বাবুল কান্তি দাশ
দ্রোহ আর প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তাঁর কাব্য সাধনার মাধ্যমে বাংলা কাব্যে নিনাদিত করেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী চির-যৌবনের জয়ধ্বনি,অগ্নিবীণার সুর ঝঙ্কার। তিনি বাংলা কাব্যে বয়ে এনেছেন কালবৈশাখীর ঝড়, প্রমত্ত প্রভঞ্জনের বেসামাল আলোড়ন এবং পরাধীন জড়তাগ্রস্ত সমাজের বুকে সঞ্চারিত করেছেন তপ্ত শোণিত ধারা। তাঁর কবিতাগুলো পরাধীন দেশের অবদমিত জনগণের জন্য সঞ্জীবনী মন্ত্র। তাঁর সংগীতগুলো নিপীড়িত, শোষিত, সর্বহারার বেদনার বাণী। বাংলা কবিতা আধুনিক হয়েছে যে সব কবির মাধ্যমে বলা বাহুল্য কাজী নজরুল ইসলাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কবিতার আধুনিকতা সময়ের দিক থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আর ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্তি প্রয়াসী। সত্য-শিব-সুন্দরের পূজারি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জগৎ ও জীবনের প্রতি চরমভাবে আস্থাশীল। আধুনিক কবিরা এহেন রবীন্দ্রদর্শনকে অতিক্রম করতে চাইলেন। কাজটি বড় সহজ ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রপ্রভাবিত কাব্যজগতে তাঁরা নিজ নিজ স্বতন্ত্র কবিসত্তা গড়ে তুললেন। সকলেরই লক্ষ্য জগতের ছেঁড়াখোঁড়া বাস্তবকে কবিতায় তুলে ধরা। সেদিক থেকে নজরুল সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহ ঘোষণা করেই বাংলা কাব্যে তাঁর স্বতন্ত্র কবিবৈশিষ্ট্য গড়ে তুললেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। স্কুলে পড়াকালীন সময়েই তিনি গল্প ও কবিতা লিখতে শুরু করেন। স্কুলের পড়া শেষ না করেই কাজী নজরুল ইসলাম ৪৯ নম্বর বাঙালি রেজিমেণ্টে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে মেসোপটেমিয়ায় যান (১৯১৭)। সেখানে বাঙালি পল্টনের মুসলমান সেনাদের তদারকির কাজে এক জন পাঞ্জাবি মৌলবী যুক্ত ছিলেন। তাঁর মুখে হাফিজের কবিতা শুনেই মুগ্ধ নজরুল মৌলবী সাহেবের কাছে ফারসি শিখতে থাকেন। সৈনিক কবির প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা হাফিজের অনুসরণেই – ‘নাই বা পেল নাগাল, শুধু সৌরভেরই আশে/ অবুঝ সবুজ দূর্বা যেমন জুঁই কুঁড়িটির পাশে/ বসেই আছে – তেমনি বিভোর থাক্ রে প্রিয়ার আশায়,/ তার অলকের একটু সুবাস পশবে তোরও নাসায়।’
বাল্যকাল থেকেই কবির মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম ব্যক্তিদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন তিনি হাফিজ নুরুন্নবীর কাছে ফার্সী ভাষা পাঠ নিলেও সতীশ চন্দ্র কাঞ্জীলালের কাছে ভারতীয় রাগ সঙ্গীত আয়ত্ত করেছিলন।বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমেই তিনি মুজফ্ফর আহমেদের সাথে ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন। প্রথম জীবনে লেখালেখির ক্ষেত্রে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকাই তাঁকে পরিচিতি দিতে থাকে। মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকাতেই তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশ হয়েছিল। মহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মাধ্যমেই কবির সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠতা ও প্রথম সাক্ষাৎ হয়। মণিভুষণ মুখোপাধ্যায়ের সাথেই তিনি ‘লাঙল’ পত্রিকা পরিচালনা করেন। আর্থিক সংকটে ও ভাগ্যের পরিহাসে তিনি কলকাতায় নলিনীকান্ত সরকারের বাড়িতেও আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ গেল কবির ব্যক্তিগত জীবনে হিন্দু মুসলিম সংস্পর্শের সম্পর্ক। ভারতীয় সাংবাদিকতায় নজরুল ইসলামের স্থানাঙ্ক নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। অথচ নজরুলের কবি পরিচয় যখন সবে তৈরি হচ্ছে, তখনই এক জন সাংবাদিক তথা সম্পাদক হিসেবে তাঁর কাজের গতিপ্রকৃতিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সরোজিনী নাইডু, অনেকেই মান্যতা দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষও পত্রপত্রিকা সম্পাদনার সূত্রেই তাঁকে নাগরিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে বরণ করেছিলেন। ১৯২০ সালের গোড়ার দিকেই ব্রিটিশ সেনার ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে গেলে নজরুল কলকাতায় চলে এলেন। প্রথমে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের রমাকান্ত স্ট্রিটের বোর্ডিং হাউসে উঠেছিলেন। দিনকয়েক পরই তাঁর মুসলমান পরিচয় জেনে ওই বোর্ডিংয়ের পরিচারিকা তাঁর বাসন ধুতে অস্বীকার করেন। অতঃপর ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে ঠাঁই হল-মুজফ্ফর আহমেদের আস্তানায়। মুজফ্ফরের সঙ্গেই সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি নজরুলের। তাঁদের যৌথ উদ্যোগে ও সম্পাদনায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হয়। সব মিলিয়ে নবযুগ-এ পাঁচ মাস কাজ করেন নজরুল। কাগজের প্রধান পরিচালক হিসেবে ফজলুল হকের নাম ছাপা হত। তবে সমস্ত কাজই করতেন নজরুল ও মুজাফ্ফর। এই ক’মাসে তিনি নবযুগ-এ ঠিক ক’টি সম্পাদকীয় লিখেছেন, তা আজ আর বোঝার উপায় নেই – তবে এই সম্পাদকীয়গুলির সঙ্কলন যুগবাণী নামক বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। ব্রিটিশ সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৪৮ সালে বইটি আবার প্রকাশিত হয়। যুগবাণী-তে নজরুলের লেখা মোট ২১টি সম্পাদকীয় নিবন্ধ পাওয়া যায়।
নজরুল কিন্তু কবি পরিচয়ের জন্যই কারাবরণ করেননি – মনে রাখতে হবে, তাঁর কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ধূমকেতু-র দ্বাদশ সংখ্যার সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। ১২৪ (ক) ও ১৫৩ (ক) ধারায় স্থিতাবস্থা নষ্টে ইন্ধনের অভিযোগে নজরুলকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিচারের ভার পড়ল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর উপরে, যিনি এক জন কবিও বটে। নজরুল বিচারপতিকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন, তা ধূমকেতু-র শেষ সংখ্যায় ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামে প্রকাশিত হয়। নজরুল লিখেছিলেন, “আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে কিন্তু ন্যায় বিচারে সেই বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দন্ডিত হতে পারে। কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ সত্য স্বরূপ।” রাজবন্দি নজরুলকে কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত করে হুগলি সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে সহবন্দিদের দুর্দশা দেখে হতভম্ব নজরুল ৩৯ দিন টানা অনশন করেছিলেন। সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েও নজরুল তাঁর সৃষ্টির কাজে অনড় থাকলেন। হুগলি জেলে বন্দিদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হলে অন্য বন্দিদের সঙ্গে নজরুলও অনশন শুরু করেন। রবীন্দ্রদর্শন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইলেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নজরুলকে বুকে টেনে নিয়েছেন। আবার রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অন্তরের আকর্ষণ অনুভব করা যায় তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের নামকরণটি দেখে। কারণ রবিঠাকুরের একটি গানই এর প্রেরণা – ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’। প্রাণের আবেগে ভরা তরুণ কবি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ (১৯২৩) নাটকটি উৎসর্গ করেছিলেন। অথচ নজরুল ছিলেন কল্লোলীয় কবি। যাঁদের মূল লক্ষ্যই ছিল রবীন্দ্র বিরোধিতা। নজরুলের কবিতায় বিদ্রোহের সুর বেজে ওঠার কারণ হিসেবে সুকুমার সেন একটি যুক্তি দিয়েছেন, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও প্রাচ্যভূমির দুর্দশা দূর হয়নি। মেসোপটেমিয়ায় গিয়ে স্বাধীনতাকামী মুসলিম রাষ্ট্র তুর্কির উদ্যম নজরুল দেখেছিলেন। সেটাই তাঁর কবিতায় ‘বিদ্রোহ-উল্লাসের সুর’ এনেছিল।’ দাসত্বের কৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘বল বীর বল উন্নত মম শির, …যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না – বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত! কবি নজরুল ইসলাম সব ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁর একটি কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন ছিল – মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। নজরুলের ৭৭ বছরের জীবন হলেও সৃষ্টির জন্য তিনি পেয়েছেন মাত্র ২২-২৩ বছর। কিন্তু এরই মধ্যে তাঁর সৃষ্টি সম্ভারের প্রাচুর্য দেখলে অবাক হতে হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল – অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, বিষের বাঁশী’, ভাঙ্গার গান, ফণিমনসা, পূবের হাওয়া, চিত্তনামা, সর্বহারা, সাম্যবাদী, ঝিঙ্গেফুল’, ‘সন্ধ্যা’ ইত্যাদি। কাব্যগ্রন্থের নামকরণের মধ্যেও প্রচলিত ধ্যানধারণার প্রতি অনাস্থা লক্ষিত হয়। তিনি হাফিজের অনুবাদও করেছিলেন – রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ নামে। ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলিমালা’ ইত্যাদি তাঁর গল্পগ্রন্থ। ‘বাঁধন-হারা’, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা তাঁর উপন্যাস। এ ছাড়া ‘ঝিলিমিলি’ ও ‘আলেয়া’ নামে দু’টি নাটকও রয়েছে। ‘দুর্দিনের যাত্রী’ ও ‘রুদ্রমঙ্গল’ নামে দু’টি প্রবন্ধের বইও আছে তাঁর। তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙ্গার গান’ কাব্যের কবিতাগুলিতে বিদ্রোহী সত্তার সম্যক প্রকাশ মেলে যা তৎকালীন পরাধীন ভারতবর্ষে গভীর দেশপ্রীতিও জাগ্রত করেছিল। যেমন ‘কারার ঐ লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট/ রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী’, (ভাঙ্গার গান)। সমাজের নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তবে তাঁর এই সাম্যবাদ মার্ক্স-এঙ্গেলস প্রবর্তিত সাম্যবাদ নয়। তিনি মূলত ধনী-নির্ধন, নারী-পুরুষ ইত্যাদি বৈষম্যের পাশাপাশি জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে বলেছেন। কোনও রকম ধর্মীয় গÐীতে নিজের কবিসত্তাকে বাঁধতে চাননি। তাই ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা,’ ‘আগমনী’ যেমন আছে তেমনি ‘কোরবাণী’ ও ‘মোহররম্’ও আছে তাঁর লেখায়।বিদ্রোহই শুধু তাঁর কবিতার কেন্দ্র জুড়ে অবস্থান করেনি, প্রেমও তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে। ছায়ানট’ বা দোলনচাঁপা কাব্যের বিষয় প্রেম ও প্রকৃতি। ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যের অভিশাপ কবিতায় প্রিয়তমাকে উদ্দেশ্য করে কবি বলছেন, ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,/ অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে/ বুঝবে সেদিন বুঝবে।’ আবার ছায়ানট কাব্যের বিজয়িনী, পলাতকা, ‘চিরশিশু’,‘বিদায়বেলা’, ‘দূরের বন্ধু’ ইত্যাদি কবিতায় প্রেমের সঙ্গে প্রকৃতিকে মিলিয়েছেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার জন্য বহুবার কারাবন্দী হয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। জেলে বন্দী অবস্থায় লিখেছিলেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। তাঁর এইসব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল প্রকট। সাংবাদিকতার মাধ্যমে এবং পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যকর্মে নজরুল শোষণের বিরুদ্ধে, সা¤প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। নজরুল ছিলেন সব ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে। অন্তরে তিনি না ছিলেন হিন্দু না ছিলেন মুসলিম। তাঁর একটি কথাতেই এটা ছিল পরিষ্কার – ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া’। তিনি সবার ঊর্ধ্বে ছিলেন মানবতার কবি। নজরুলের প্রতিভার যে দিকটা ছিল অনন্য সেটা হল তাঁর বিদ্রোহী চেতনার বহিঃপ্রকাশ – সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি সব কিছুর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহে তিনি সোচ্চার হয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম ও সঙ্গীতে। তিনি কিন্তু শুধু কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন গীতিকার, সুরকার, গল্পকার, সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক কর্মীও। কখনও তিনি গান গাইছেন, কখনও পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, কখনও রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছেন। নজরুল সম্ভবত ওই সময়ের প্রথম বাঙালি, যিনি বাংলার নবজাগরণের যে ঐতিহ্য সেটা ধারণ করেছিলেন এবং তার মধ্যে দিয়ে তিনি বাঙালিকে একটা শক্ত, সবল নতুন চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। নজরুল উঠে এসেছিলেন সমাজের অতি পিছিয়ে থাকা শ্রেণি থেকে। শুধু দারিদ্রই নয়, শিক্ষার অভাবের মধ্যে দিয়ে তিনি বড় হয়েছিলেন – প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাঁর জীবন কেটেছিল। প্রতিকূলতায় ভরা ওই জীবনের মধ্যে দিয়েই তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ ছিলেন নজরুল। যে পথ দিয়ে তিনি গেছেন, যে প্রকৃতিতে তিনি লালিত হয়েছেন, যে পারিপার্শ্বিকতায় তিনি বেড়ে উঠেছেন, সেগুলো তাঁর অজান্তেই তাঁর ওপরে ছাপ ফেলে গেছে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তাঁর গানে ও কবিতায়। নজরুলের গান ও কবিতা একেবারে নিচ থেকে ওঠা মানুষের গান, তাদের কথা। যারা দলিত, যারা অত্যাচারিত, যাদের ভাষা ছিল না, নজরুলের কলমে তারা ভাষা খুঁজে পেল। তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে কবি নজরুল ইসলাম। পাশাপাশি তাঁকে ঘিরে বিতর্ক, নিন্দামন্দ, কটুবাক্যের বর্ষণ চলছিল অনবরত। কাব্যের শিল্পগুণ, চিরন্তনতা সব কিছু নিয়ে মুখর হয়ে উঠেছিলেন বিশেষজ্ঞের দল। নজরুল যেন নিজের ভূমিকাকে নিজের কাছেই কিছুটা দৃঢ় করে তুলতে চেয়েছিলেন কৈফিয়ৎ-এর মাধ্যমে। লিখলেন, ‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’।’ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বর্তমান যেন এক ঘটমান সত্য, এবং তা আজকের নিরিখেও। ১৩৩২-র আশ্বিন সংখ্যার বিজলীতে প্রকাশিত হয় ‘আমার কৈফিয়ৎ’। ‘যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস’, তাদের বিরুদ্ধে একটা রাজনৈতিক প্রস্থান, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিলেন যেন তিনি। আসলে করাচি থেকে ফেরা অবধি কিছুতেই যেন শান্তশিষ্ট হয়ে থাকতে পারছিলেন না। সাব-রেজিস্টারের চাকরির আহŸান ফিরিয়ে দেওয়া অন্তত সেই বুভুক্ষু সময়ে খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু হাবিলদার কবি কাজী নজরুল টের পেয়েছিলেন তাঁর কর্মযজ্ঞ আরও বৃহত্তর। কথিত আছে, কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটে হ্যারিসন রোডের মুখে একটা রিক্সাওয়ালাকে তিনি একদিন রাত বারোটায় গিয়ে বলেছিলেন – এ্যাই তুই তো অনেককেই নিয়ে যাস্ রিক্সায় টেনে। ঠিক আছে আজ তুই রিক্সায় বোস্ আর আমি তোকে টেনে নিয়ে যাই।
তাঁর সাহিত্যকর্মেও প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের প্রতি তাঁর অসীম ভালবাসা আর মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা। নজরুল তাঁর ধূমকেতু পত্রিকায়, কংগ্রেস স্বাধীনতা দাবি করার আগেই ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেছিলেন। সেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাও তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন। বাঙালি ঐতিহ্যের প্রধান যে দুটি ধারা হিন্দু এবং মুসলিম, তার সমান্তরাল উপস্থিতি এবং মিশ্রণ ঘটেছিল নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মে, সঙ্গীত সৃষ্টিতে এবং জীবনাচরণে, যা আর কোন কবি সাহিত্যিকের মধ্যে দেখা যায়নি। নজরুল যখন যুদ্ধ ফেরত কলকাতা শহরে এলেন, তখন তার ওপর সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছিল ভারতীয় উপমহাদেশে সেসময় আসা নতুন এক সাম্যবাদী চিন্তা-চেতনার জোয়ার। সেই চিন্তাধারার মধ্যে ছিল নিচের তলার মানুষকে আপনজন ভাবতে শেখা। সাহিত্য যে শুধু এলিট বা শিক্ষিতদের জন্যই নয়, সেটা তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন। সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা কাজী নজরুল ইসলামকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। নিচের তলার মানুষের তিনি ছিলেন খুবই নিকটজন। সেই যুগে একটা ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছিল – যেটা হল দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সমাজ বিপ্লবকে মেলানো। স্বদেশী আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিলেন তারা সমাজ বিপ্লবের কথা ভাবতেন না। কিন্তু এই বিপ্লব ছিল নজরুলের রক্তে। তিনি মনে করতেন এর পথে প্রধান বাধা সা¤প্রদায়িক সংঘাত। সেইজন্য তিনি দুর্গম গিরি কান্তার মরু গানে বলেছিলেন – হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? কান্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার। যে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন যুগের জন্ম দিয়েছিলেন বলে বলা হয়, সেই রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে আরেকটা যুগের সূচনা করেছিলেন। ওঁনার লেখার মধ্যে কখনই তিনি হিন্দু না মুসলমান তা প্রবল হয়ে দেখা দেয়নি। বাংলা ভাষায় তিনিই একমাত্র কবি যিনি সমানভাবে হিন্দু ও মুসলমানদের বিশ্বাসের কথা, তাদের জীবনাচরণের পদ্ধতির কথা, তাঁর কাব্য ও সাহিত্যের মধ্যে তুলে ধরেছিলেন। যারা সবকিছু ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইছে তাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী কবিতা – ‘বিদ্রোহী’। সবকিছু ভেঙে নতুন করে গড়ার চেতনা প্রকাশ পেয়েছিল এই রচনায়। সেই কবিতা রাতারাতি তাঁকে একেবারে কেন্দ্রে বসিয়ে দিয়েছিল। তার পরবর্তী আট দশ বছর ধরে তিনি যে সাম্যের গান গাইলেন, নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বললেন, কৃষক মজুরের দুঃখের কথা বললেন, কৃষক শ্রমিক পার্টির হয়ে কাজ করলেন – এ সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে তাঁর যে মন প্রকাশ পেল তা ছিল একেবারে আলাদা। এর মধ্যে কোন আভিজাত্য নেই। একেবারে নিচ থেকে ওঠা মানুষের গান। তাদের কথা। যারা দলিত, যারা অত্যাচারিত যাদের ভাষা ছিল না, নজরুলের কলমে তারা ভাষা খুঁজে পেল। তিনি গল্প, উপন্যাস, নাটকও রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষায় একটা নতুন প্রাণ নতুন তারুণ্য নিয়ে এসেছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন একটা নিজস্ব ভাষার, যে ভাষার মধ্যে তিনি দেশজ বাংলার সঙ্গে সফলভাবে ঘটিয়েছিলেন বহু আরবি ও ফারসি শব্দের সংমিশ্রণ। নজরুলের এই ‘কাব্য-আমপারা’ হোক বা ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হাফিজের ‘দিউয়ান’, ওমর খৈয়ামের তিয়াত্তরটি রুবাইয়ৎ অনুবাদ কতটুকু পঠিত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছেই। অথচ, ‘আমি যার নূপুরের ছন্দ, বেণুকার সুর/ কে সেই সুন্দর কে!’ বা ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন/ খুঁজি তারে আমি আপনায়’ – এই সব গানে তাঁর উপর সুফি আত্মদর্শনের প্রভাব স্পষ্ট। ভক্তহৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা ও আর্তি ধরা পড়ে এইসব গানের মধ্যে।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন নিপীড়িত মানবতার কবি। সারা জীবন তিনি সমাজের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কলম ধরেছেন। তিনি নির্ভীক চিত্তে কুসংস্কার,ধর্মান্ধতা ও কূপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার রচনা অব্যাহত রেখেছেন। থেকেছেন আপসহীন। লোভখ্যাতির মোহের কাছে মাথা নত করেননি। কারা নির্যাতনেও বিচ্যুত হননি লালিত আদর্শ থেকে। অন্যদিকে তিনি মানুষের হৃদয়ের কোমল অনুভূতির প্রতিও সমান আবেগে সাড়া দিয়েছেন।
নজরুল গবেষক, নজরুল শিল্পী, নজরুল চর্চা,নজরুল অনুশীলন, অনুধ্যান শুধু মাত্র কি আমি’র জন্য। আমি’কে কেন আমরাতে উপনীত করতে সক্ষম হলাম না। আমার হওয়াই কি মুখ্য। আমাদের কেন নয়। লোক কল্যাণে নজরুলকে পৌঁছে দিতে, সাধারণকে ঋদ্ধ সমৃদ্ধ করতে আমি কি ব্যর্থ নই!আমি মানি,লালন পালন করি শুধু মাত্র নিজের জন্য। সাধারণের জন্য নয়। এখনো এমন লোক আছে যেখানে নজরুল অপরিচিত।এত সময় গড়িয়ে গেল নজরুলকে আমরা সাধারণে ব্যাপ্ত করতে ব্যর্থ। কতিপয় নিয়ত নজরুল আওড়াচ্ছে, উদ্ধৃতি দিচ্ছে শুধু মাত্র নিজের পান্ডিত্য প্রকাশ ও প্রচারের নিমিত্ত। আমি যদি নজরুলকে হৃদয়ে ধারণ করে সাধারণে নজরুলের বিস্তরণ ঘটাতে না পারি আমার হওয়াটা তো ব্যর্থ। পারিপার্শ্বিক বাঁচা বাড়ায় যদি আমি মনোযোগী না হই,কাজ না করি তাহলে আমার হওয়াটা তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়বে। হারিয়ে যাব সাধারণের পবিত্র মানসলোক থেকে। কতটুকুই ভাবি! কোথায় আমার মানব জন্মের সার্থকতা তা কেন ভাবনায় আসে না।
নাস্তিক বা আস্তিক আসলে কি? ধর্ম বা কি? কোন্ ধর্ম পালন করছি। তা কি মানব কল্যানের। সাধারণের সমৃদ্ধায়নে কতটুকুই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নজরুল কি হোঁচট খাচ্ছে না। নজরুলের কৃঙ্খলমুক্তির গান আমাদের প্রাণে ঝংকৃত করে তার তরঙ্গ সাধারণে আলোড়িত করতে আমরা কতটুকু সচেষ্ট! কখন আমি মানুষ মান-হুঁশ হয়ে উঠব। সেই ধারায় আমার চলনা কি আদৌ আছে। মানবিক হয়ে উঠি। নজরুল প্রেমে মাতোয়ারা হই নিজের হওয়ার জন্য যেমন তেমনি সাধারণকে গড়ে তুলতে, টেনে তুলতে। আমি মানুষ এবং শুদ্ধ মান-হুঁশ এই হোক আমার পরিচয়। নজরুলকে সাধারণে পরিপোষন, পরিপালন, পরিবেশনায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হই। আলোকিত হই, আলোকিত করার মানসে। সমস্বরে গেয়ে উঠি-বল বীর, বল উন্নত মম শির।