চাচা খালেক এবং ফটিকছড়ির বাদশাহ আলম

1

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

অতীতে আওয়ামী লীগে এমন কিছু নেতা-কর্মী ছিলেন, যাঁরা পাগলের মতো আওয়ামী লীগকে ভালোবাসতেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কিছু বুঝতেন না। তাঁদের সামনে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মন্দ কথা বলে পার পাওয়ার কোন জো ছিলো না। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কাউকে কটু কথা বলতে শুনতে তাঁরা তার কলার চেপে ধরতেন বা গলা টিপে ধরতেন। এরাই ছিলেন আওয়ামী লীগের সম্পদ। ৭৩ বছরের ইতিহাসে (২০২৫-১৯৪৯=৭৬) আওয়ামী লীগের ওপর দুর্যোগ, ঝড়-ঝাপটা কম যায়নি। বরং বৈরি সময়ই বেশি মোকাবেলা করতে হয়েছে এ দলকে। আওয়ামী লীগ পাগল যে লোকদের কথা আমরা আলোচনা করছি, তারা কিন্তু বিপদের দিনেও আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেননি, আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। এমনি এক আওয়ামী লীগ পাগল মানুষ ছিলেন এমএ খালেক। এই নামে কেউ তাঁকে চিনতো না। তিনি ‘চাচা খালেক’ নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে এম এ আজিজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলে তিনি সেই যে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন, আর কখনো আওয়ামী লীগ ছাড়েননি, আওয়ামী লিগার হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ও এম এ আজিজের পরম ভক্ত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের জন্য জেল-জুমুলও কম সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। স্বাধীনতার পূর্বে একবার এবং পঁচাত্তরের পরে একবার তিনি কারাবরণ করেন।
তিনি এমএ আজিজের নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদিঘি ময়দানে ৬ দফার প্রথম জনসভার মঞ্চ নির্মাণের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সঙ্গে হালিশহরের হাজি এজাহার মিয়াও (মাইক এজাহার) ছিলেন।
১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাবে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর বর পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বিবাহোত্তর সংবর্ধনা আয়োজনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছিলেন।
পিডিএম-এর ৬ দফা বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে এম এ আজিজের সঙ্গে ঢাকা গিয়ে চাচা খালেক আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। চাচা খালেকের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সভাস্থল ঘিরে রাখেন এবং মাঝে মাঝে ৬ দফার পক্ষে ¯েøাগান দিয়ে ৬ দফার বিরুদ্ধাচরণকারীদের মনোবল ভেঙ্গে দেন।
বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনের নির্ধারিত তারিখে আজিজ মিয়ার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম থেকে চাচা খালেকসহ সহস্রাধিক নেতাকর্মী কাউন্সিলে যান। মূলত ঐ কাউন্সিলে এম এ আজিজই আগাগোড়া বলিষ্ঠ বক্তব্য দিয়ে মাতিয়ে রাখেন, ৬ দফার বিরুদ্ধে কেউ বক্তব্য রাখার সুযোগই পাননি। দু’একজন বক্তব্য রাখার চেষ্টা করলেও কাউন্সিলর-ডেলিগেটদের প্রবল বাধার মুখে কারো পক্ষে ৬ দফার বিরোধিতা করা সম্ভব হয়নি।
খুলনার শেখ আবদুল আজিজ ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল হক সমঝোতার প্রস্তাব দিলে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের সোচ্চার প্রতিবাদে তাও নাকচ হয়ে যায়। ঐ সময় ১৩ জন ৬ দফার বিরুদ্ধবাদী নেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা আমেনা বেগম ও এম. এ. আজিজকে নিয়ে ডিসিপ্লিনারি কমিটি গঠন করা হয়। পরদিন ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় এম এ আজিজের বীরোচিত ভূমিকাকে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় চট্টগ্রামের এম এ আজিজকে ‘Saviour of 6 points’ হিসেবে মন্তব্য করা হয়। ঐ সময় ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান, সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সহযোগী ভূমিকা পালন করে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে বিরাট বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন। সেদিন ষড়যন্ত্রকারীরা যদি সফল হতেন তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত’।
চাচা খালেক পটিয়া থানার শোভনদন্ডী ইউনিয়নের রশিদাবাদ গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পুত্র এস এম দিদারুল আলম আওয়ামী রাজনীতির পরিমন্ডলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার কারণে পরিবারে আওয়ামী রাজনীতির হাওয়া বিরাজ করতো। পরিবার থেকেই দিদার রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করেন এবং বর্ধিত হন রাজনীতির আবহে।
স্কুলে গমনের পর তিনি ছাত্রলীগের সদস্য হন এবং ক্রমান্বয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে করতে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য, সরকারী কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও
সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
