এম এ হোসাইন
নগরের পাঁচলাইশের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এখন যেন একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির দুর্গে পরিণত হয়েছে। নাগরিক অধিকার নয়, ঘুষ আর দালালের কোডই এখানে পাসপোর্ট পাওয়ার একমাত্র চাবিকাঠি। সরকারি নিয়ম মেনে আবেদন করলেই বিড়ম্বনা, আর দালাল ধরলেই ‘সব ঠিক’। এমন বাস্তবতায় পাসপোর্ট করতে এসে সাধারণ মানুষ যেন এক ভয়াবহ অনিয়মের ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করছেন।
নিয়মিত অনিয়মের এই চক্রের নাম-‘চ্যানেল ফাইল’। আর এর ছত্রছায়ায় দালাল চক্র এখন আধা-অধিকৃত অবস্থানে। দোকানঘরে বসে তারা যেভাবে পাসপোর্ট অফিসের ভেতরের লোকদের সঙ্গে সমন্বয় করছে, তা দেখে মনে হয়, এ যেন এক ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ দুর্নীতি প্রকল্প’।
এই অনিয়মের শিকার লোহাগাড়ার তরুণ সাব্বির আহমেদ (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, আমার সব কাগজ ঠিক ছিল, তবু ফরম জমা নেয়নি। বাইরে বের হলে এক দালাল এসে আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এর কিছুক্ষণ পরেই সেই ফরম জমা নিয়ে নেয়।চন্দনাইশের আশরাফুল ইসলাম দুই দিন লাইনে দাঁড়িয়েও আবেদন জমা দিতে পারেননি। প্রথম দিন বলা হয়, কাগজে ভুল আছে, দ্বিতীয় দিন আবারও একই কথা। আশরাফুল বলেন, আমি জানি না কী ভুল। কেউ বলেও না। অথচ যারা দালালের মাধ্যমে আসে, তাদের ফাইল মুহূর্তেই জমা হচ্ছে।
একই অভিযোগ ইশতিয়াক আহমেদের। তার আবেদন ফেরত দেওয়া হয় এই অজুহাতে যে, জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মসনদ উভয় তথ্য দেওয়া হয়েছে ফরমে, যদিও এটি নিয়মবহির্ভূত নয়। অথচ এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়েই ফাইল বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে, আবার এসব সংশোধনেরও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
পাসপোর্ট অফিস চত্বরজুড়ে এখন ‘চ্যানেল ফাইল’ই সবচেয়ে আলোচিত শব্দ। এই পদ্ধতিতে বিশেষ কোডসহ আবেদন জমা দিলে তা কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই গ্রহণ করা হয়। জাতীয়তা ও চারিত্রিক প্রশংসাপত্র ফরমের পাশেই বড় হাতের তিনটি ইংরেজি বর্ণ ও একটি সংখ্যা দিয়ে লেখা একটি কোড থাকে। এই কোড পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীদের ‘সঙ্কেত’, যা পেলে বুঝে যান, ফাইলটি দালালের।
পাসপোর্ট রিনিউ করতে এসেছিলেন মো. জুনাইদ। কিন্তু আবেদন ফরমে পূর্বের পাসপোর্টের ইস্যু তারিখ ডিসেম্বরের ২৪ এর জায়গায় ০৪ লিখা হয়েছে। এই ভুলের জন্য তার আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। পুনরায় তাকে আবেদন করতে বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় আগে তার আবেদনটি বাতিল করতে হবে। তারপর পুনরায় আবেদন করতে হবে। অথচ পাসপোর্ট অফিস চাইলেও সেটি সংশোধন করে দিতে পারে।
জুনাইদ বলেন, আমার পূর্বের পাসপোর্টের তথ্যে তারিখের ভুল হয়েছে। সেটি তো তারা সংশোধন করে দিতে পারে। এখন একবার আবেদন করে বাতিল করতে হবে। আবার নতুন করে আবেদন করতে হবে। আমার আরো দুইদিন সময় চলে যাবে। যারা দালাল ধরে আসতেছে তাদের তো কিছুই দেখতেছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনজন দালাল জানান, আগে তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও এখন দোকান ঘর থেকেই পরিচালনা করছেন কাজ। প্রতিটি চ্যানেল ফাইলের বিনিময়ে গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া হয় ২ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৬০০ টাকা যায় পাসপোর্ট অফিসে ভেতরের ‘ম্যানেজমেন্ট ফি’। সে টাকা বিভিন্ন কর্মকর্তার মধ্যে তারা ভাগ করেন। এই ভাগে উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক, রেকর্ডকিপার, আনসার, কেউ বাদ যায় না। এই অর্থ অপারেটিভ সিন্ডিকেটের মতো ভাগাভাগি হয় নিয়মিতভাবে।
সূত্র জানায়, পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে ১২০০টি ফাইল জমা পড়ে, যার বড় একটি অংশই চ্যানেল ফাইল। যার মধ্যে কমপক্ষে ৬০% হয় চ্যানেল ফাইল। ফলে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকা হাতবদল হয় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঘুষের নামে। আর মাসে সেই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত দুই কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, ফরমে সব তথ্য দিলেই হবে না, প্রযোজ্য তথ্যই দিতে হবে। কারেকশন করতে হলে গ্রাহককে নিজেই করতে হবে। আমরা ফাইল পেন্ডিং রাখি না, এখন ২২ দিনের পাসপোর্ট ১৫ দিনেই চলে আসে।
দালালি ও চ্যানেল ফাইল সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এজেন্সির কথা আমি জয়েন্ট করার পর থেকে শুনতে শুনতে হয়রান। এসব বন্ধ করতে দোকানগুলোতে পুলিশ পাঠাতে হবে। আমরা সিসি ক্যামেরায় নজর রাখি। এজেন্সির লোকগুলোকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমার এখানে (অফিসে) আসার আগে কি করে তারা ফরম পূরণ করছে? তাদের সে দায়িত্ব কে দিল?
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার অফিসের কেউ অনিয়ম করছে এমনটা প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তাকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়। আমি সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামরায় মনিটরিং করি। এর বাইরে এসব অনিয়ম বন্ধ করার কি উপায় আছে।
ওপেন সিক্রেট দালাল চক্র সম্পর্কে সজাগ পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক। তবে নিজের অফিসের কর্মকর্তাদের অনিয়মে বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থার প্রসঙ্গে না গিয়ে তিনি এজেন্সির বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান জানান।
একই প্রসঙ্গে কথা হলে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক বিল্লাল হোসেন বলেন, অভিযোগকারীকে তো আমাদের কাছে আসতে হবে, আমার কাছে আসতে হবে, আমার স্যারের কাছে আসতে হবে। আপনারা যে অভিযোগ করেছেন সেগুলো যেন না হয় সেজন্য যারা দায়িত্বে আছে তাদের সতর্ক করে দিচ্ছি।
তিনি বলেন, সেবা পাচ্ছে না এমন একটা লোক নিয়ে আমার স্যারের সামনে যান। স্যার অবশ্যই ব্যবস্থা নিবেন।
তবে বাস্তবে সাধারণ মানুষ এই প্রতিকার পাচ্ছে না। বরং অনিয়ম, ঘুষ ও দালালচক্রের ছত্রছায়ায় পাসপোর্ট সেবা হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। দালালের মাধ্যমে ফরম জমা দিলে যেখানে নিশ্চিন্তে মেলে পাসপোর্ট, সেখানে সাধারণ নিয়ম মেনে আবেদন করলেই ঘুরতে হয় দিনের পর দিন।