কাউছার আলম, পটিয়া
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে সবর্ত্র প্রশংসার বাক্য ছড়ালেও এখন যেন এই ‘ভালো ও মানসম্মত’ স্বাস্থ্যসেবা স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এখন শুধুই কাগজে কলমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিষয়টি থাকলেও চিকিৎসক সংকট, ওষুধের ঘাটতি এবং প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় পুরো উপজেলা জুড়ে স্বাস্থ্যসেবা কার্যত ভেঙে পড়েছে। চিকিৎসক, জনবল ও ওষুধ সংকটে জর্জরিত উপজেলার মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাপনা চরম সংকটের মুখে পড়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ এর আওতাধীন ১৭টি ইউনিয়নের ৪৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ৬টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ১৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসক, জনবল এবং ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
জানা যায়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা ছাড়াও আশেপাশের উপজেলাগুলো থেকে রোগীরা এ হাসপাতালে আসেন চিকিৎসা সেবা নিতে। এ উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পটিয়া হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল হলেও সেখানে শূণ্য রয়েছে চিকিৎসকের বেশ কয়েকটি পদ। নেই গাইনী, শিশু রোগ ও এনেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ। মেডিকেল অফিসার আছেন ১৯ জন।
দীর্ঘ দিন ধরে পদগুলো শূন্য থাকায় রোগীরা পাচ্ছে না প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা। অনেক রোগী বাধ্য হয়ে ফিরে গিয়ে জেলায় গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালের ৯ জন কনসালটেন্টের স্থানে ৩টি পদ শূন্য রয়েছে। এতে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন উপজেলার লাখো মানুষ।এদিকে, এ উপজেলার মানুষকে উন্নত সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীতকরণের জন্য কয়েক বছর আগে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আজ অবধি কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। ১৯৯২ সালের দিকে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটি ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এছাড়াও পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নাইট গার্ড, ওয়ার্ডবয়, আয়া, বাবুর্চিসহ আরো বিভিন্ন বিভাগে লোকবল সংকট দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও ল্যাবে ৩ জনের পদে আছেন মাত্র ১ জন! ল্যাব সহকারী নেই দীর্ঘ দিন ধরে। মেডিকেল টেকনো ডেন্টাল পদটিও দীর্ঘ দিন ধরে শূণ্য। ফলে সেবা বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। স্বাস্থ্য সহকারী পদের ৬টিই শূণ্য। স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদের ৪টিতে লোক নেই বেশ কয়েক বছর ধরে।
পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পটিয়া হাসপাতালটি ৫০ শয্যার হলেও এখানে গড়ে প্রতিদিন ৭০-৮০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। বছরের পর বছর ধরে ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে ১০০ শয্যার হাসপাতালের মতো চালানো হচ্ছে। জরুরি বিভাগে, ল্যাব, এক্স-রে, বাবুর্চিসহ এসব বিভাগে জনবল সংকট। গুরুত্বপূর্ণ ল্যাবে তিনটি পদের বিপরীতে লোক আছে মাত্র একজন, এক্স-রে বিভাগের দুইজন লোক থাকলেও তাদেরকে সপ্তাহে তিন দিন করে পার্শ্ববর্তী আনোয়ারা এবং বোয়ালখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেপুটেশনে ডিউটি করতে পাঠানো হয়। এছাড়াও মেডিকেল টেকনো ডেন্টাল ও ল্যাব সহকারী নেই দীর্ঘ বছরের পর বছর ধরে। পাশাপাশি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অভাবে হাসপাতালের স্বাভাবিক কাজে বিঘ্ন ঘটছে।
হাসপাতালের পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন পরিবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের ১৫টি পদের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার আছেন মাত্র ৩ জন। তারা সপ্তাহের ছয়দিন রুটিন করে অন্য কেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। এসব ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ২ জন করে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা, ১ জন এমএলএসএস, ১ জন আয়া ও নিরাপত্তা প্রহরীর পদ থাকলেও নেই বছরের পর বছর ধরে। ১৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা আছেন ৬ জন! কোনো কেন্দ্রে নেই কোনো ধরনের ওষুধ, নেই নারীদের ইমপ্লান্টও। উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কেন্দ্রের মধ্যে ছনহরা, আশিয়া, শোভনদন্ডী, খরনা, কচুয়াই ও জিরি- এসব কেন্দ্রগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে বছরের পর বছর ধরে। এছাড়া নতুন ভবনের কাজ চলমান রয়েছে জঙ্গলখাইন, কোলাগাঁও, বড়লিয়া ও হাইদগাঁও ইউনিয়নে।
হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ যেমন মেডিসিন, শিশু, গাইনি, এনেসথেসিয়া ইত্যাদি বিভাগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদ শূন্য রয়েছে। মেডিকেল অফিসার, নার্স, ফার্মাসিস্ট এবং অন্যান্য সহায়ক কর্মচারীর ঘাটতিও প্রকট। এছাড়া, প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় রোগীদের বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য হতে হচ্ছে যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।
গত বৃহস্পতিবার পটিয়া হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা মনছুর বলেন, হাসপাতালে এসে আমি টিকিট নেয়ার পর যে রুমে পাঠিয়েছে সেখানে গিয়ে দেখি ডাক্তার নেই। পরে কাউন্টারে গিয়ে বলার পর তারা আমাকে জানান ডাক্তার রবিবারে আসবে। ছোটখাটো রোগের জন্যও বেসরকারি হাসাপাতালে যেতে হয়। এতে আমাদের মতো গরিব মানুষের খরচ বেড়ে যায়।
ইউনিয়ন পর্যায়ে সংকট আরও তীব্র
পটিয়ার ১৭টি ইউনিয়নে রয়েছে ৪৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ৬টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ১৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। এ সব স্থানে নেই প্রশিক্ষিত জনবল, নেই ওষুধ। অনেক ক্লিনিক সপ্তাহের অর্ধেক সময় বন্ধ থাকে, আবার কোনোটিতে স্বাস্থ্য সহকারী এসে শুধু ¯িøপ লিখে চলে যান।
পটিয়া উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নের ৪৯টি ক্লিনিক, ৬টি উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ১৫টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রেও একই ধরনের সমস্যা বিদ্যমান। এসব কেন্দ্রে চিকিৎসকের উপস্থিতি নগণ্য এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ওষুধের অভাবে সেবা প্রদান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে চিকিৎসা সেবা ব্যাবস্হা ভেঙে পড়েছে। একজন কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের এখানে মাঝেমধ্যে ডাক্তার আসেন কিন্তু নিয়মিত নয়। ওষুধ নেই দীর্ঘ দিন ধরে রোগীদের বেশিরভাগ সময় খালি হাতে ফিরে যেতে হয়।
স্থানীয়দের ক্ষোভ ও দাবি
স্থানীয় বাসিন্দারা এই সংকটের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন। তারা অভিযোগ করেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো সত্তে¡ও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পটিয়ার মতো বড় একটি উপজেলায় এমন স্বাস্থ্যসেবার দুরবস্থা অগ্রহণযোগ্য। আমরা চাই অবিলম্বে চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ, ওষুধ সরবরাহ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আবু তৈয়ব বলেন, জনবল সংকটের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তবে, নতুন নিয়োগ ও ওষুধ সরবরাহের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আমরা সীমিত সংস্থান নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।
স্বাস্থ্য সেবা সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই অব্যবস্থাপনার দায় শুধু চিকিৎসক সংকট নয়, বরং এটি একটি কাঠামোগত দুর্বলতা। ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে কার্যকর করতে হলে লোকবল এবং ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে। পটিয়ার স্বাস্থ্যসেবার এই সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ, নিয়মিত ওষুধ সরবরাহ এবং অকেজোঁ যন্ত্রপাতি মেরামত বা নতুন যন্ত্রপাতি সরবরাহের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। এছাড়া, স্থানীয় ক্লিনিক ও উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ এবং নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বর্তমানে একটি সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সচেতনতা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় এই উপজেলার ৫ লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।