লেখাপড়া শেষে দিদার জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসায় বৃত্তি অবলম্বন করেন। ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে তিনি পটিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। শপথ গ্রহণ কালে তিনি পটিয়া উপজেলাকে একটি সমৃদ্ধ, আধুনিক, স্মার্ট, পরিবেশবান্ধব, শিল্পোন্নত ও সারাদেশের মধ্যে মডেল উপজেলায় রূপান্তরে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেন। শহরের সঙ্গে পটিয়া উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো তাই তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বেশকিছূ সেক্টরে কাজ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তিনি।

বাদশাহ আলম : বাদশাহ আলমকে ফটিকছড়ি থানার আওয়ামী রাজনীতির বাদশা বললেও অত্যুক্তি হয় না। ষাটের দশকে ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগ গড়ে উঠে। বাদশাহ আলম ফটিকছড়ি সদরের মানুষ, ফটিকছড়ি সদরে তাঁর বাসস্থান এবং ব্যবসা কেন্দ্র ছিলো। বাদশাহ আলমের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সেখানে। ফটিকছড়ির কেন্দ্রস্থলে তাঁর পৈত্রিক বাসভবন হওয়ায় বাদশা আলম আওয়ামী লীগের ভিত্তিপ্রস্তর গাড়তে সহায়তা করেন। ফটিকছড়ি সদরের একজন মানুষ পাওয়া না গেলে সেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা দলীয় রাজনীতি চালু করতে সাহস পেতেন না। সেকারণে আমি বাদশা আলমকে ফটিকছড়ি আওয়ামী রাজনীতির বাদশাহ বলে আখ্যায়িত করলাম। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগের অফিসার করার জন্য জায়গাও দেন তিনি।
ফটিকছড়ি থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা সংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজ-মঙ্গল-কর্মী, শিক্ষাব্রতী ইত্যাদি নানা পরিচয়ে ফটিকছড়ির একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন বাদশা আলম। তাঁকে থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক না বলে প্রতিষ্ঠাতা বললেও ভুল হতো না। একটি তথ্য অনুযায়ী ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে বাদশা আলম ফটিকছড়ি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে বছর তিনি বিএ-ও পাস করেন। আবার এরকম তথ্যও পাচ্ছি যে, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ফটিকছড়ি থানা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়, যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন বাদশাহ আলম।
ষাটের দশকে রোসাংগিরি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছালেহ আহমদ চৌধুরী মহানগর আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনিই একদিন বাদশাহ আলমকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (পরবর্তীকালে সভাপতি) জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে নিয়ে যান। পরে এমএ আজিজ তাঁকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের ১২০ আন্দরকিল্লা অফিসে ডেকে নিয়ে যান। এমএ আজিজ বাদশাহ আলমকে ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগ গঠন করার প্রস্তাব দেন। বাদশাহ আলম তাঁর প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেন। ফটিকছড়ির প্রথম কমিটিতে তাঁকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। এটাই হয়তো ৬৩’র কমিটি।
বাদশাহ আলম মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নাজিরহাটে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের প্রধান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অপরাধে পাক হানাদার বাহিনী তাঁর গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড, দশ হাজার টাকা জরিমানা, দশটি বেত্রাঘাত ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে।
উত্তর চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধে পরিচালিত হয় তাঁরই নেতৃত্বে নাজিরহাট বাজার থেকে। যুদ্ধ পরিচালনা, প্রশাসনিক কার্যক্রম, আশ্রয় শিবির খোলা, হাসপাতাল ও জেলাখানা স্থাপন, মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ, তীরন্দাজ বাহিনী গঠন, ভারতের সাথে যোগাযোগ, অস্ত্র সংগ্রহ ও নেতানেত্রীদের আশ্রয় প্রদান এবং তাদেরকে ভারতে পৌঁছানোসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন সংগ্রাম কমিটির অনেক নেতানেত্রী এমনকি জিয়াউর রহমানও তাঁর দলবলসহ নাজিরহাট অবস্থান নিয়ে পরে রামগড় যান।
যুদ্ধকালীন উত্তর চট্টগ্রামের সর্বশেষ প্রতিরোধ ঘাঁটি হিসেবে সংগ্রাম কমিটির পরিচালনায় নাজিরহাট ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। ফটিকছড়ির পতন হয় ১৮ এপ্রিল। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর ৮ মার্চ ফটিকছড়িতে সর্বপ্রথম নাজিরহাটে বাদশা আলমের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির প্রধান কাজ ছিল যুদ্ধরত ইপিআর, পুলিশ ও আনসারদের জন্যে খাদ্য সরবরাহ করা এবং স্থানীয় লোকদের বিশেষ করে উঠতি যুবকদের ট্রেনিং দেওয়া। নাজিরহাট কলেজ মাঠে আনসার কমান্ডার আবদুস সাত্তার ও সোবহান মোল্লার বাড়ির ফ্লাইট সার্জেন্ট দবির আহমদকে দিয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। নাজিরহাটে বাদশা আলমের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটিতে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ছালেহ আহমদ চৌধুরী, আবা মিঞা মাস্টার, মনির আহমদ ফরেস্টার, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সোলায়মান, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, আতর রহমান, মোহাম্মদ ইউনুছ, আনোয়ারুল আজিম, এস এম ফারুক, আকতার কামাল, হাফেজ আহমেদ বি কম, আমিনুল হক, মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী, মোহাম্মদ ইউনুছ, জমির আহমদ চৌধুরী, মোহাম্মদ ইলিয়াছ মানিক মিয়া, আবদুল হালিম ও গোলাম মওলা।
১৭ এপ্রিল আওয়ামী লীগ নেতা এম এ ওহাব নাজিরহাট আসেন। এদিন তাদের সিদ্ধান্ত হয় নাজিরহাট এলএসডি গোডাউন হতে সমস্ত চাল-গম রামগড়ে নিয়ে যাওয়ার। কথামতো ১৯ তারিখ সকালে ৫০টা গরুর গাড়ি ঠিক করা হয়। ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় তারা রামগড় ডাক বাংলো প্রাঙ্গণে পৌছান। তাদের দলে তারা আঠারোজন ছিলেন।
বাদশাহ আলম ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অক্টোবর ফটিকছড়ি থানার দৌলতপুর ইউনিয়নের পূর্ব ফরহাদাবাদ গ্রামে গোল মোহাম্মদ তালুকদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মফজল আহমদ সওদাগর, মাতা ফুল মেহের খাতুন। ছেলেবেলায় তিনি নাজিরহাট আহমদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে নাজিরহাট কলেজিয়েট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। সে বছরই নাজিরহাট কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু। নাজিরহাট কলেজে পড়তে গিয়ে ১৯৫৭-৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘ইউএসপি’ নামে এক ছাত্র সংগঠনের যুক্ত হন। এটি আওয়ামী সমর্থিত সংগঠন। নাজিরহাট কলেজে বছর খানিক তিনি ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। তখন থেকে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও একে ফজলুল হক (শেরে বাংলা)’র প্রতি অনুরক্ত হন। আতাউর রহমান খান কায়সার, অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী, শহীদ মুরীদুল আলম, নাজিরহাট কলেজের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ মাহফুজুর হক চৌধুরীসহ তাঁরা নাজিরহাট কলেজে এক সঙ্গে পড়েছেন।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সহকর্মীদের সহায়তায় ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে উত্তর চট্টগ্রামে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন এবং সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
স্বাধীনতা-পূর্বকালে তিনি তৎকালীন চট্টগ্রাম মহকুমা (উত্তর) আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা উত্তরকালেও উক্ত পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা ফটিকছড়ি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মনোনীত হন। আমৃত্যু তিনি উত্তর চট্টলার আওয়ামী লীগের রাজনীতির অন্যতম কাÐারি ছিলেন।
ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বাদশা আলমকে গ্রেফতার করা হয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁকে জেলখানায় ডিভিশন দেওয়া হয়। তিন মাস কারাগারে থাকার পর তিনি মুক্তি পান।
একজন বিশিষ্ট রাজনীতিক ও সমাজকর্মী হিসেবে এম বাদশা আলম শুধু নিজ উপজেলা নয় সমগ্র চট্টগ্রামে সুপরিচিত ছিলেন। সমাজসেবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি দৌলতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি তৎকালীন দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রীর চাচাকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। উল্লেখ্য, এ ফলাফল সরকার ও প্রভাবশালী মহল সহজে গ্রহণ করেনি। ফলে তাঁর ফলাফল দুবার স্থগিত করা হয়। তিনি ছিলেন একজন সফল চেয়ারম্যান। তিনি উত্তর চট্টগ্রামের নারীশিক্ষার অন্যতম অগ্রদূত হিসেবে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহ্যবাহী নাজিরহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। আমৃত্যু বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী নাজিরহাট কলেজ এবং নারায়ণহাট কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘকাল সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং প্রতিষ্ঠান দুটির উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা রাখেন। তিনি দৌলতপুর এবিসি উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন।
তিনি নাজিরহাট জনকল্যাণ সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পরপর কয়েকবার এই সমিতির জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। নাজিরহাট মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি হিসেবে অনেক বছর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নাজিরহাট বাজার কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় তিনি নাজিরহাট আহমদিয়া আলিয়া মাদ্রাসার পরিচালনা পরিষদের জয়েন্ট সেক্রেটারি, নাছিরুল ইসলাম বড় মাদ্রাসার উপদেষ্টা কমিটির সদস্য, নাজিরহাট কলেজ ওল্ড বয়েজ এসোসিয়েশনের আহŸায়ক, নাজিরহাট নাইট স্কুলের সভাপতি, ফটিকছড়ি রিকশাচালক সমিতির উপদেষ্টা কমিটির সদস্য, ফটিকছড়ি অটোওনার্স সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি নাজিরহাট স্বাধীনতা উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান এবং বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের (২০০৮) এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে হাটহাজারীর ধলই ইউনিয়নের বিশিষ্ট ব্যক্তি মরহুম মফিজুর রহমানের বড় মেয়ে সরোয়ার জাহানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি দুই কন্যা এবং চার পুত্র সন্তানের জনক। পুত্র-কন্যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
২০১১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে সোমবার দিবাগত রাত ১টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই মহান নেতার জীবনাবসান হয়।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা