নিজস্ব প্রতিবেদক
কপিল উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি চট্টগ্রামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৮৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা করেছেন। গত ৪ আগস্ট নিউমার্কেট এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হয়েছেন অভিযোগ করে এই মামলাটি করেন কফিল উদিন। মামলায় নিজেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী দাবি করেছেন তিনি। তবে স্থানীয় পর্যায়ে কফিল উদ্দিন পরিচিত একজন পেশাদার ছিনতাইকারী হিসেবে।
তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে শুধু কোতোয়ালী থানাতে ছিনতাই, মাদক ও অস্ত্র আইনে চারটি মামলা হয়েছে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের দায়ের করা দুটি মামলার এজহারভুক্ত আসামি কফিল।
গত সোমবার (১৮ নভেম্বর) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেবের আদালতে মামলাটি করেন কফিল উদ্দিন নামে পেশাদার এই ছিনতাইকারী। মামলার এজহারে বাদী কফিল উদ্দিনের পিতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে মৃত জেবল হোসেন।
এতে বলা হয়েছে, স্থায়ী ঠিকানা বারখাইন হলেও বর্তমানে তিনি কোতোয়ালীর নন্দনকানন ২ নম্বর গলিতে থাকেন। এ মামলায় কফিলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদি ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থী রাইহানকেও ৯২ নং আসামি করা হয়েছে।
পুলিশের ধারণা, বিভিন্ন সময়ে ছিনতাই করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া কপিল উদ্দিন পুলিশের প্রতি ক্ষোভ থেকে এই মামলাটি দায়ের করে থাকতে পারেন।
জানা যায়, ২০২১ সালের ৮ মে রাতে নগরীর পুরাতন রেলওয়ে স্টেশনের সামনে থেকে ৪টি ছোরাসহ কফিল উদ্দিন ও আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সেসময় সংবাদমাধ্যমকে কোতোয়ালী থানার তৎকালীন ওসি নেজাম উদ্দিন জানিয়েছিলেন, ছিনতাই করার সময় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওই ঘটনায় কপিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা হয়, ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন উপ-পরিদর্শক বোরহান উদ্দিন।
৪ আগস্টে নিউ মার্কেটে সংঘর্ষে আহত হওয়ার মামলায় ওসি নেজাম উদ্দিন ও উপ পরিদর্শক বোরহান উদ্দিন দুইজনকেই আসামি করেছেন কফিল। যদিও ২০২১ সালে ওসি নেজাম সিএমপি থেকে চট্টগ্রাম জেলা পিবিআইতে বদলি হন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম জেলা শিল্প পুলিশে আছেন। অথচ সেদিন বাদি কফিল নিজেই ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে আহত হন। আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আহত হলেও সেটিকে পুঁজি করে মামলা বাণিজ্যে নেমেছেন কফিল। তার এই মামলা বাণিজ্যে আইনজীবীদের একটি চক্র সহযোগিতা করছেন বলে জানা গেছে।
মামলায় আসামি থাকা অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা হলেন ওসি মোহাম্মদ মহসীন, সিএমপির সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম, পাঁচলাইশ থানার সাবেক ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা, কোতোয়ালীর সাবেক পরিদর্শক সাজেদ কামাল, সাবেক ওসি জাহেদুল কবির, উপ পরিদর্শক খাজা এনাম এলাহী, মো. নূর উদ্দিন, মেহেদি হাসান, মোশাররফ হোসেন, মনিরুল আলম খোরসেদ, রনেশ বড়ুয়া, মৃনাল কান্তি মজুমদার, মমিনুল হক, আসাদুর রহমান।
মামলার অভিযোগে বাদী উল্লেখ করেন, তিনি গত ৪ আগস্ট নগরের নিউমার্কেট গোলচত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন। ওইদিন আসামিদের কয়েকজনের নির্দেশে ও পরিকল্পনায় বাকি আসামিরা গুলি করেন। ককটেল বিস্ফোরণও ঘটান। এতে বাদী হাতে আঘাত পান। ঘটনার পর হাসপাতালে ভর্তি হন। ঘটনায় জড়িত আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ ও সুস্থ হতে সময় লাগায় মামলা করতে দেরি হয়েছে।
এদের মধ্যে ওসি মহসীন ২০২১ সালে খুলনা রেঞ্জে বদলি হন। আন্দোলনের সময় ঢাকা মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন তিনি। ওসি জাহেদুল কবির, মৃনাল কান্তি মজুমদার, মমিনুল হক চান্দগাও থানায় কর্মরত আছেন। অন্যদিকে আসাদুর রহমান আছেন পটিয়া থানায় এবং উপ পরিদর্শক রনেশ বড়ুয়া আছেন বান্দরবান জেলা পুলিশে।
ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (সিডিএমএস) কফিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে চারটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি ২০১৬ সালে, দুটি ২০১৭ সালে ও অন্য একটি মামলা হয়েছে ২০২১ সালে। এর বাইরে ২০২৩ সালে একবার একটি জিডির তদন্তে আদালতের পরোয়ানামূলে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। এসব মামলা রেকর্ড করেন ওসি মহসীন, ওসি নেজাম ও জাহেদুল কবির।
ঘটনার সাড়ে তিন মাস পর এমন মামলা নিয়ে বেশ অবাক চট্টগ্রামের পুলিশ মহল।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, কফিল উদ্দিন একজন পেশাদার ছিনতাইকারী ও মাদক ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ৫টি মামলা আছে। একাধিকবার সে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। এসব ক্ষোভ থেকে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সে মামলা করতে পারে এমনটা ধারণা করছি। তার বিরুদ্ধে মামলা করা ও তদন্তকারী কর্মকর্তাদের আসামি করেছে সে।
নন্দনকানন ও সিআরবি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কফিল একজন মাদক ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে একাধিক মাদক, অস্ত্র ও ডাকাতি মামলা আদালতে বিচারধীন। সে চট্টগ্রাম মেট্রোর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর ও সন্ত্রাসী রিন্টু দাশ বাবলুর বডিগার্ড। সে তার ডাকাতি ও মাদক ব্যবসা পরিচালনা এবং তার বিরুদ্ধে চলমান মামলা থেকে মুক্তিলাভসহ এই মামলার ভয় দেখিয়ে নিরীহ ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের নিকট থেকে চাঁদা দাবির জন্য মিথ্যা মামলা করেছে। মামলায় সে যেসব পুলিশ সদস্যের নাম দিয়েছে তারা অনেকেই গত দুই তিন বছর আগে সিএমপি হতে বদলি হয়ে গেছেন। যে ঘটনার তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে তারা সিএমপিতে কর্মরত ছিলেন না। সিআরবি এলাকায় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণেও বাবর কফিলকে ব্যবহার করতো বলে জানা যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও ছাত্রদের দমাতে বাবর ও রিটুর সাথে বিভিন্ন কর্মসূচিতে লাঠি হাতে অংশ নেন। বাবর ও রিটুর পারিবারিক অনুষ্ঠানেও তাকে দেখা যেতো। তার ফেসবুক আইডিতেও বাবর ও রিটুর সাথে ঘনিষ্ট মেলামেশার ছবি আছে।