নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
রাজনীতিতে যখন তাঁর প্রয়োজন ছিলো বেশি, তখনই তিনি চলে গেলেন। সাহস করে সত্য কথা বলার মানুষ আর রইলেন না পটিয়া তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। যেমন তিনি প্রবল প্রতিপক্ষের সম্মুখীন হয়েও বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেন এবং নির্ভয়ে তাঁর কথা বলতে দ্বিধা করতেন না। আমি কার কথা বলছি, এতক্ষণে হয়তো আপনারা বুঝে গেছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামে এমন দুঃসাহসী, বেপরোয়া স্বভাবের মানুষ সুলতান ভাইয়ের (সুলতান উল কবির চৌধুরী, তিনি তো গোটা চট্টগ্রামেই দুর্জয় সাহসের অধিকারী অদ্বিতীয় ছাত্রনেতা ছিলেন।) পরে যিনি টগবগে যৌবন নিয়ে পটিয়ার ছাত্র রাজনীতিতে দৃপ্ত পদক্ষেপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের দুর্দিনের দুঃসাহসী নেতা, সৎ, ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ, আপসহীন অকুতোভয় সংগ্রামী মুজিব সৈনিক, সহজ, সরল, স্পষ্টভাষী এবং পরিচ্ছন্ন সংগঠক এমএ জাফর। জটিল ও দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন গৃহবাসী হয়ে কষ্টকর প্রায় পঙ্গু জীবন যাপন করছিলেন। রোগের সাথে যুদ্ধ করে অনেকদিন টিকেছিলেন, আর পারলেন না, হার মেনে ২৩ জুন শেষ নিঃশ্বাসটা ফেলে চলে গেলেন এই মধুময় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ জাফর১৫ এপ্রিল ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া থানার শোভনদন্ডী ইউনিয়নের রশিদাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কবির আহমদ ও মাতা নূরজাহান বেগম। পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে এমএ জাফর চতুর্থ। তৃতীয় ভ্রাতা আবু তাহের সওদাগর শোভনদন্ডী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁরা একটি ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্য ছিলেন। কে সি দে রোডে ‘কলেজ সু স্টোর’ নামে তাঁদের একটি বিখ্যাত জুতার দোকান ছিলো। পরে নিউ মার্কেটেও তিনি ব্যবসা করেন। তিনি ইলেক্টলিক্স পণ্য সামগ্রীর ব্যবসায়ও হাত দিয়েছিলেন। ঢাকা নিউ মার্কেটেও তাঁর দোকান ছিলো। কিন্তু অস্থিরচিত্ততার জন্য কোন ব্যবসাতেই শেষ পর্যন্ত মনস্থির করে স্থায়ী হতে পারেননি। শেষদিকে জুবিলী রোডে দিপু-মালেকের অফিসে বসে ট্রেডিং করতেন।
এম এ জাফর ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে মোজাফ্ফরাবাদ হাইস্কুল থেকে মানবিক বিভাগে এস,এস,সি পাস করে ১৯৬৮খ্রিস্টাব্দে পটিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭০খ্রিস্টাব্দে পটিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিএ পাস করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করে ছাত্রলীগ একটি আন্দোলন শুরু করেছিলো, কলেজের অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ মজুমদার সে দাবি মানতে অস্বীকার করে ছাত্রলীগ নেতা চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ, শামসুদ্দিন আহমদ, এমএ জাফর, এ কে এম আবদুল মতিন চৌধুরী, নুরুল আফসার চৌধুরী ও মনোজ হাজারী -এই ছয়জন ছাত্রনেতাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। ৭০-এর নির্বাচনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী সফরে পটিয়া এসেছিলেন। পটিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত জনসভায় ভাষণ দানকালে তিনি পটিয়া থেকে ফিরে যাওয়ার পূর্বেই ছয় ছাত্রনেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য অধ্যক্ষকে আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। অধ্যক্ষ অবিলম্বে ছাত্রদের বহিষ্কারাদেশ তুলে নিয়েছিলেন।
এমএ জাফর স্কুলজীবন থেকে ছাত্র রাজনীতি আরম্ভ করেন। ৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত হয়ে পড়েছিলো। এই সময় পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে জনমানসে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছিলো। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রæয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ৬ দফার ভিত্তিতে আবর্তিত হতে থাকে। ছাত্র-জনতার মধ্যে ৬ দফা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ৬ দফার ভিত্তিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই সময় পটিয়ায় ছাত্র সমাজের মধ্যে ছাত্রলীগের রাজনীতি ও সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য ছাত্রলীগ নেতা চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদ স্কুলে স্কুলে গিয়ে যোগাযোগ আরম্ভ করেন। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যারা আগ্রহ প্রকাশ করেন, তাদেরকে সদস্য এবং তাদেরকে দিয়ে কমিটি গঠন করেন। সিনিয়র ছাত্রলীগ নেতা শহীদ মুরিদুল আলম ও আবুল কালাম আজাদের বাড়ি পটিয়া হলেও তাঁরা শহরে ছাত্রলীগ করতেন, গ্রামে যেতেন না। চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদই প্রথম পটিয়ায় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক কার্যক্রমের আওতায় তিনি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময় মোজাফফরাবাদ হাইস্কুলে ছাত্রলীগের শাখা করার জন্য যান। তাঁকে দেখে নবম শ্রেণির ছাত্র এমএ জাফর এগিয়ে আসেন এবং ছাত্রলীগের সদস্য হন। সে বছরই স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হলে তাঁকে সহ-সম্পাদকনির্বাচিত করা হয়।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এম এ জাফর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বরকলে শাহজাহান ইসলামাবাদী একটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ গঠন করে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করলে জাফর সেই গ্রæপে যোগদান করে বিভিন্ন গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শহীদ সার্জেন্ট আলম ছিলেন তাঁর কমান্ডার।
৭১-এর জুনে আমি ভারত থেকে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং ও অস্ত্র নিয়ে দেশে প্রবেশ করে তৎকালীন পটিয়ার বরকলে শাহজাহান ইসলামাবাদীর সেল্টারে যাওয়ার জন্য কর্ণফুলী পার হয়ে জ্যৈষ্ঠপুরা সেনবাড়ির সেল্টারে এক রাত কাটিয়ে বোয়ালখালী ও পটিয়ার পূর্ব প্রান্তস্থিত একটি ছোট রাস্তা ধরে পটিয়া প্রবেশ করে আমাদের গ্রæপের কমান্ডার শহীদ নুরুর আনোয়ার আমাদেরকে রশিদাবাদে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে এম এ জাফরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমাদের গ্রুপটা ছিলো দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুজিববাহিনীর (বিএলএফ) প্রথম গ্রæপ। আমরা ছয়জন ছিলাম। তখন এম এ জাফরের সঙ্গে যেসম্পর্ক হয়, সেটি মুক্তিযুদ্ধের পরেও, এমন কি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অটুট ছিলো।
স্বাধীনতার পর জাফর ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া থানা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উপর ধরপাকড়, অত্যাচার-নির্যাতনের স্টীম রোলার নেমে আসে। যারা বাইরে ছিলেন, তাদের বাড়ি-ঘরে থাকাও মুস্কিল হয়ে পড়লে আত্মগোপন করতে হয়। দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছিলো। এমনি পরিস্থিতিতে টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকী, চট্টগ্রামে এসএম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। গোলাম রব্বান, সুলতান উল কবির চৌধুরী, সুভাষ আচার্য্য, আনোয়ারুল আজিম, অধ্যাপক মঈনুদ্দিন, এম এ জাফর, আ ক ম শামসুজ্জামান, কাজী আবু তৈয়ব, শফিকুল আহসান, শফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইউনুস, মহসীন জাহাঙ্গীর, ফকির জামাল, আবুল মনসুর চৌধুরী, পীষুষ রক্ষিত, দীপেশ চৌধুরী, সৈয়দ আবদুল গণি, সৈয়দ মাহমুদুল হকসহ আরো অনেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন।ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে ভাটা নেমে আসে। ৭৭-এর শেষদিকে দল ক্রমান্বয়ে পুনরুজ্জীবিত হলে দক্ষিণচট্টগ্রামে যাঁরা ছাত্রলীগ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন, এম এ জাফর তাঁদের পুরোভাগে ছিলেন। ১৯৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, প্রচার সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
এম এ জাফর সত্যবাদী, স্পষ্টভাষী এবং বন্ধুবৎসল ছিলেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি যখন যা সত্য বলে জেনেছেন বা মেনেছেন, তা অকপটে প্রকাশ করতেন। কাউকে ভয় করতেন না, কারো রক্ত চক্ষুর পরোয়া করতেন না। নিজে যা ভালো বুঝতেন, দলের জন্য মঙ্গলজনক মনে করতেন, তা নিঃসংকোচে করে গেছেন। এই কারণে রাজনীতিতে তার যত উপরে উঠার কথা ছিলো, উঠতে পারেননি। পটিয়া আসন থেকে সংসদ নির্বাচন করার খুব ইচ্ছা ছিলো তাঁর, কয়েকবার মনোনয়নও চেয়েছিলেন দলের কাছে, একবার বোধহয় তাঁকে মনোনয়ন দেওয়াও হয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের টিকিট না পেয়ে তিনি আর নির্বাচন করেননি। দল ও আদর্শই তাঁর কাছে বড় ছিলো। তিনি পটিয়া তথা দক্ষিণ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একটি অমূল্য সম্পদ ছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা কত গভীর এবং আন্তরিক ছিলো, তার একটা উদাহরণ দিই। আমাদের গ্রাম হুলাইনের একটি পরিবারের ছেলের জন্য তাঁর মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছিলো। তিনি তাঁর হবু বেয়াইকে বলেছিলেন, আপনার গ্রামে আমার একজন বিশিষ্ট বন্ধু আছেন, সাংবাদিক নাসির, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করব, তিনি যদি বলেন, তাহলে আমি আপনার সঙ্গে সম্বন্ধ করব। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আবু মোহাম্মদ কেমন ? আমি বলেছিলাম খুব ভালো মানুষ। তাঁরা অত্যন্ত ভদ্র, শান্ত, অমায়িক এবং মার্জিত রুচির মানুষ। তাঁদের পরিবারের একটি সুনাম আছে। আমার কাছ থেকে গ্রীন সিগনাল পেয়ে জাফর আবু মোহাম্মদের ছেলের সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন।
এমএ জাফর মুক্তিযোদ্ধা মেজর খালেদের ভগ্নি তাহেরা খানম ছবির পাণিগ্রহণ করেন। তাঁদের এক ছেলে ও তিন মেয়ে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক