ড. মো. রফিকুল ইসলাম
বাংলাদেশ একটি নিম্ন আয়ের দেশ। এদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ তাদের সামান্য আয় দিয়ে কোনোভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার পরিচালনা করছে। অন্যদিকে আমাদের দেশে ধনী ব্যক্তিদের হার খুব বেশি নয়। আর যারা ধনী হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই একশ্রেণি সুবিধাভোগী। এদের মধ্যে অনেক সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে। অর্থাৎ সহায়-সম্পত্তি আত্নসাৎ করেই ধনী হয়েছে। এ রকম চিত্র বাংলাদেশে বহু দৃশ্যমান। বিশেষ করে বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ তাদের চাহিদার পণ্যটি কিন্তু ক্রয় করতে পারছে না। অর্থাৎ আয়ের সাথে ব্যয়ের সমতা রাখতে পারছে না। এর ফলে পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অবস্থা তো বেহাল-দশা। এছাড়া সরকারি হাসপাতালের বেশিরভাগ চিকিৎসকরা সময় নিয়ে যত্নসহকার রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসা সেবা করছে না। অর্থাৎ বেশিরভাগ সময়ই চিকিৎসকরা হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকছে কারণে ও অকারণে।
বিশেষ করে চিকিৎসা সেবা হলো একটি সেবামূলক ও মহতী পেশা। এ পেশায় কর্মরত কিছু সংখ্যক চিকিৎসকের কারণে সমাজ আজ কুলষিত হচ্ছে। বিশেষত সরকারি হাসপাতালে নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা মিলছে না বিধায় সাধারণ মানুষ এ চিকিৎসা সেবা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। ইদানিং কালে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের হার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে সাধারণ মানুষ বেশি বিড়ম্বনায় পড়ছে। তবে প্রাইভেটভাবে চিকিৎসা নেওয়া হয়তো অনেকের সামর্থ নাও থাকতে পারে। আবার কেউর সামর্থ থাকলেও যদি চিকিৎসকরা ন্যায্য ভিজিট টুকু নিতেন। সেক্ষেত্রে হয়তো অনেক সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রাইভেটভাবে চিকিৎসা নেয়াও সহজ হতো। আমাদের দেশে চিকিৎসকরা সাধারণত একজন রোগীকে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ মিনিটি চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক চিকিৎসক রয়েছে। যারা ৫ মিনিটি সময় তো দূরের কথা রোগীদের কী সমস্যা সে বিষয়ে শোনার পূর্বে রোগ নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার প্রেসক্রাইব করে থাকে। অর্থাৎ রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার চেয়েও বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহ। যা তাদের নির্বাচিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা করতে বলা হয়। অন্যদিকে রোগী চিকিৎসককে রোগের বিষয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন করলে সন্তোষজনক উত্তর না দিয়ে রোগীদের সাথে খারাপ আচরণ করছে। এ ধরনের ভুক্তভোগী আমি নিজেও। এছাড়া চিকিৎসকের চেম্বারে রোগী থাকতেই অন্য রোগী এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এ যেন এক আজব দেশের আজব খেলা। এ রকম অরাজকতা অন্য কোনো দেশে আছে কী না, আমজনতার জানা নাই। বিশেষ করে আমাদের দেশে শতকরা ৯৫ জন চিকিৎসকই ২/৩ মিনিটি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। আর এ ২/৩ মিনিট সময়ের জন্য চিকিৎসকদের ১০০০ টাকা কিংবা ১৪০০ টাকা ভিজিট নিয়ে থাকে। আবার কোনো কোনো চিকিৎসক এর চেয়েও বেশি ভিজিট নিয়ে থাকে। অন্যদিকে ভারতে ৫০০ রুপির বেশি ভিজিট কোনো চিকিৎসককে দিতে হয় না। এর কারণ সরকার সেখানে চিকিৎসকদের ভিজিটের বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো সরকারের আমলেই এদিকে নজর দেয়নি। আর সর্বোচ্চ ভিজিট কত হবে আর সর্বনি¤œ ভিজিট কত হবে। সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালাও নেই। সে সুবাধে চিকিৎসকরাও নিজেদের মতো করে ভিজিট নির্ধারণ করছে। এর ফলে চিকিৎসকরা মানুষের সেবার নামে বেপরোয়াভাবে অতিরিক্ত ভিজিট নিচ্ছে। এদিকে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০-৬০ জন করে রোগীর চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে অনেকে অবশ্য এর চেয়ে আরও বেশি রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার নজির রয়েছে। এ সেবা সকাল ও বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চিকিৎসকের চেম্বারের বাইরে সিরিয়াল দিয়ে রোগীরা অপেক্ষা করছে। এ সকল চিকিৎসকের কাছে থেকে জাতি কী আশা করবে। এছাড়াও কর্মস্থলেই বা কতটুকু সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে। এ বিষয়ে সুশীল সমাজ জানতে চায়। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, রোগীদের ভিজিট ছাড়াও বিভিন্ন ল্যাবরেটরি-প্যাথলজি-ওষুধ কোম্পানি ও হাসপাতালসহ নানা উৎস থেকে অবৈধ অর্থ আসছে বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়। কোথায় আমাদের বিবেক? কোথায় আমাদের মানবতার কল্যাণে শিক্ষার প্রয়োগ? চিকিৎসকরা টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেক সময় তাদের নীতি-নৈতিকতার কিছুই আর অবশিষ্ট থাকছে না। বিশেষ করে চিকিৎসকদের এ সকল অনৈতিক প্রবণতা বন্ধ করা না গেলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় সেবাব্রত বা মানবিকতা বলে কিছুই আর থাকবে না। ফলে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কোনো ফি বা ভিজিট নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে কোনো আইন ও নীতিমালা বা গাইডলাইন কোনোটাই নেই। তবে চিকিৎসকদের ভিজিট নির্ধারণে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এর ফলে রোগীরা কেবল হয়রানির শিকারই হচ্ছে না বরং চিকিৎসা করতে এসে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এতে কিন্তু সরকার কোনোভাবে দায় এড়াতে পারবে না। কারণ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করারই সরকারের একমাত্র দায়িত্ব।
উল্লেখ্য যে, চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসার কারণে কত মানুষের অকালে প্রাণনাশ হয়েছে। এর কোনো হিসাব নেই। এছাড়া চিকিৎসকরা রোগীদের প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে গাদাগাদা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করার জন্য নির্দেশ করছে। এক্ষেত্রে যদি চিকিৎসককেই নিজের অর্থায়নে রোগীদের পরীক্ষাগুলো করে দেয়ার নিয়ম-নীতি থাকতো। সেক্ষেত্রে হয়তো এমনটি আর হতো না। বিশেষত আবার নি¤œমানের কোম্পানির ওষুধ প্রিসক্রাইব করছে। যা বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যম থেকে জানা যায়। এর জন্য তাদের কোনো ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি আজ অবধি হয়নি। তবুও সাধারণ মানুষ নিরুপায় হয়ে সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে চিকিৎসা নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ন্যায্য ভিজিট দিয়ে সাধারণ রোগীদের কী প্রাইভেটভাবে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অধিকারটুকু নেই। অন্যদিকে দেশের বাইরে চিকিৎসকরা আমাদের মতো এত ভিজিট দিতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে এর সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ আমাদের দেশের মতো ভিজিট নিয়ে চিকিৎসকদের এমন বেপরোয়া বাণিজ্য পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। এতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর যেন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে। এর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এভাবে একই রোগের চিকিৎসার জন্য একেক চিকিৎসক একেক রকম ভিজিট নেয়ার কারণে মানুষের হয়রানির আর সীমা থাকে না। তাই চিকিৎসকদের ভিজিট ও কমিশন নিয়ে যে প্রকাশ্য বাণিজ্য চলছে তা নিয়ন্ত্রণ করা অতি জরুরি। এর সাথে অন্যান্য পেশাজীবীদের ক্ষেত্রেও ফি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। সেই সাথে চিকিৎসকদের আচরণের পরিবর্তন আনা জরুরি। আমাদের তরুণ সমাজ আজ জেগে উঠেছে। কখন যে কার চেম্বারে কড়া নাড়বে। কিন্তু কেউ তা জানে না। এখন নিজেকে সংশোধনের সময় এসেছে। তাই যৌগিকভাবে সকল শ্রেণি মানুষের সামর্থ অনুযায়ী কাজের বিনিময় অনুযায়ী ন্যূনতম সম্মানী দেয়া বা নেয়া উচিত। এ জন্য সরকার প্রয়োজনে সকল স্টেকহোল্ডারের সাথে আলোপ-আলোচনার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর চিকিৎসকরা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও কমিশনসহ অতিরিক্ত ওষুধ যেন আর প্রিসক্রাইব না করে। এর প্রতিকার অন্তবর্তীকালীন সরকারকেই নিতে হবে। যতদূর জানা যায় যে, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের জন্য প্রস্তাবিত নতুন একটি আইনের খসড়ায় চিকিৎসকদের ভিজিট নির্ধারণে কাঠামো তৈরির কথা বলা হয়েছে। এতে নতুন আইন হলে চিকিৎসকদের ভিজিট নিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির অবদান হতে পারে।
সর্বোপরি, সরকারি হাসপাতাল, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কর্মরত চিকিৎসকদের জন্য প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ভিজিট যথাক্রমে অধ্যাপক ৬০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপক ৫০০ টাকা, সহকারী অধ্যাপক ৪০০ টাকা ও প্রভাষকদের ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ ভিজিটের বিষয়ে কমিশন গঠন করা জরুরি। এতে করে দেশ তথা জাতি উপকৃত হবে।
লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি