নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
পূর্বানুবৃত্তি
উঠলেনও বোনের বাসায়। শাহরিয়ারের কাছে কথাটা পাড়তেই সে বললো, এ আর এমন কী সমস্যা যে আপনি ভেবে অযথা উতলা হচ্ছেন। তাঁর বন্ধু আছে আওরঙ্গ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার কব্জায়। আমি এক্ষুণি তার সঙ্গে কথা বলছি। এই বলে সে তখন পর্যন্ত আরিফ মঈনুদ্দিনের অদৃষ্টপূর্ব ও অশ্রæতপূর্ব যুবক আওরঙ্গের সাথে ফোনে কথা সেরে নিয়ে তাঁকে বললো, মামা আমি আওরঙ্গকে বলে দিয়েছি। আপনি কালকে সকাল দশটায় সূর্য সেন হলের সামনে গেলেই আওরঙ্গের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। সে আপনাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেবে। ভাগ্নের কথামত আরিফ মঈনুদ্দিন পরদিন সকাল দশটায় সূর্য সেন হলের সামনে গিয়ে একজন পানের দোকানদারকে আওরঙ্গের কথা জিজ্ঞেস করেন। দোকানদারকে সম্ভবত আগেই বলা ছিলো, সে তাঁকে একটু অপেক্ষা করতে বলে কার উদ্দেশ্যে কি যেন বলতেই গলায় কাটা দাগ কুৎসিত চেহারার এক যুবক এসে তার পরিচয় দিয়ে বললো ‘আমি মিলন আপনি আমার সঙ্গে আসুন’। মিলন মানে ‘মুরগী মিলন’ নামে খ্যাত এক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, পরে সে কোর্টে মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে প্রতিপক্ষ গ্রæপের হামলায় মারা যায়। যা-ই হোক, মিলন তাঁকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে বসানোর আরো ১৫ মিনিট পর সুন্দর চেহারার এক সুদর্শন যুবক তাঁর কাছে এসে বললো, ‘আমি আওরঙ্গ। আপনাকে মামা বলেই তো ডাকতে পারি।’ তারপর আওরঙ্গ বললেন মামা ঠিক আছে, আজকে থেকে আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকবে। আপনি কাল সন্ধ্যার সময় সূর্য সেন হলের সামনে এসে আমার কথা বললে আমার সঙ্গে আপনার দেখা হয়ে যাবে। আরিফ মঈনুদ্দিন তার পরদিন সূর্য সেন হলে গেলেন। তাকে বলার পর সে তাঁকে ক্যান্টিনে নিয়ে বসাল। খানিক পর একজন মানুষ এসে তাঁকে বললো মামা আপনি আমার মোটর সাইকেল ফলো করেন। সে তাঁকে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে নিয়ে গেলো। জহুরুল হক হলের নিচতলায় একটি সিঙ্গেল রুমে নিয়ে গিয়ে তাঁকে বসাল। মিলন বাইরে যাওয়ার মিনিট সাতেক পর সাত আটজন যুবক আসলো। মিলন তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, এর নাম লিয়াকত। আরো যাদের সে পরিচয় দিলো, তাদের মধ্যে ছিলো হান্নান, জুয়েল, সিরাজ, মানিক, শামীম, জহুর ও মেডিক্যাল কলেজের খোকন।
আরো মিনিট পনের পর আওরঙ্গ আসলো, সঙ্গে আরো দশ বারোজন। কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় হলো না। আওরঙ্গ বললো, মামা চলেন, আজকে আমাদের বার্ষিক ভোজ আছে। রুম থেকে বের হবার সময় দেখলাম সিনিয়র জুনিয়র প্রত্যেক ছেলে তাকে সম্মান জানিয়ে সালাম দিয়ে আসছে আর যাচ্ছে।
ডাইনিং হলে আরো বহু ছাত্রলীগ কর্মীর সঙ্গে সে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলো। রাতে বিদায় নেয়ার সময় মিলন তাঁকে মোটর সাইকেল এসকর্ট করে তাঁর ভগ্নিপতি মেজর আফসারের বাসায় পৌঁছে দেয়। পরে আওরঙ্গ তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক হলে নিয়ে যায়। আশেপাশে বস্তিতেও নিয়ে যায়। সেখানে সব ডিজি/আই এনএসএফ/আই’র ইনফরমার গিজগিজ করছে। তাদের ওপরও আওরঙ্গের ভীষণ প্রভাব। একদিন জিয়া সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাইল আওরঙ্গ। অলি সাহেবকে বললাম, তিনি বললেন, আমার বাসায় ডিনারে নিয়ে আসেন। আমরা কর্নেল অলির বাসায় পৌঁছার কিছুক্ষণ পর শামসুল হুদা চৌধুরী এসে যোগ দেন। তিনজনে কথা বললাম। শামসুল হুদা চৌধুরী কিছু পরামর্শ দিলেন, আমরা এখন কাজের রাজনীতি করবো, কথার রাজনীতি নয়’। দু’দিন পর আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে বসে মিছিলের পরিকল্পনা করলেন। ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে মেজর কামরুলের দেখা হয়। তিনি তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আর্মি সিকিউরিটি ইউনিটের ইনচার্জ ছিলেন। তিনি তাঁকে বললেন, আমাকে হোম মিনিস্ট্রীতে ডেপুটেশনে আনলে আমি আপনার ছাত্রদের দেখাশোনা করতে পারব। আরিফ মঈনুদ্দিন কর্নেল অলিকে বলে কামরুলকে মিনিস্টি অব হোমে নিয়ে আসলেন। এর কিছুদিন পর মিছিলের পরিকল্পনা করলেন।
ইতিমধ্যে ঢাকা ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন হল, মধুর ক্যান্টিন, এলিফ্যান্ট রোডে কারফিউ পাস নিয়ে চিকা মারালেন। চারিদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো অন্যদিক থেকে। তাদের ছেলেরা যতই চিকা মারে, পুলিশ সেগুলি মুছে ফেলতে থাকে। পুলিশেরও দোষ নেই। তাদের ওপর নির্দেশ ছিলো, দেয়ালে চিকা দেখলেই মুছে ফেলতে হবে। সরকারের সমর্থনপুষ্ট দল যে চিকা মারে সেটা ত পুলিশের জানার কথা নয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁকে মিনিস্টারকে ধরতে হলো। তিনি পুলিশকে আর তাদের চিকা মুছতে নিষেধ করে দিলেন।
মিছিলের দিন সকালে আরিফ মঈনুদ্দিন ইন্টারন্যাশনাল হলে যান। চা খেয়ে ১১টার দিকে সূর্যসেন হলের গেটে গিয়ে দেখেন সারি সারি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সবার সঙ্গে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় করিয়ে দিলো আওরঙ্গ। মিছিলের জন্য কোন টাকা-পয়সা লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করায় আওরঙ্গ বললো লাগবে না। মিছিল শুরু হলো। ইউনিভার্সিটির পেছনের গেইট দিয়ে মধুর ক্যান্টিনে যাবার সময়, মিছিলের সামনের অংশ প্রায় মধুর ক্যান্টিনের সামনে। এমন সময় স্টেনগানের ব্রাশফায়ারের আওয়াজ। পাশ থেকে মিলন, লিয়াকত, হান্নান, সিরাজ হাতে পিস্তল বের করে মিছিলের সামনে চলে গেল। আরিফ মঈনুদ্দিন আওরঙ্গকে বললেন, মামা আমি যাই। আওরঙ্গ বললো, মামা আপনি থাকেন, কিছু হবে না। এরা মাহমুদুর রহমান মান্নার গণবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেছে। মিছিলে যাবার আগে আরিফ মঈনুদ্দিন অলি সাহেবকে বলেছিলেন মামা কিছু সিকিউরিটি পাঠিয়ে দেবেন সিভিল ড্রেসে। মিছিল আর্টস বিল্ডিংয়ের পেছনে আসার পর আবার সিঙ্গেল শটের আওয়াজ। আরিফ মঈনুদ্দিন কর্নেল অলিকে ফোন করে আসার কথা বলে চলে যান। নিপার ওয়াল ক্রস করার সময় তাঁর সানগ্লাস পড়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। সেটার জন্য আর পেছন ফিরলেন না। অলি সাহেব বললেন আমরা মিনিটে মিনিটে খবর পাচ্ছি। We are going to close down the university and vaccate the hall. Well done আরিফ মঈনুদ্দিন আবার ইন্টারন্যাশনাল হলে এসে দেখলেন আওরঙ্গ ৫০/৬০ জন নিয়ে সেখানে বসে আছে। বাকিরা সূর্যসেন হলে।
পরদিন আবার মিছিলে পরিকল্পনা করেন আরিফ মঈনুদ্দিন। বেলা ১টার সময় আবার স্টেনগানের আওয়াজ। আওরঙ্গ বললেন, মামা আসেন একটু দেখি। সূর্য সেন হলের সামনে গিয়ে দেখেন, সাদা সার্ট পড়া একটি ছেলে, তার সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তাকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়া হলো। লিয়াকত এ সময় বলে উঠলো, পান্নু ভাই (আওরঙ্গের ডাক নাম), ওরা রেজিস্ট্রার অফিসে শেল্টার নিয়েছে। একথা শোনার পর ৫০/৬০ জন কমান্ডো স্টাইলে ফায়ার করতে করতে রেজিস্ট্রার অফিসে পৌঁছলো। আরিফ মঈনুদ্দিন আওরঙ্গকে বললেন কালকে আর মিছিল করবো না। গভর্ণমেন্ট য়ুনিভার্সিটি বন্ধ করে দিচ্ছে। য়ুনিভার্সিটি খুললে আবার তারা আসবে। সন্ধ্যায় আওরঙ্গরা ৭/৮ জন ময়মনসিংহ রোডে তাঁর ভাইয়ের বাসায় চলে গেল। বললো, মামা আজকের রাতটা এখানে থাকবো। কারণ গণবাহিনী আবার হামলা করতে পারে। আরিফ মঈনুদ্দিন অলি সাহেবকে বলে সির্ভিল ড্রেসে কিছু সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেন। রাতে আবার বসলেন। আওরঙ্গ বললো, জিয়া সাহেবের জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা য়ুনিভার্সিটিতে ঢুকলো। যেহেতু এখন য়ুনিভার্সিটি বন্ধ, তাই আরিফ মঈনুদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দেয়ালে চিকা মারার ব্যবস্থা করেন। রাতে বসে তিনি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন। আহবায়ক মোকসেদ আহমদ, সমাজতত্ত¡ বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। যুগ্ম আহবায়ক একই বিভাগের জহুর। ৫০/৬০ জনকে সদস্য করা হলো।
এদিকে, ক’দিন থেকে তিনি লক্ষ করছিলেন প্রগতিশীল ছাত্র সংঘ নামে একটি সংগঠনের নামে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে শেখ শওকত হোসেন নিলু, গিয়াসউদ্দিন কাদের (চট্টগ্রামের গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী) নামে অজ্ঞাত পরিচয় দু’ব্যক্তি। আওরঙ্গ তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য খুব চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের আনাচে কানাচে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পরদিন আরিফ মঈনুদ্দিন জিয়া সাহেবকে সরাসরি ফোন করলেন। তিনি বললেন আরিফ ওয়েল ডান। আই এম গোয়িং টু রিহাব আওরঙ্গ।
এরপর থেকে কাঁঠাল বাগানের যোগাযোগ রেস্টুরেন্টে আরিফ মঈনুদ্দিন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাদেরকে বলতেন তোমাদের জন্য আরিফ মঈনুদ্দিন মেজর কামরুলকে হোম মিনিস্ট্রিতে ট্রান্সফার করিয়েছে। মিনিস্টারকে সব সময় পাবে না, তাকে কখনো ফোন করার দরকার হলে ‘বড়ভাই’ বলে সম্বোধন করবে।
ছাত্রদল গঠনের পর ৭৭-এর শেষের দিকে অলি সাহেব আরিফ মঈনুদ্দিনকে বলেন, মামা আমরা আগামী মাসে চট্টগ্রাম থেকে রাজনীতি শুরু করবো। আপনার নির্বাচনী এলাকা কোন্টি। আরিফ মঈনুদ্দিন বললেন কোতোয়ালী, বৃহত্তর বাকলিয়া, পূর্ব ষোলশহর, শুলকবহর, পূর্ব মাদারবাড়ি, পশ্চিম মাদারবাড়ি। তিনি বললেন, আমরা রাজনৈতিক মিটিং শুরু করবো আপনার এলাকা থেকে। মিটিংয়ের স্থানও আপনিই নির্বাচন করবেন। অতঃপর আরিফ মঈনুদ্দিন চট্টগ্রাম গিয়ে সার্কেল অফিসারকে (রাজস্ব) নিয়ে বাকলিয়ায় যান। বাকলিয়ার চেয়ারম্যান ছিলেন নুর মোহাম্মদ, কাজেম আলী মাস্টারের বংশের অধস্তন পুরুষ। তাঁকে তিনি বলেন, সরকার রাজনৈতিক মিটিং শুরু করবে। আপনার এলাকা থেকে। জায়গাও আপনি ঠিক করবেন। নুর মোহাম্মদ বললেন আরিফ সাহেব আমার মামা। উনার আম্মা আমার আব্বাকে ১৯৫৬ সালে দুটি রেশনের দোকান বরাদ্দ দেন। চেয়ারম্যানকে জিয়া সাহেবের ভিশন বুঝালেন। নুর মোহাম্মদ বললেন, আপনাকে আমরা পূর্ণ সমর্থন দেব। তিনি তাদেরকে ভাত খাইয়ে তাঁর মেম্বারদের কাছে নিয়ে গেলেন। এক সপ্তাহ ঘুরে সবাইকে বলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াকে বাকলিয়ায় আনতে চাই। আপনারা বাকলিয়ার মানুষের কি কি লাগবে বলেন। নুর মোহাম্মদ বললেন প্রথমে আমাদের চাক্তাই খান খনন করতে হবে। এয়ার মোহাম্মদ মেম্বার বললেন, আপনি ত বড়লোকের ছেলে, রাত দুটার সময় গেলে আপনাকে কি পাব? আপনার দাদার রাস্তাটা ঠিক করে দেবেন। আরেকজন মেম্বার বললেন, মিঞা খান রোডটা ঠিক করে দেবেন।
মিঞা খান সওদাগরের পুত্র মেম্বার ক্যাপ্টেন সোলায়ামান (ধনু) বললেন, প্রফেসর সাহেব আমাদের এখানে অগভীরে নলকূপ বসানো নিষেধ, ওয়াসার পানির ব্যবস্থা করে দেবেন। আরিফ মঈনুদ্দিন বললেন, দিলাম। বাকলিয়ায় ওয়াসার পানি আসবে। একটি কে বি আমান আলী রোড, আরেকটি লাইন মিঞা খান রোড দিয়ে আসবে। চকবাজারের শেখ আহমদ মেম্বার বললেন, বাকলিয়ার স্কুল মাদ্রাসা সংস্কারের জন্য টাকা দিতে হবে। আরিফ মঈনুদ্দিন বললেন তাও দেব।
১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে য়ুনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা কানাডা থেকে দেশের আসার পর একটি পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য আর্মি হেড কোয়ার্টারে অলি সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন আরিফ মঈনুদ্দিন। তিনি তখন চিফ অব আর্মি স্টাফ ও ডিসিএমএলএ জিয়া সাহেবের পার্সোনাল সেক্রেটারি। সমস্যাটা উনি এক মাসের মধ্যে সমাধান করে দেন। তার কিছুদিন পরে জিয়া সাহেব চট্টগ্রাম সফরে আসেন। তখন সমাধানের চিঠিখানি নিয়ে লালদীঘির পূর্ব পাড়ে অলি সাহেবের শ্বশুর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন আরিফ মঈনুদ্দিন। তাদের বাসভবন হাসান মঞ্জিলের ১০০ গজ দক্ষিণে। কর্নেল অলি সাহেব পত্রটা পড়ে খুবই খুশি হলেন এবং বললেন ছোটবেলায় আপনার আব্বা ও চাচাদের সঙ্গে আপনার পিতা ব্যারিস্টার আজিম সাহেবের ভোট কেন্দ্রে যেতাম। ভোট কেন্দ্রে আমাদের বেলা বিস্কুট ও কমলা খাওয়াতেন। যেহেতু ‘আঁরা গুরা পোয়া’ (আমরা ছোট ছেলে) ছিলাম, তাই আমাদের চা দেয়া হত না। সেদিন নির্বাচন ছিল কংগ্রেসী মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও আপনার পিতার। মওলানা ইসলামাবাদীর সমর্থকরা খাকসার নামে পরিচিত ছিলেন এবং তারা ঘোড়ায় চড়ে আসতেন।
তিনি আরিফ মঈনুদ্দিনকে আরো বললেন, ‘ইউ বিলং টু এ পলিটিক্যাল ফ্যামিলি, উই আর গোয়িং ফর পলিটিক্স সুন। উই ওয়ান্ট ইউ উইথ আস’। আমি বললাম আমার আম্মা তো আওয়ামী লীগ করেন। তিনি আপনাদের সাথে পলিটিক্স করতে দিলে ত। তিনি বললেন আপনি নানীর কাছে জিজ্ঞেস করে আধ ঘণ্টার মধ্যে আসুন। আরিফ মঈনুদ্দিন বাসায় গিয়ে দেখেন তাঁর আম্মা ডাইনিং টেবিলে চা খাচ্ছেন। তিনি আম্মাকে কর্নেল অলি সাহেবের প্রস্তাবটা বলেন। চা নাস্তা খেতে খেতে তাঁর আম্মা মিনিট দুয়েক চিন্তা করলেন। তারপর বললেন তোরা আওয়ামী লীগে চান্স পাবি না, যেতে পারিস। আরিফ মঈনুদ্দিন আম্মার পারমিশন নিয়ে অলি সাহেবের বাসার চার তলায় উঠেন এবং তাঁকে বলেন আপনার নানী আমাকে অনুমতি দিয়েছেন। উনি সঙ্গে সঙ্গে ডান হাত বাড়িয়ে বললেন ‘ওয়েলকাম টু দি পার্টি’।
এটা অক্টোবর ৭৬ সালের ঘটনা। দিন দশেক পরে হঠাৎ একদিন দুপুরে চিটাগাং ক্যান্টনমেন্ট থেকে মেজর মুনিম আরিফ মঈনুদ্দিনকে ফোন করলেন, Mamu, This in an official call. আগামীকাল সন্ধ্যা ছ’টায় Chif wants to see you in the VVIP rest house of ctg. Cantt. আরিফ মঈনুদ্দিন তার পরদিন ডবষষ ফৎবংংবফ হয়ে গেলেন। তাঁর আম্মার টয়োটা মার্ক ওয়ান গাড়িটা ভাল করে পালিশ করে ক্যান্টনমন্টে যান এবং ওখানে এমপি গেটে তাঁকে দাঁড় করিয়ে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করা হলো। আরিফ মঈনুদ্দিন নাম বলার পর লিস্ট দেখে তাঁকে স্যালুট দিয়ে বলেন, স্যার, মিলিটারি পুলিশ আউট এরিয়া থেকে আপনি ফলো করে যান। তিনি মিলিটারি পুলিশের মোটর সাইকেলটা ফলো করতে করতে গেলেন ভিভিআইপি রেস্ট হাউজে। সেখানে গিয়ে দেখেন রেস্ট হাউজের পাশে একটি ওপেন স্পেস রয়েছে টেনিস কোর্টের মতো। চিটাগাং মিউনিসিপিালিটির চেয়ারম্যান ফজল করিম সাহেব, এ কে খান সাহেবের ছেলে জহিরুদ্দিন খান সাহেব, চিটাগাং-এর ইংলিশ ডেইলি পিপলস ভিউ’র এডিটর নুরুল ইসলাম সাহেব এবং মওলানা আবু তাহের যিনি পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে নুরুল আমিন সাহেবের দলে ছিলেন, (আরিফ মঈনুদ্দিন সাহেব সম্ভবত এখানে ভুল করেছেন। মওলানা আবু তাহের নুরুল আমিন সাহেবের দল নয়, তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে মুসলিম লীগ করতেন এবং ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তিনি সে দলে যোগদান করেন-লেখক), সেখানে আগে থেকে বসে আছেন। সবাইকে সালাম দিয়ে আরিফ মঈনুদ্দিনও বসেন। কিছুক্ষণ পর তাঁকে ডাকা হলো। রেস্ট হাউজের ভিতরে ঢুকতে গিয়ে দেখেন লোকাল জিওসি ব্রিগেডিয়ার মন্নাফ সাহেব বের হচ্ছেন, উনি পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন।
তিনি বললেন, প্রফেসর বেস্ট অব লাক। আরিফ মঈনুদ্দিন ভিতরে ঢুকে দেখেন জিয়া সাহেব একটা হোয়াইট সাফারি আর হোয়াইট কালারড স্যুাট, ডার্ক গ্লাস উইথ পাওয়ার। তিনি হাত বাড়িয়ে বললেন যে, ও I met you Somewhere earlier. Avwg ejjvg I had the honour of shaking hands with you twice, once in the cantonement and once in Chittagong univerity when you went to visit there.
‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে, বসেন,’ জিয়া সাহেব বললেন। আরিফ মঈনুদ্দিন বসার পর জিয়া সাহেব তাঁর কাছে ওনার vision, বাংলাদেশে কি করবেন; এত কোটি হাত আছে, যার অর্ধেক মহিলা, সবাইকে use করতে পারলে, এই জনশক্তি আমাদের একটা ধংংবঃ হবে। এই জনশক্তিকে use করে আমাদের দেশকে আমরা স্বনির্ভর করবো। আমাদের দেশ খুব Fertile দেশ। আমাদের দেশের লোককে শিক্ষা দিতে হবে, ওদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে, ওদের বাসস্থান দিতে হবে এবং ওদেরকে use করে এদেশটা স্বনির্ভর করতে হবে। আমাদের Honest এবং সঠিক নেতৃত্ব দরকার। আপনাদের মতো য়ুনিভার্সিটির প্রফেসর, যারা শিক্ষিত মানুষ, গুড ব্যাকগ্রাউন্ড, তাদেরকে আমার দরকার। হঠাৎ তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন, Which is your constituency. আরিফ মঈনুদ্দিন বললেন, স্যার, আমার constituency তো চিটাগাং সিটি, এখান থেকে আমার আব্বা ব্যারিস্টার আজিম, আমার দাদা খান বাহাদুর আমান আলী, আমার আম্মা এঁরা সবাই এখান থেকে পার্লামেন্ট রিপ্রেজেনটেটিভ ছিলেন। তিনি বললেন ও আচ্ছা, ঠিক আছে।
এরপর বললেন আমার কতগুলি স্বনির্ভর মডেল প্রজেক্ট আছে। একটা হচ্ছে যশোরের উলশী যদুনাথপুরের দু’টি ইউনিয়নের মধ্যে, ওটা আলটিমেটলি হবে। এখন ওটা ফিনিশিং স্টেজে আর কি।
আরিফ মঈনুদ্দিন বললেন স্যার, what are you going to do with our nationalised Indurtries. It is a burden on the country’s resources. তখন জিয়া সাহেব বললেন, আপনি তো ভালো কথা বলেছেন, এগুলি আস্তে আস্তে দেব। একসঙ্গে দিলে Reaction হবে। তারপর বললেন I would like you to organise the youth of Chittagong – আমাদের youthকে কাজে লাগতে হবেso that living in this coutries. তাহলে আজকে এখানে শেষ হোক। ইন্শাল্লাহ ঘন ঘন আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে।
এরপর আরিফ মঈনুদ্দিন অলি সাহেবের শ্বশুর বাড়িতে যান। তিনি উনাকে সবকিছু বলেন। উনি বললেন, যাক, তাহলে আপনি আমাদের সঙ্গে এখন সক্রিয় হয়েছেন। আরিফ মঈনুদ্দিন বললেন, হ্যাঁ, ওনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। Very smart man,, কথাবার্তা খুব ভালো বলেন এবং মনে হয় উনার আর আমার ফ্রিকোয়েন্সি মিলবে। ফ্রিকোয়েন্সি যদি একই না হয়, তাহলে তো পলিটিক্স করা ঠিক না। অলি সাহেব বললেন মামু ঠিক আছে,Your start to organise the youth. তারপর থেকে আরিফ মঈনুদ্দিন বন্ধু-বান্ধব যারা আছে, তাদের মতো young বয়স, ওদের সাথে আলাপ করেন। ওরা সবাই রাজি সমর্থন দিতে; কিন্তু এতগুলি লোককে এক জায়গায়, একত্রিত করা সম্ভব নয়। তিনি যেহেতু তখন ইউনিভার্সিটির টিচার দু’একটা ছাত্রের সঙ্গে একটু আলাপ করে দেখেন। তাদের Response খুব পজিটিভ, ভেরি পজিটিভ। আরিফ মঈনুদ্দিন বললেন দেখেন, জিয়া সাহেব একজন মুক্তিযোদ্ধা, He is very honest, hard-working উনি দেশটাকে স্বনির্ভর করতে চান এবং দেশের মানকে বাড়াতে চান। উনাকে সমর্থন দিলে আমাদের খারাপ কি। সবাই এক সঙ্গে বললেন স্যার আমরা আছি।.
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা