চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস

1

আহমদ ইমরানুল আজিজ

দেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় এভাবে বলা যায়, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের স্মৃতি বিজড়িত শিক্ষাঙ্গন হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত একমাত্র বাংলাদেশী। যিনি একজন অর্থনীতিবিদ হয়েও ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। যিনি চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৩৬ জুলাই এর পটপরিবর্তনের পর প্রাপ্ত দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আমাদের নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সিপাহসালার। সংস্কার, পুনর্গঠন, বিচার ও সত্যিকার জনমতের প্রতিফলনের টেকসই ব্যবস্থা প্রণয়নের প্রাণপুরুষ। সেই স্বাপ্নিক ব্যক্তিত্বের আগমনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসবের জোয়ার তৈরি হয়েছে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের মাধ্যমে পঞ্চম সমাবর্তনে অংশগ্রহণ নানা দিকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সেগুলো হলো : এ আগমন সরকার প্রধান হিসেবে নিজ জন্মস্থান চট্টগ্রামে প্রথম আগমন, দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান, বিশেষত নিজের শিক্ষকতা জীবনের স্মৃতিময় ক্যাম্পাসে আগমন, তিনি পঞ্চম সমাবর্তনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি. লিট. (ডক্টর অব লিটারেচার) ডিগ্রি গ্রহণ করবেন, পঞ্চম সমাবর্তনে ‘সমাবর্তন বক্তা’ হিসেবেও বক্তব্য রাখবেন, সর্বোপরি দেশের সর্ববৃহৎ সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করবেন ইত্যাদি। এসব বহুবিদ বৈশিষ্ট্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সমাবর্তন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জাঁকজমকপূর্ণ অ্যাকাডেমিক উৎসব। প্রতি শিক্ষাবর্ষে একবার সমাবর্তন হওয়ার কথা শিক্ষাপঞ্জিতে উল্লেখ থাকলেও এটি অধরা থেকে যায়। মূলত সমাবর্তন যেকোন সমাবর্তীর কাছে একটি বহুল প্রতীক্ষিত, বহুল প্রত্যাশিত ও লালিত স্বপ্নের বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়ার পর সবাই সমাবর্তনের অপেক্ষায় থাকে। এর মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েটরা ছাত্র জীবনের সমাপ্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে চায়। শিক্ষা জীবনের সফল সমাপ্তির পর সমাবর্তনের মাধ্যমে সনদ গ্রহণ করা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত একটি রেওয়াজ হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি স্বপ্নের বিষয়। কাগজে কলমে প্রতি শিক্ষাবর্ষে একবার সমাবর্তন হওয়ার কথা থাকলেও এটি কতটুকু বাস্তবায়ন হয় তা আমরা সবাই জানি। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চলতি বছর ৫৯ বছরে পদার্পণ করেছে। আর এই ঊনষাট বছরেই আয়োজন করতে যাচ্ছে পঞ্চম সমাবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৮ বছর পর ১৯৯৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম সমাবর্তন, ৩৩ বছর পর ১৯৯৯ সালের ১৩ মার্চ দ্বিতীয় সমাবর্তন, ৪২ বছর পর ২০০৮ সালের ৫ নভেম্বর তৃতীয় সমাবর্তন, ৫০ বছর পর ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় এবং ৫৯ বছরে এসে আয়োজন হতে যাচ্ছে পঞ্চম সমাবর্তন। চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পর প্রাপ্ত নতুন বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন আয়োজন ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। পূর্বের ৪টি সমাবর্তনে যতজন সমাবর্তী অংশ নিয়েছেন তার চেয়েও বহুগুণে বেশি সমাবর্তী এবারের পঞ্চম সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করছে। মূলত নতুন বাংলাদেশে ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আগমনে এবারের সমাবর্তন স্মরণকালের সব রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছে। এটি পঞ্চম সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারী সমাবর্তীদের জন্য অনন্য সাধারণ পাওয়া। স্বপ্নের পঞ্চম সমাবর্তন আজ সমাবর্তীদের দৌর গোড়ায়। অনেক স্বপ্ন, উচ্ছ্বাস, আবেগ ও অনুভূতি ভরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সফল সমাপ্তির স্বীকৃতি হলো এই সমাবর্তন। সমাবর্তনের এই পঞ্চম তমে আজ সমাবর্তীরা গর্বিত অংশীদার। সত্যিই এটা অংশগ্রহণকারীদের জন্য অনেক আনন্দের বিষয়, মর্যাদার বিষয়। পঞ্চম সমাবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাবর্তীরা নতুনভাবে অভিষিক্ত হবে। যাত্রা শুরু করবে নতুন প্রেরণায়, নতুন উদ্যমে, নতুন বাংলাদেশে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এবারের সমাবর্তন নানাদিক থেকে ব্যতিক্রমধর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন দেশে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর প্রাপ্ত নতুন বাংলাদেশে যেমন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তেমনি দেশের সর্ব্বোচ্চ সংখ্যক সমাবর্তীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ সমাবর্তন সাত হাজার একশত চুরানব্বই জন গ্র্যাজুয়েটের অংশগ্রহণে যেমন দেশের সবচেয়ে বড় সমাবর্তন ছিল এবারের পঞ্চম সমাবর্তনও হতে যাচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ সমাবর্তন। কারো কারো মতে দেশের সর্ববৃহৎ নয় এটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমাবর্তন। কারণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তনে যোগ দিতে ২২ হাজার ৫৯৭ জন সমাবর্তী নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তনকে গিনেজ বুকে স্থান পাওয়ার মতো বলে উল্লেখ করেছেন। নানাদিক থেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও সর্ববৃহৎ এই সমাবর্তনের অংশ হিসেবে সমাবর্তীদের গর্ববোধের ব্যাপার রয়েছে। মূলত মানব সভ্যতার বিকাশকাল হিসেবে ছাত্রজীবনের সফল সমাপ্তিতে সমাবর্তন উৎসবের মধ্য দিয়ে অভিসিক্ত হওয়া বড়ই সৌভাগ্যের ব্যাপার। শুধু সৌভাগ্যের ব্যাপার নয় বরং সম্মান ও গর্বের ব্যাপার।
এরারের পঞ্চম সমাবর্তনের অন্যতম আকর্ষণ হলো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের নিজ হাতে করা স্বাক্ষর যুক্ত মূল সনদ সমাবর্তীদের প্রদান করা হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে বলেন. ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমার একাডেমিক সন্তান। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ-ছয় বছর পড়ালেখা করে তিনি যে সনদ নেবেন সেখানে আমার নিজ হাতে করা স্বাক্ষর থাকাটা যুগপৎ শিক্ষার্থী ও আমার জন্য আনন্দের বিষয়’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনকে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সমাবর্তন আখ্যায়িত করে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাবর্তীদের বরণ করা হবে। বিশেষ করে সমাবর্তনে দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আগমন সমাবর্তীদের নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা জোগাবে।
সমাবর্তীদের হিসেবে পঞ্চম সমাবর্তনে যোগ দিতে এসে দীর্ঘদিন পর স্মৃতিময় সবুজ ক্যাম্পাসে পদচারণা সত্যিই অ্যালামাইদের উদ্বেলিত করবে, করবে উচ্ছসিত। আবেগ-উচ্ছাসে শিহরিত হবে অ্যালামাইদের দেহ-মন। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো অ্যালামাইরা যে ক্যাম্পাসে কাটিয়েছিল সে ক্যাম্পাসে পদচারণা নিশ্চয়ই তাদেরকে স্মৃতিময় করে তুলবে। ছাত্রজীবন শেষে অ্যালামাইরা যে দিনটির অপেক্ষায় ছিল সে দিনটি আজ তাদের হাতের মুঠোয়। আজ অ্যালামাইরা উপভোগ করছে স্বপ্নের দিনটিকে। নতুন প্রাণে হাওয়া লাগিয়ে আজ তারা ভাসছে স্মৃতির ক্যাম্পাসে। স্বপ্নের পঞ্চম সমাবর্তন উপলক্ষে পুরো ক্যাম্পাস আজ সেজেছে সমাবর্তন রঙে। নানা রঙে নানা ঢঙে সাজানো হয়েছে সবুজ ক্যাম্পাসকে। দেশের সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ও অ্যালামাই হিসেবে চবিয়ানরা আজ মাতিয়ে তুলছে পুরো ক্যাম্পাস। গাউন পরিধান করে, সমাবর্তন টুপি লাগিয়ে আজ সমাবর্তীরা সত্যিই গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। সমাবর্তীদেরকে ঘিরে আজ চারিদিকে সাজ সাজ রব, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত অংশ হিসেবে সমাবর্তীদের পদচারণায় মূখর আজ পাহাড় ঘেরা ক্যাম্পাস। আজ পুরো ক্যাম্পাস জাগ্রত হয়েছে অ্যালামাই ও গ্র্যাজুয়েটদের ডাকে। আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন চির জাগ্রত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন যেন উৎসবের খনি। সমাবর্তীদের আগমনে ক্যাম্পাস জুড়ে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের হাওয়া। অ্যালামাই ও সমাবর্তীদের মিলনমেলায় মূখরিত পুরো জনপদ। নানা সাজে সজ্জিত সবুজ ক্যাম্পাস। চারিদিকে উৎসবের আমেজ। পুরো ক্যাম্পাসকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে অলংকিত করা হয়েছে মনের মাধুরী মিশিয়ে। শিল্পীর তুলিতে পাহাড়ী ক্যাম্পাস আজ শৈল্পিক রূপ ধারণ করেছে। ক্যাম্পাসের আকর্ষণীয় স্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ ভবন, রাস্তা-ঘাটসহ পুরো ক্যাম্পাসে শাটিয়ে দেয়া হয়েছে রঙ-বেরঙের আলোকসজ্জা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ অনুষ্ঠান সফল, সুন্দর ও নান্দনিক করার লক্ষে সবাই আজ ব্যস্ত। আজ যেন বরণ উৎসব। আজ সমাবর্তীদের বরণে অধীর আগ্রহে বসে আছে চির সবুজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। দেশের সরকার প্রধান, আমাদের পরম সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বরণ উৎসবের মধ্যমণি। তাঁর আগমন সমাবর্তন উৎসবকে করেছে আরো আকর্ষণীয় ও মর্যাদাবান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সর্ব্বোচ্চ পদে আসীন হিসেবে তাঁকে কাছে পাওয়া আমাদের সমাবর্তীদের জন্য অনেক বড় পাওনা। যা আমাদেরকে উৎসাহিত করবে পদে পদে। অনুপ্রেরণা যোগাবে জীবনব্যাপী।
আজ আমরা যারা সমাবর্তী হিসেবে পঞ্চম সমাবর্তনের অংশীদার, নিশ্চয়ই এই সমাবর্তন আমাদেরকে প্রেরণা যোগাবে এবং আমাদেরকে গর্বিত করবে আত্নবিশ্বাস থেকে। বহুল প্রতীক্ষিত সমাবর্তনের এই মাহেন্দ্রক্ষণ আমাদেরকে উজ্জীবিত রাখবে সারাজীবন।

লেখক : কলেজ শিক্ষক ও গবেষক