চিরন্তন শুভ কামনার দিন : অক্ষয় তৃতীয়া

1

জোনাকী দত্ত

এই বছর ৩০ এপ্রিল বুধবার শুভ অক্ষয় তৃতীয়া। ‘অক্ষয়’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ যার ‘ক্ষয় বা বিকার নেই।’ সংস্কৃত ভাষায় অক্ষয় শব্দটি অবিনশ্বর, ক্ষয় নাই যার, সমৃদ্ধি, প্রত্যাশা, আনন্দ, সাফল্য। ‘ত্রিত্য’ এবং তৃতীয়া অর্থ ‘চাঁদের তৃতীয় দিন’। হিন্দু পঞ্জিকা মতে বৈশাখ মাসের ‘তৃতীয় চন্দ্র দিন’ এর নামানুসারে অক্ষয় তৃতীয়ার নামকরণ করা হয়।
সনাতন সভ্যতায় বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন অক্ষয় তৃতীয়া। এই দিনে যা কিছু করা হয় তা অক্ষয় হয়ে থাকে বলে মানুষের বিশ্বাস। কিন্তু কেন এই দিনটি এত তাৎপর্যপূর্ণ, তা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের মতামত। ঐতিহাসিক এই দিনে ঘটেছিল একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর সেই কারণেই এই দিনটি এত গুরুত্বপূর্ণ। ঐদিনে যদি সোমবার আর রোহিণী নক্ষত্র হয় তবে দিনটি হয়ে উঠে আরো গুরুত্বপূর্ণ।
অক্ষয় তৃতীয়া হলো হিন্দু পঞ্জিকার বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি। এটি হিন্দু ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তিথি। এই শুভদিনে বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম জন্ম নিয়েছিলেন, এজন্য এই দিনটি পরশুরাম জয়ন্তী হিসেবেও পালন করা হয়।
এই দিনই মহর্ষি বেদব্যাসের মুখনিঃসৃত বাণী শ্রী গণেশ মহাভারত আকারে লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন। কঠোর তপস্যার মাধ্যমে গঙ্গাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিলেন রাজা ভগীরথ এই শুভ দিনে।
অক্ষয় তৃতীয়াতেই হিমালয়ের কোলে ছয় মাস বন্ধ থাকার পর চার ধামের অর্থাৎ কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রীর দরজা খোলা হয়। আর দরজা খুলে দেখা যায় ছ’মাস আগে যে অক্ষয়দ্বীপ জ্বালিয়ে রেখে আসা হয়েছিলো তা তখনও জ্বলছে।
অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই কুবেরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অসীম ধন ও ঐশ্বর্য প্রদান করেন। এই কারণে এই দিন বৈভবলক্ষীর পুজো হয়। এই দিন কিছু করলে তা অক্ষয় থাকে বলে মনে করা হয়।
এই দিনেই ত্রেতা যুগ শেষ হয়ে দ্বাপর যুগের শুরু হয়েছিলো।
অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই হস্তিনাপুরের রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করেছিলেন দুঃশাসন। দ্রৌপদীর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে অদৃশ্য হয়ে রাজসভায় প্রবেশ করে তাঁকে অনন্তবস্ত্র প্রদান করেন শ্রীকৃষ্ণ।
এই তৃতীয়াতেই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হয় বাল্যসখা সুদামার। এক মুঠো চালের বিনিময়ে সুদামার সব দুঃখ-কষ্ট মোচন করেন শ্রীকৃষ্ণ।
কথিত আছে যে, অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই সূর্যদেব পান্ডবদের বনবাসের সময় অক্ষয় পাত্র দান করেন। একথালা অন্ন দ্রৌপদীর আহার গ্রহণের আগে পর্যন্ত যতজন উপস্থিত থাকতো তাদেরকে খাওয়ানো যেত।
এই দিনেই দেবী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব হয়েছিলো। এই অক্ষয় তৃতীয়ায় পুরীতে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার রথ নির্মাণ শুরু হয়। তাই এই রথ অক্ষয়। এই দিনে কোন কাজ শুরু করলে তা চিরস্থায়ী হয় বলে মনে করা হয়। এই তিথিতে লক্ষী দেবী ও শ্রী গণেশের পুজা করা হয়।
এই দিনে দোকানে দোকানে হাল খাতা খোলার রীতি আছে। শাস্ত্র মতে, শুভ প্রদানকারী একটি তিথি হলো অক্ষয় তৃতীয়া। মনে করা হয় এই শুভ তিথিতে রত্ন বা জিনিসপত্র কিনলে গৃহে শুভ হয়। সুখ শান্তি, সমৃদ্ধি হবে এই আশায় অনেকেই এই দিনে স্বর্ণ, রৌপ্যের গয়না বা যে কোন জিনিস কিনে থাকে।
অক্ষয় তৃতীয়া শ্রীশ্রী রাম ঠাকুরের জীবনে বিশেষ তাৎপর্যময় দিন। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় সমাজ জীবনে কুসংস্কার, ব্রিটিশ রাজশক্তির সৃষ্টি করা ভেদ নীতি ও দাঙ্গার বিরুদ্ধে শুধু আধ্যাত্মিক চেতনায় মানুষকে বলীয়ান করাই নয়, সমাজ সংস্কারের এক সার্থক রূপকার ছিলেন রাম ঠাকুর।
১৮৬০ সালের ২ ফেব্রæয়ারি রোহিনী নক্ষত্র মকরী দশমী তিথিতে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলার ডিঙ্গামানিক গ্রামে শ্রী রাধামাধব চক্রবর্তী ও শ্রীমতি কমলাদেবীর সন্তান হিসাবে শ্রীশ্রী রামঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন।
অক্ষয় তৃতীয়ায় শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর মাতৃজঠরে আসেন। এই তৃতীয়ায় ঠাকুরের উপনয়ন হয়। আবার এই অক্ষয় তৃতীয়ায় ঠাকুর গুরুদেব অনঙ্গ দেবের কাছ থেকে দীক্ষিত হন। ১৯৪৯ সালের ১ মে রবিবার শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য লগ্নে চৌমুহনীতে অগণিত ভক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে ৯০ বছর বয়সে শ্রীশ্রী রামঠাকুর পরলোকে যাত্রা করেন।
নোয়াখালীর চৌমূহনীতে অক্ষয় তৃতীয়াতে ঠাকুরের সমাধিস্থল খোলা হয় এবং ভোর চারটার সময় ডাব দিয়ে ধুয়েমুছে পূজা শুরু হয়। আগের দিন অধিবাস করার জন্য মেয়েরা কলসি ভরে পানি আনে। সেই পানি ডাবের পানি, ঘৃত, মধু ইত্যাদি অনেকরকম জিনিস দিয়ে ঠাকুরের পূজা করা হয়।
তারপর ভক্তদের জন্য সমাধিস্থল খুলে দেওয়া হয় ডাবের পানি দিয়ে স্নান করানোর জন্য। অক্ষয় তৃতীয়ায় এই প্রথাই অদ্যাবধি চলে আসছে।
রাম ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত ড. যতীন্দ্রমোহন দাশগুপ্ত’কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
“সমুদ্রেরও একটা কূল আছে, কিন্তু তোমার ঠাকুরের কোনও ক‚লকিনারা নেই।”
অক্ষয় তৃতীয়া তিথি পরম তাৎপর্যপূর্ণ ও মহিমাময়। অক্ষয় তৃতীয়া হলো চিরন্তন শুভ কামনার দিন। এই তিথিতে যা শুভকর্ম করা হয়, তার ফল অক্ষয়, পুণ্যদায়িনী। যা জ্ঞান আহরণ করা হয়, তা অক্ষয় প্রভাব ফেলে। দানের ফলও অক্ষয় হয়। এই তিথিতে যদি ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় অথবা অজ্ঞাতে যদি কোন পাপকর্ম করা হয় তবে সেটাও অক্ষয় পাপ হয়ে কর্মফলের খাতায় লেখা থাকে। তাই সর্তক থাকাই ভালো। ঐদিন কোন খারাপ কাজে লিপ্ত না হয়ে ঈশ্বরের সেবা, মানুষের কল্যাণ চিন্তা ও সৎকর্ম করা উচিত।
বিশ্বের সকল প্রাণীর মঙ্গল হোক। হিংসা, অহংকার, হানাহানি, ভুল বোঝাবুঝি সব দূর হয়ে সবার জীবনে শান্তি আসুক, অক্ষয় তৃতীয়ায় এই শুভ কামনা করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক