চসিক নির্বাচন ঘিরে সক্রিয় সন্ত্রাসীরা

60

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনকে ঘিরে সক্রিয় হয়েছে পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা। কেউ কেউ হয়েছেন নিজেই প্রার্থী। আবার কেউ কেউ প্রার্থীর পক্ষে নেমেছেন নির্বাচনী প্রচারণায়। নির্বাচনী মাঠে তাদের আনাগোনার কারণে নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আইনশৃঙ্খলা অবনতির আশঙ্কা দিনদিন বাড়ছে। অধিকাংশ ওয়ার্ডে রয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। মূলত বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষেই নেমেছেন এসব সন্ত্রাসীরা।
পুলিশ ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে চলা এসব সন্ত্রাসীদের নির্বাচনী মাঠে নামার খবরে গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর থেকে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অস্ত্র প্রদর্শন ও ফাঁকা গুলি ছোড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মামলাও দায়ের হয়েছে এসব সংঘর্ষের ঘটনায়। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীর প্রচারণায় কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন।
যেসব এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা
গত ১৪ মার্চ ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান মুরাদ এবং তার ছেলে আদনান সামির গুরুতর আহত হন। দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর লোকজনের সঙ্গে এ সংঘর্ষ হয়।
এর আগে ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় নগরের বারিক বিল্ডিং এলাকায় ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর ও বিদ্রোহী প্রার্থী আব্দুল কাদেরের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
১২ মার্চ ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ডে পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আব্দুস সবুর লিটন ও বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর এস এম এরশাদ উল্লাহর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
১১ মার্চ চান্দগাঁওয়ে গণসংযোগকালে মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিমের সামনেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাইফুদ্দিন খালেদের অনুসারীদের ওপর হামলা চালায় বিদ্রোহী প্রার্থী ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী এসরারুর হক এসরালের অনুসারীরা।
২৮ ফেব্রূয়ারি রাতে ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নুরুল আমিন ও বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান কাউন্সিলর সাবের আহমেদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। খবর বাংলানিউজের
মাঠে সক্রিয় যারা
প্রার্থীদের মধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর তৌফিক আহমদ চৌধুরী। তিনি ২০১৬ সালের ৫ মে হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের সরকারহাট বাজারে যুবলীগকর্মী নূর এলাহী হত্যা মামলার আসামি। তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে।
২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর সাহেদ ইকবাল বাবু আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে এলাকায় সন্ত্রাসে পৃষ্ঠপোষকতা ও মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী এসরারুর হক ওরফে এসরাল মাঠে সক্রিয় রয়েছে। তার অনুসারী অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা সক্রিয় রয়েছে। এসরারুর হক ওরফে এসরাল একটি অস্ত্র মামলায় সতের বছর সাজাসহ একাধিক মামলার আসামি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি, চাঁদাবাজি, হত্যাসহ কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে এসরারের বিরুদ্ধে। র‌্যাবের শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিলেন তিনি।
গতবছর শমসের পাড়ায় চাঁদা না দেওয়ায় ড্রিল মেশিনে যুবকের দুই পা ছিদ্র করে দেওয়ার পর আলোচনায় উঠে আসে ভয়ংকর এসরালের নাম। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর নির্বাচনের অজুহাতে এলাকায় ফিরে উত্তাপ ছড়াচ্ছেন তিনি।
৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর জহুরুল আলম ওরফে জসিমের বিরুদ্ধে কিশোর অপরাধী চক্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে। এলাকায় পাহাড় কাটাসহ জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে। এমন ঘটনায় করা মামলার আসামি তিনি। আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন তিনি।
১০ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন যুবলীগ নেতা পরিচয় দেওয়া মনোয়ার উল আলম চৌধুরী নোবেল। মনোয়ার উল আলম চৌধুরী নোবেল সিআরবি জোড়া খুন মামলার অন্যতম আসামি। তিনি র‌্যাবের শুদ্ধি অভিযানে দেশত্যাগ করা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অন্যতম সহযোগী।
১২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর সাবের আহম্মদ আওয়ামী লীগের সমর্থন পাননি। তিনিও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। গত বছর ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মহিউদ্দিন সোহেল হত্যা মামলার প্রধান আসামি। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাননি তিনি।
১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আবুল হাসনাত বেলালের বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং পরিচালনার অভিযোগ আছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলেজ ছাত্র দিদার হত্যার প্রধান আসামি ছিলেন। পরে অভিযোগপত্র থেকে বাদ যায় তার নাম। ওই হত্যা মামলায় ১৪ কিশোর জড়িত থাকার তথ্য পায় পুলিশ। যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৭। বেশির ভাগ বস্তির বাসিন্দা। পুলিশের প্রস্তত করা কিশোর গ্যাং পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় নাম রয়েছে বেলালের। এ ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী এ এফ কবির আহমদ মানিকের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ।
২৮ নম্বর ওয়ার্ডে আবদুল কাদের গত নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন অনুগত সন্ত্রাসী ও বাহুবল ব্যবহার করে। বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য এবার তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তিনি। অন্তত ৮টি হত্যাসহ এক ডজন মামলার আসামি ছিলেন তিনি। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় চাঁদাবাজি, এলাকায় সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
৩০ নম্বর পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন জহির উদ্দিন মো. বাবর। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। স্টেশন কলোনির মাদক আখড়ার নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে ও হত্যা চেষ্টার একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
নির্বাচনকে ঘিরে প্রকাশ্যে আসা দাগি সন্ত্রাসীদের মধ্যে রয়েছে বায়েজিদের আব্দুল কুদ্দুছ ওরফে কানা কুদ্দুছ ও শফি, পুলিশের তালিকাভুক্ত অস্ত্র ব্যবসায়ী ও চান্দগাঁও, বহদ্দারহাট এলাকার ত্রাস মঈন উদ্দিন ওরফে মহিউদ্দিন ফরহাদ, কায়সার হামিদ। আগ্রাবাদ এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত খোরশেদের ছোট ভাই রাশেদ, সদরঘাট এলাকায় পরিবহন ব্যবসায়ী হারুন হত্যা মামলার প্রধান আসামি কিলার আলমগীর ও তার সহযোগী এসএস রাসেল। আতুরার ডিপো এলাকায় গিয়াস ওরফে মাইকেল গিয়াস, মুরাদপুর এলাকায় হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি ফিরোজ ওরফে ডাকাত ফিরোজ, চকবাজার এলাকায় কিশোর গ্যাং লিডার সাদ্দাম হোসেন ওরফে ইভান। এরা ছাড়াও নগরের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয় হয়েছে একাধিক সন্ত্রাসী।
র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল বলেন, নিয়মিত অভিযানের কারনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীরা অনেকে গা ঢাকা দিয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেকে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয় হয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। র‌্যাবের নিয়মিত অভিযান চলবে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, সন্ত্রাসীরা পার পাওয়ার সুযোগ নেই। কোনো প্রার্থী বা তার সমর্থকরা সংঘাতে জড়ালে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিও গ্রেপ্তার হয়েছে।