চসিকের কাছে বাণিজ্যিক স্বার্থই বড়!

74

বেশিদিন আগের কথা নয়। ১৯৯২ সালেও সার্কিট হাউস সংলগ্ন বড় জায়গাটি ছিল খোলা সবুজ চত্বর। সাধারণ মানুষ সেখানে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারতো। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশের প্রথম বিজয়মেলার সূচনা হয়ে ছিলো এই চট্টগ্রামে। মেলার সবচেয়ে প্রাণবন্ত অনুষ্ঠান ছিলো বীর যোদ্ধাদের স্বকন্ঠে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা । ব্যাপক জনপ্রিয় সেই স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠান চলেও ছিল বছর তিনেক। কিন্তু তৎকালীন সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় সার্কিট হাউস সংলগ্ন উন্মুক্ত স্থানটি শিশুপার্ক হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিছু নিম্নমানের রাইড নিয়ে এখনো চালু আছে পার্কটি। ২৫ বছরের জন্য বরাদ্দ পাওয়া সেই কাজীর দেউড়ি শিশু পার্কের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ (২৭ নভেম্বর)। তবে শেষ হয়েও হলো না শেষ। পরিবেশবাদী, নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ও শিক্ষাবিদদের আপত্তি তোয়াক্কা না করে এখন আবারও ১৫ বছরের জন্য বরাদ্দ নবায়ন করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
ছেলেবেলার কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, ‘এই জায়গাটি চট্টগ্রাম নগরের ফুসফুস। স্টেডিয়াম পাড়ায় মানুষের জটলা থাকে। এই জটলা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ এই স্থানে জড়ো হতে পারতো। কিন্তু পার্ক নগরবাসীর সেই সুযোগ রুদ্ধ করে দিয়েছে।’
সেই খোলা চত্বরের পাশের সুরম্য ভবন নির্মাণের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, ‘১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর কলকাতায় বসতেন বড় লাট সাহেব। আর বড় ও ছোটো লাট সাহেবের ঢাকায় থাকার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল কার্জন হল। কিন্তু সেই লাট সাহেব ঢাকায় আসেননি ফলে পরবর্তীতে তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। অপরদিকে ছোটো লাট সাহেব চট্টগ্রামে বেড়াতে এলে থাকার জন্য এখানে আরেকটি ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ছোটো লাট সাহেব নিয়োগও হননি এবং তিনি আসেনও নি। আর চট্টগ্রামের ভবনটি প্রথম গভর্নর হাউস, পরে সার্কিট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। বর্তমানে তা জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নান্দনিক এই ভবনের সৌন্দর্য যাতে রাস্তা থেকে দেখা যায় সেজন্য ভবনের সামনের জায়গা খালি রাখা হয়েছিল।
প্রফেসর আবদুল মান্নানের বক্তব্যের সূত্র ধরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ব্রিটিশরা যতো ভবন নির্মাণ করতো তাদের প্রায় প্রত্যেকটি ভবনের সামনের অংশ উন্মুক্ত ছিল। এই ভবনের সামনের অংশের খালি জায়গাটিও ভবনের অংশ। এতে সড়ক থেকে ভবনের স্থাপত্য সৌন্দর্য্য দেখা যায়।
কিন্তু এই স্থানটি সম্পর্কে সিডিএ’র ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) কি নির্দেশনা রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালে ড্যাপ প্রকাশিত হয়। এই স্থানটি যেহেতু এর আগ থেকে পার্ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে তাই ড্যাপে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে পার্কটি এখান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে। এই স্থানটি উন্মুক্ত রাখার কথা বলা হয়েছে এবং তা সিভিক স্কয়ার হিসেবে রাখার প্রস্তাবনা রয়েছে। আমরাও চাই এখান থেকে পার্কটি সরে যাক এবং তা সবুজায়ন হিসেবে উন্মুক্ত থাকুক।’
এই পার্কটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত পুরাতন সার্কিট হাউসের ভবনের অংশ উল্লেখ করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বলেন, এই খালি জায়গায় মুুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ মঞ্চ করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন বিএনপি নেতা মীর নাছির। তিনি এই স্মৃতিচারণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করতে খালি জায়গাটিকে পার্কের জন্য বরাদ্দ দিয়ে দেন। এতে চট্টগ্রামের উন্মুক্ত স্থানটি রুদ্ধ হয়ে যায়। এখন যেহেতু সুযোগ এসেছে তাই এই জায়গাটিকে উন্মুক্ত করে দেয়া হউক এবং শিশুপার্ক করার জন্য শহরের অনেক এলাকায় খালি জায়গা রয়েছে সেখানে নির্মাণ করা যেতে পারে।
কখন থেকে তা পার্ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে?
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামে ১৯৮৯ সালে। সেই বছর থেকেই তৎকালীন সার্কিট হাউসের (বর্তমানে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর) সামনের অংশের এই খালি জায়গায় মুুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে প্রফেসর আবদুল মান্নান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা বানচাল করতে তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মীর নাছির তা পার্ক হিসেবে বরাদ্দ দেন। আর মীর নাছিরের এই বরাদ্দ প্রক্রিয়ার পার্ক হিসেবে উদ্বোধন হয় ১৯৯৪ সালে ২৮ নভেম্বর। সেই সাথে উন্মুক্ত স্থানটি কতগুলো ইট-স্টিলের কাঠামোর কাছে বন্দি হয়ে পড়ে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন যদি ২৫ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে থাকে তাহলে তা আর নবায়ন না করাই শ্রেয়। উন্মুক্ত স্থান হিসেবে তা বজায় থাকুক।’
একই মন্তব্য করেন বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিনা হোসেন। তিনি বলেন, এখানে অনেক মানুষের জনসমাগম হয়। একদিকে স্টেডিয়াম, সার্কিট হাউস, র‌্যাডিসন ব্লুসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে তখন শিশুরা ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। এছাড়া অনেক সময় সড়ক বন্ধ করা হয়, এতেও শিশুরা বাধার সম্মুখীন হয়ে থাকে। তাই এই স্থানটি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত রাখা হোক।
তবে শুধু উন্মুক্ত বা সবুজায়ন নয়, সংরক্ষিত সবুজায়ন হিসেবে এই জায়গাটিকে রাখা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ খালি জায়গা দেখলেই দখল করতে চায়। তাই সার্কিট হাউসের পাশের এই জায়গাটি সংরক্ষিত সবুজ স্পেস (প্রোটেকটেড গ্রিন স্পেস) হিসেবে রাখা যেতে পারে। একইসাথে যাতে এর অপব্যবহার যাতে না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’
সিটি করপোরেশনের এস্টেট বিভাগের বক্তব্য
১৯৯৪ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে প্রতিমাসে ৭৫ হাজার টাকার বিনিময়ে তা ‘ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৫ বছরের জন্য লিজ দেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। আগামী ২৭ নভেম্বর (বুধবার) এর মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এস্টেট অফিসার এখলাছ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা এখন ১৫ বছর মেয়াদে আগের বরাদ্দ গ্রহীতা ভায়া মিডিয়া বিজনেস সার্ভিসেসের লাইসেন্স নবায়ন করেছি। এখন প্রতিমাসে তারা সিটি করপোরেশনকে দেড় লাখ টাকা করে দেবে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর টাকার হার নতুন করে নির্ধারণ করা হবে।’
কিন্তু এই জায়গাটি পার্ক হিসেবে কেন বরাদ্দ দিচ্ছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ১৯৯২ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মালিকানাধীন প্রায় তিন একর আয়তনের এই জায়গাটি সিটি করপোরেশনকে বরাদ্দ দেয়া হয় পার্ক করার জন্য। তাই পার্ক ছাড়া অন্য কোনো কাজে তা ব্যবহার করা যাবে না।
বরাদ্দ গ্রহীতার বক্তব্য
২৫ বছর ধরে এই পার্কটি পরিচালনা করছেন ভায়া মিডিয়া সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি নিজেকে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে শিশুপার্কের পথপ্রদর্শক উল্লেখ করে বলেন, ‘সারাদেশে আমার ১১টি শিশুপার্ক রয়েছে। দেশের প্রথম শিশুপার্ক গড়ে তুলি ঢাকার শ্যামলিতে যা শিশুমেলা ও পরে ওয়ান্ডারল্যান্ড নাম ধারণ করে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ও কাজীর দেউড়ি শিশুপার্ক দুটি আমার। পরে আগ্রাবাদের পার্কটি ছেড়ে দিতে হয়।’
কিন্তু কাজীর দেউড়িতে যে স্থানে শিশুপার্কটি রয়েছে, সেই স্থানটি উন্মুক্ত ও সবুজায়ন রাখার প্রস্তাবনা রয়েছে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিদের। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি পার্কের চারপাশে গাছ লাগিয়ে নিজে সবুজায়ন করেছি। আর আমার জায়গাটি উন্মুক্ত রয়েছে। তবে মোদ্দাকথা হলো-এই জায়গাটি শিশুদের জন্য কেন থাকবে? এজন্যই স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদরা বিরোধিতা করছেন।’
তবে আপনি কি মনে করছেন না, শিশুপার্কের জন্য এই জায়গাটি খুব কম? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘হুম, জায়গা খুব কম। এই কম জায়গার মধ্যে আমরা এখন আধুনিক কিছু রাইড, হরর হাউস, হলোগ্রাম প্রজেকশান, নাইনডি সিনেমা ও অ্যাকুরিয়াম রেস্টুরেন্ট চালু করবো। তবে আরো বড় পরিসরে করলে ভালো হতো, কিন্তু জায়গার স্বল্পতা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ৭০ লাখ জনসংখ্যার এই শহরে বড় কোনো পার্ক নেই। শিশুদের বিনোদনের জন্য পৃথক স্পেস প্রয়োজন। বর্তমানে নগরে কিছু ছোটো ছোটো পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।