি এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, ব্যারিস্টার মনোয়ার ছিলেন তখন ছাত্রনেতা এবং শাহরিয়ার খালেদও ছাত্রনেতা ছিলেন। তাঁর আরেক পরিচয় হল তিনি শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টারের প্রপৌত্র। তাছাড়া তিনি একজন সঙ্গীতশিল্পীও। ব্যারিস্টার মনোয়ার ছিলেন ইনস্ট্রুমেন্টাল। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামের আরও সমস্যা নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের সূচনা করার জন্য তারা ‘বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন শহরের আরও বিশিষ্ট নাগরিক এবং মান্য ব্যক্তিত্ব যেমন এস এম জামাল উদ্দিন, অধ্যাপক সালমা চৌধুরী, নুরুল আমিন , এডভোকেট এ কে এম এমদাদুল ইসলাম, এডভোকেট শফিউল আলম, আবদুল হাই, কামাল আজিজুল হক, শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, অধ্যক্ষ আবু সাঈদ, এডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত, বীর মুক্তিযোদ্ধা কামালউদ্দিন চৌধুরী, সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহীম, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন চৌধুরী, লায়লা ইব্রাহীম বানু, খোরশেদ আলম সুজন, কালাম চৌধুরী, মোহাম্মদ উল্লাহ, মুজিবুল হক শুক্কুর, ছাত্রনেতা মোহাম্মদ আতিক, স্বপন সেন, কামাল উদ্দিন, তসলিম খাঁ প্রমুখ। পরবর্তীকালে রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতি এম এ ছালাম, পূর্বকোণের চেয়ারম্যানের মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংগঠনটিকে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে উন্নীত করেছিলেন। সংগ্রাম কমিটি আন্দোলনকে শহর থেকে তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলায় ছড়িয়ে দিয়েছিল। কক্সবাজার থেকে স›দ্বীপ এবং তিন পার্বত্য জেলায়ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে একটি গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল বৃহত্তর উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটি। তাঁদের তুমুল আন্দোলনে চট্টগ্রাম কেঁপে উঠেছিল। এত ব্যাপক এবং তীব্র নাগরিক আন্দোলন চট্টগ্রামে আগে পরে আর কখনো হয়নি। এই আন্দোলনের জন্য দু’জন মানুষকে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দিতে হয়। মনোয়ার এবং এস এম জামাল উদ্দিন। মনোয়ার ছিলেন তরুণ এবং তাঁর উৎসাহ, উদ্যম ও সাহসও ছিল বেশি। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব করে মনোয়ার আন্দোলন পরিচালনার সমস্ত কলা কৌশল রপ্ত করেছিলেন এবং সেগুলি চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনে প্রয়োগ করে সাফল্য লাভ করেছিলেন। মনোয়ার ছিলেন আশির দশকের চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের মধ্যমণি, আগুনের একটি জ্বলন্ত শিখা।
ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক। তাঁদের আদি নিবাস বোয়ালখালী থানার কধুরখীলে। তাঁরা সাত ভাই, দুই বোন। বড় ভাই সাঈদ হারুন (যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী), মেজ ভাই প্রখ্যাত ফুটবলার, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল ইসলাম, বড় ভাই শহীদুল ইসলাম চট্টগ্রাম ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি ও বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ এবং বিসিআইসি’র সাবেক জেনারেল ম্যানেজার।
তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক অঙ্গনে মনোয়ার আহমেদ নামে বেশ পরিচিত ছিলেন, তবে তাঁর আসল নাম মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন। তিনি ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে সরকারি বাণিজ্য কলেজ থেকে বি কম এবং ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম কম পাস করেন। পরবর্তীকালে তিনি লন্ডনের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে এল এল বি (অর্থ) ও ১৯৮৯ সালে লিংকনস্-ইন থেকে বার-এট-ল ডিগ্রি নেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব কন্টিনিউয়িং এডুকেশনে ডিপ্লোমা ইন নোটারিয়াল প্র্যাকাটিস কোর্স করেন।
ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বের প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন। ছাত্র জীবনেই তাঁর নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। তিনি চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ গভর্ণমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় সাধারণ ছাত্রদের ভোটে ছাত্র সংসদের এজিএস (এসিস্ট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারি) নির্বাচিত হন। তখন ইউনিভার্সিটি ও কলেজের মতো হাই স্কুলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো, বিশেষ করে সরকারী স্কুলগুলোতে এবং সেখান থেকেই ভবিষ্যতে রাজনীতি ও সমাজে ভালোমানের নেতৃত্ব সৃষ্টি করার একটি সুযোগ ছিল। স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা করতেন। ওই স্কুলের মিলনায়তনটিতে এসেম্বলীতে প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোন না কোন বিষয় নিয়ে তাঁকে বক্তৃতা করতে দেখা যেত, এমনকি কোন কারণে দেশব্যাপী বা কোন দাবিতে স্কুলের ছাত্র ধর্মঘট হলেও ঘোষণাটা সেখান থেকেই স্টেজে উঠে তিনি দিতেন। কাজেই পাবলিক স্পিকিংয়ে কিশোর বয়সেই তার হাতেখড়ি বলা চলে। আর ঐ সুবাদে কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে জিলা- বিভাগ, জাতীয় টেলিভিশন পর্যায়ে বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কৃতও হয়েছেন তিনি। স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় নতুন নিয়ম হলো শুধুমাত্র ক্লাস নাইন থেকে জিএস এবং এইট থেকে এজিএস সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে, প্রধান শিক্ষকসহ মিলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে বিভিন্ন পদে তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হতো। আর ক্লাস টেনের ছাত্রদেরকে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না কারণ তাদের এসএসসি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। মনোয়ারের সাথে প্যানেল থেকে নির্বাচিত জিএস সোলায়মান প্রায় সময় উপস্থিত না থাকায় মনোয়ারকে সব দায়িত্ব পালন করতে হতো। ঐ সিস্টেমকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের তথাকথিত সিস্টেম “মৈালিক গণতন্ত্রের” অনুকরণ এই কথা বলে মনোয়ার এবং তাঁর সহকর্মীরা আন্দোলন করে করে সিস্টেমটা চেঞ্জ করেন এবং পুরো ছাত্র সংসদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন।
মনোয়ার যখন নাইনে, তখন হলেন জিএস আর ক্লাস টেনের সুবক্তা আবদুল জাব্বার হলেন ভিপি। তাদের পুরো প্যানেল জিতে গেলো। আর এই দুইজন জাব্বার-মনোয়ার তখন সারা শহরে নাসিরাবাদ স্কুলকে ছাত্র রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে নিয়ে আসেন। তখনকার কুমিল্লা বোর্ডের এসএসসি সিলেবাস কমানোর সফল আন্দোলনে হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রীদের নেতৃত্বে ছিলেন তারা। স্কুল থেকে তাদের বিদায়ের পরেও দশ বছরেরও বেশি সময় যাবত তাদেরকে নিয়ে শিক্ষকরাই ছাত্রদের মধ্যে নেতৃত্বের উদাহরণ হিসেবে গল্প করেছেন। স্কুল জীবনের পর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েও মনোয়ারের ছাত্র রাজনীতির ধারা অব্যাহত ছিল। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তার উদ্যোগে নাসিরাবাদ হাইস্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতি গঠিত হয়, তাঁর ওপরই আহ্বায়কের দায়িত্ব অর্পণ করে সবাই যেন নিশ্চিন্ত হয়েছিল।
মনোয়ার ছিলেন মূলতঃ ছাত্রনেতা। ছাত্ররাজনীতি করেই তিনি বৃহত্তর ক্ষেত্রে নেতৃত্বের আসনে উন্নীত হন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, কিছু সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয শাখার সভাপতি, চট্টগ্রাম নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ও চট্টগ্রামের অন্যতম নেতা ছিলেন । একাধিকবার কারাগারে আটক ছিলেন দীর্ঘদিন ।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ফয়েজুল করিমকে সভাপতি এবং তাঁকে সাধারণ সম্পাদক করে নাসিরাবাদ হাইস্কুল প্রাক্তন সমিতির উদ্যোগে প্রথম পুনর্মিলনী হয়। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ১৪ জুলাই সাবেক সাংসদ এম কফিলউদ্দীনকে চেয়ারম্যান, মনোয়ার আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক ও শাহরিয়ার খালেদকে সমন্বয়কারী করে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট ‘চাক্তাই খাল খনন সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। সাংবাদিক সম্মেলন এবং মতবিনিময় করে জনমত গঠন করে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর সিটি কর্পোরেশন ঘেরাও করা হয়। পরবর্তীকালে গণঅনশন হরতাল সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। এক পর্যায়ে সরকার পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্প নামে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণে চাক্তাই খালসহ জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ১৫ দফা দাবি নিয়ে এস এম জামালউদ্দীনকে চেয়ারম্যান, মনোয়ার আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক ও শাহরিয়ার খালেদকে সমন্বয়কারী করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন গণ সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে আন্দোলনের ফলে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়। এই সংগঠনটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়নে ৪৮ ঘণ্টা হরতালসহ কয়েকটি হরতাল করে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক মানের বিমান বন্দর, কোটি কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্পসহ বহু বড় বড় প্রকল্পের দাবি আদায় করে নেয়। ৮০ দশকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কারণে মনোয়ার একাধিকবার দীর্ঘদিন বিনাবিচারে আটক ছিলেন।
চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে এবং চট্টগ্রাম উন্নয়নে অনেকদিন ধরেই মনোয়ার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ব্যারিস্টার মনোয়ার বৃটিশ-বাংলাদেশ ফোরামের কনভেনর। কভিডের সময়ে বাংলাদেশে ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে দেশে তিনি পৌঁছিয়ে দেন মানুষের জন্য অর্থ ও খাদ্য সাহায্য এবং এম্বুলেন্স।
ব্যারিস্টার মনোয়ার ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচনের সময় এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব ছিলেন ব্যারিস্টার মনোয়ার, যেটি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছিল। তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে লালদিঘি মাঠে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্বাচনী বিশাল জনসভা পরিচালনা করেন। মহিউদ্দীন চৌধুরীর বিজয় তৎকালীন রাজনীতিতে অনেক প্রভাব বিস্তার করে।
২০১৫ খ্রিস্টাব্দের চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম গঠন করে আবারো জলাবদ্ধতা নিরসন, কালুরঘাট নতুন সেতু নির্মাণ ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলেন মনোয়ার।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন দাবিতে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ ও আটচল্লিশ ঘণ্টা হরতাল ডেকে অনেক পুলিশি হয়রানির পরেও সফল হরতাল করে সরকারের টনক নড়িয়ে দিয়েছিলেন।
মনোয়ার সহধর্মিনী লুৎফুন্নাহার লীনা শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। পাশাপাশি তিনি নানা কল্যাণধর্মী ও সামাজিক সংগঠনেও জড়িত।
ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন লন্ডনে ব্যরিস্টারি পড়তে গিয়ে সেখানেও বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠক ও যুক্তরাজ্য ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল সেক্রেটারি। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি এই সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন। এর মাধ্যমে তিনি নিউজ ও জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ও অন্যান্য সভায় যোগ দেন।
ব্যারিস্টার মনোয়ার ইংল্যান্ডে একজন স্বনামধন্য ‘প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার’। ব্যারিস্টার মনোয়ার গ্রেটার চিটাগং এসোসিয়েশন, ইউকে ফাইন্ডিং প্রেসিডেন্ট ও ট্রাস্টি চেয়ারম্যান, বৃটিশ- বাংলাদেশী ফোরামের কনভেনর।
২০১৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম ‘হুজ হু বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। বিজনেস আমেরিকা ম্যাগাজিন ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের ১০০ জন সব চেয়ে প্রভাবশালী বাংলাদেশী প্রবাসীদের একজন ও ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে আইনজীবী হিসাবে ১০০ জন গ্লোবাল আইকন হিসাবে মনোনীত করে। এছাড়াও ব্যারিস্টার মনোয়ার দুবাইতে এন আর বি বেস্ট প্রফেশনাল অব দা ইয়ার ২০২৩ এ্যাওয়ার্ড, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রে ফোবানা এ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাজ্য ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে সেরা আইনজীবী সম্মাননা পান।
তিনি বিশ্বব্যাপী চট্টগ্রাম প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন এর চেয়ারম্যান। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী শাহরিয়ার খালেদের সম্পাদনায় “অদম্য এক মনোয়ার হোসেন” সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ হয়। বইটি ঢাকা চট্টগ্রাম গ্রন্থমেলায় পাওয়া যায়। ব্যারিস্টার অনেকেই হয়তে হয়েছেন কিন্তু ইংল্যান্ডে “প্র্যাক্টিসিং ব্যারিস্টার” হওয়াটা অনেক কঠিন, আর তাই মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাংলাদেশী এই যোগ্যতা অর্জন করে এখানকার উচ্চ আদালতে প্র্যাক্টিস এর সুযোগ পেয়েছেন।
লন্ডনে আইন পেশায় থাকলেও তিনি দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে অফিস স্থাপন করে ইউকে-ইমিগ্রেশন আইনসংক্রান্ত বিষয়ে অগণিত মানুষকে আইনি সহায়তা দেন, তাঁর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে যুক্তরাজ্যে প্রবাসী হাজার হাজার বাংলাদেশি। দেশের সাথে, মানুষের সাথে সবসময় নিয়মিত রেখেছেন যোগাযোগ। হলিডের জন্য নয়, দেশের টানে বছরের দীর্ঘ সময় দেশে অবস্থানকালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন ও সেবামূলক কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার বাংলাদেশী ইমিগ্রেন্টদের আইনি সহযোগিতা দিয়েছেন মনোয়ার, বহুজনকে বিনা ফিতে এখানে স্থায়ী হতে সাহায্য করেছেন। এদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি হবে। এসব প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করতে অবদান রাখছে।
তিনি বাংলাদেশে ও যুক্তরাজ্যে অনেক সামাজিক সেবামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। যুক্তরাজ্যে বাংলা টিভিতে সর্বপ্রথম তিনি আইন বিষয়ক লাইভ শো শুরু করেন। বাংলাদেশে তৃতীয় মাত্রা, অন্যদৃষ্টিসহ বিভিন্ন টিভি অনুষ্ঠানে অনেকবার অংশগ্রহণ করেছেন।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা