চসিকের ‘মান্ধাতা আমলের’ পদ্ধতিতে মরছে না মশা

34

মশা এখন আতঙ্কের নাম। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ম্যালেরিয়ার মতো নানা রোগের বাহক হচ্ছে মশা। যন্ত্রণাদায়ক মশা থেকে মুক্তি পেতে ওষুধ প্রয়োগ করে আসছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এতে মশা তো মরছেই না উল্টো দিনদিন উপদ্রব বাড়ছেই। ফলে মশার ওষুধের কার্যকারিতা ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অন্যান্য কীটের মত মশাও নির্ধারিত সময় পর পর জীনগত ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে। ফলে একই ধরনের ওষুধ দীর্ঘদিন প্রয়োগ করলে কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যাবে না। তাই মশা নিয়ে জরিপ করে নিধনের কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় মশার উপদ্রব কমবে না বলে মনে কনে কীটতত্ত¡বিদরা।
মশা মারতে চসিক গত এক দশক ধরেই একই ধরনের ওষুধ একইভাবে প্রয়োগ করে আসছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্ম্মা জানান, আমি চাকরিতে যোগদান করি ১৯৮৯ সালে। এর আগে থেকেও ফগার মেশিনে ওষুধ দিয়ে মশক নিধন করা হতো। এখনও সেই একই পদ্ধতিতে মশা মারছে সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া প্রচলিত ওষুধ ছিটানোর পরিবর্তে মশারোধী উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহারও হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। সেক্ষেত্রে দেশেও এসব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তাব উঠছে।
জানা গেছে, যখন কোনো উদ্যোগে ঠিকমতো কাজ হয় না, তখন জেনেটিক পদ্ধতিতে বিশেষ প্রকৌশলে তৈরি কিলার মশা মাঠে নামানো হয়। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানটাকিভিত্তিক বায়োটেক কোম্পানি ‘মসকিউটোমেট’ এক ধরনের কিলার মশা উৎপাদন করেছে। তাদের প্রকল্পে পুরুষ মশাকে মশা মারার কীটনাশকবাহী হিসেবে তৈরি করা হয়। এসব মশা যখন নারী মশার সঙ্গে মিলিত হয়, তখন মশার ডিম ফোটে না। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৮ সালে এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া আরও একটি জনপ্রিয় প্রযুক্তি হলো ড্রোন ডাম্পিং। রোবট নির্মাতা কোম্পানি উইরোবোটিকস মশা মারতে ড্রোন ডাম্পিং পদ্ধতি আবিষ্কার করে। তাদের মতে, জীবাণুমুক্ত মশা ড্রোনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট মশাযুক্ত এলাকায় ছাড়া হবে। এতে পুরুষ মশার সংখ্যা কমিয়ে মশার প্রজনন ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে ফেলা সম্ভব হবে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
চট্টগ্রাম জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদৌস পূর্বদেশকে বলেন, প্রতিটি কীট নির্দিষ্ট সময় পর পর জীনগত ও আচরণগত বৈশিষ্ট পরিবর্তন করে। সেক্ষেত্রে মশাও করে। তাই মশা মারতে হলে মশাকে নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করলে মশা সেই ওষুধে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাই প্রতি পাঁচ বছর পর পর মশার জীনগত ও আচরণগত বৈশিষ্ট নিয়ে ‘স্টাডি’ করতে হয়। তারপর কৌশল নির্ধারণ করতে হয় কোন ওষুধে কাক্সিক্ষত মাত্রায় মশা মারা যাবে। তিনি আরও বলেন, ওষুধে যেমন পরিবর্তন আনতে হয় তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো মশার ওষুধ কিভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে তা দেখা। একটি নালায় একবার মশার ওষুধ প্রয়োগ করার এক সপ্তাহ পর আবারও ওষুধ দিতে হবে। অন্যথায় মশা মরবে না। তাই মশার ওষুধ ঠিক থাকলেও প্রয়োগ পদ্ধতি ঠিক না থাকলে মশা মরবে না।
এনতেজার ফেরদৌস বলেন, সরকারের কীটতত্ত¡ বিভাগ থেকে প্রতিবছর মশা নিয়ে ‘স্টাডি’ করা হয়। যেখানে মশার সব ধরনের আচরণ বৈশিষ্ট্য ও করণীয় উল্লেখ থাকে। সেগুলো জাতীয়ভাবে সিটি করপোরেশনে জমা দেওয়া হয়। সেদিকে নজর দিলে মশার ওষুধ নিয়ে প্রশ্ন উঠার কথা না বলে মন্তব্য করেন এ কীটতত্ত¡বিদ।
উল্লেখ্য, গত সোমবার থেকে সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় যৌথভাবে মশা জরিপ করছে। চার সদস্যের টিম প্রতিদিন একেকটি এলাকায় গিয়ে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে জানা গেছে। চসিক যেভাবে মশক নিধন করে : মশক নিধনে সিটি করপোরেশন এডালটিসাইড ও লার্ভিসাইড দুই ধরনের ওষুধ ছিটাচ্ছে। ফগার মেশিনের সাহায্যে এডালটিসাইড ওষুধ ধোঁয়া তৈরি করে। এতে মশা মারা পড়ে। অন্যদিকে পানি মিশিয়ে ছিটানো হয় লার্ভিসাইড। এটি মশার নিধন করে। অন্যদিকে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না থাকলেও কালো তেল ব্যবহার করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।
জনবলের বিষয়ে জানা যায়, মেয়রের বিশেষ মশক নিধন ‘পোগ্রাম’ এ ২০ জনের একটি দল থাকে। তারা মূলত নগরীর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাসা বাড়ির আশপাশে ওষুধ ছিটান। অন্যদিকে প্রতিটি ওয়ার্ডে চারজন করে দায়িত্বে থাকেন। তারা শুধুমাত্র মশার মৌসুমে ওষুধ ছিটানোর কাজ করেন। অন্যদিকে ৪১টি ওয়ার্ডে ৭০টির মত ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটানোর কাজ করা হয়। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ওষুধ প্রয়োগ ব্যবস্থাপনায় চরম ঘাটতি রয়েছে। প্রতি সাতদিন অন্তর একই জায়গায় ওষুধ ছিটানোর নিয়ম থাকলেও চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগ তা করে না। এ ছাড়া বছরব্যাপী মশার প্রজনন ধ্বংস করতে কোনো ধরনের কর্মসূচি থাকে না। মশার মৌসুম আসলে কেবলই লোকদেখানো কর্মসূচিতে দায় সারে পরিচ্ছন্ন বিভাগ।
এদিকে চসিকের উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদ আলম পূর্বদেশকে জানান, মেয়রের নির্দেশে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। আমাদের একটি টিম ঢাকা থেকে ঘুরে এসেছে। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মশা নিধন করা হবে। তবে যন্ত্রপাতি ও জনবলের সংকটের কথা জানান এ কর্মকর্তা।