‘চট্টগ্রাম বন্দর হোক ষড়যন্ত্র মুক্ত’

1

মুহাম্মদ এনামুল হক মিঠু

চট্টগ্রাম বন্দর দেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রধান লাইফলাইন। এটি বিদেশি কোম্পানিকে লিজ দেয়ার সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। বন্দর নগরী, চট্টগ্রাম বাণিজ্য নগরী, চট্টগ্রাম শিল্প নগরী এবং চট্টগ্রাম বাংলাদেশে সিংহদ্বার হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা এই যে অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে চট্টগ্রাম তার আসল সৌন্দর্য হারিয়ে শ্রীহীন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। শিল্পনগরী বা বাণিজ্য নগরী বা বন্দর নগরী যে নামে ও অলংকারে ভূষিত হোক না কেন প্রতিটি সরকার চট্টগ্রামকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখেছে। আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের কারণে চট্টগ্রাম হয়েছে তার ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত। ভৌগোলিক অবস্থান ও বন্দর সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে দিনে দিনে শিল্পগুলো হয়েছে রুগ্ন। চট্টগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহে গ্যাস সংযোগ দিতে সব সময়ে আমলাদের অনীহা লক্ষ্যণীয়। ঢাকায় শুধু গাজীপুরে যে পরিমাণ গ্যাসের ব্যবহার হয় চট্টগ্রামের কেজিডিসিএল এ তার অর্ধেক পরিমাণ গ্যাসের সরবরাহ করতে তাদের অনীহা বা ষড়যন্ত্র লক্ষ্যণীয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে আমলারা এবং বিভিন্ন সরকারের শাসনকালে চট্টগ্রামকে এক প্রকার শ্রীহীন করে রেখেছে। তবুও আমরা চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য চট্টগ্রামের ন্যায্য স্বার্থের জন্য প্রতিনিয়ত লিখেই চলেছি।
এ কথা সত্যি যে, ঐতিহ্যগতভাবে চট্টগ্রাম ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর নগরী। এই নগরীকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার অনেক অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির ৮০ শতাংশের বেশি আয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এ কারণেই চট্টগ্রামকে বলা হয় জাতীয় অর্থনীতির হৃৎপিন্ড। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও ৮০ শতাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম থেকেই।
টার্মিনালটিতে দেশের টাকায় জেটি নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর অত্যাধুনিক ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’ থেকে শুরু করে কনটেইনার স্থানান্তরে যত ধরনের যন্ত্র দরকার, তার সবই আছে টার্মিনালটিতে। বন্দর কর্তৃপক্ষ দরপত্রের মাধ্যমে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে টার্মিনাল পরিচালনা করছে। এখানে এক হাজারের মতো শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি কনটেইনার টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিউমুরিং টার্মিনাল, যেখানে একসঙ্গে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও একটি অভ্যন্তরীণ নৌপথের ছোট জাহাজ ভেড়ানো যায়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যত কনটেইনার ওঠানামা করা হয়, তার ৪৪ শতাংশই হয় এই টার্মিনালের মাধ্যমে, বন্দরের সবচেয়ে বেশি আয়ও হয় এই টার্মিনাল থেকে।
১৭ বছর ধরে এ রকম লাভজনকভাবে চলতে থাকা একটি টার্মিনাল কেন বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দিতে হবে, তা স্পষ্ট নয়। অনেকে দক্ষতা ও আধুনিক প্রযুক্তির কথা বলছেন। কিন্তু টার্মিনালে ইতিমধ্যে সব প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, যা ব্যবহার করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান দক্ষতার সঙ্গে কনটেইনার ওঠানামা করছে। এই বিদেশি বিনিয়োগের ফলে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে উল্টো বিদ্যমান কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই চট্টগ্রাম থেকে সরকার টেক্স নিয়ে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রগতি জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর। সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার।
প্রতিবছর এর উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এবং রাজস্ব প্রবৃদ্ধি দেশের বার্ষিক জিডিপিকে সমৃদ্ধ করে থাকে। এ বন্দর আজ দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা। দক্ষিণ এশিয়ায় সমমানের বন্দর সমূহের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতনভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি নিত্যন্তই অপ্রতুল। বন্দর কর্মীদের মজুরী আন্তর্জাতিক মানের হওয়া উচিত ছিলো। সার্বক্ষণিক ঝুঁকি নিয়ে তাদের কর্মস্থলে নিয়োজিত থাকতে হয় কিন্তু নেই কোন ঝুঁকিভাতা। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে, নতুন ধরনের পণ্য খালাসের সুবিধা প্রদান করতে আর পণ্য ওঠানামার সময় কমিয়ে সেবার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে তিলে তিলে নতুন মাত্রায় গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দর। আজকের বন্দর বিগত দিনের চেয়ে আরও বেশি কর্মক্ষম এবং আগামীর বন্দর হতে যাচ্ছে আরও আকর্ষণীয়, আরও সমৃদ্ধ এবং আরও বেশি কার্যকর। কনটেইনার ওঠানামায় নতুন রেকর্ড গড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। যেহেতু চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও এর সঙ্গে জড়িত। তাই বন্দর নিয়ে এবং বন্দরের সমৃদ্ধি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। একে শক্তিশালী করতে হবে। তবে তা যেন ভেবেচিন্তে দেশের স্বার্থে করি। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার স্বাভাবিক বাচন ভঙ্গী ও আকর্ষণীয় ভাষা প্রয়োগে আমরা চট্টগ্রামবাসী চমকিত ও আনন্দিত এবং উৎসাহিত। কিন্তু আবার শংকিতও। ইতিমধ্যে দেশের বন্দর ব্যবহারকারি ও বন্দর সংশ্লিষ্ট স্টক হোল্ডার যারা রয়েছেন তাদের সাথে আলাপে এ শংকাবোধ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড এ বন্দর পরিচালনার ভার যদি আমরা বিদেশি বেনিয়াদের হাতে তুলে দিই তবে আমাদের হৃৎপিন্ড স্থানচ্যুত হচ্ছে কিনা? অতীতেও চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। আবারও আমরা সেই ষড়যন্ত্রের বলি হচ্ছি কিনা?
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রামের লোক। চট্টগ্রামের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ রয়েছে। তাঁর ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি এ পরিকল্পনা নিয়েছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমরা চট্টগ্রামবাসী সিদুঁরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। অতীতে বাণিজ্যের আড়ালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে আমাদের স্বাধীনতা হরণ হতে দেখেছি। এটি তার পুনরাবৃত্তি কিনা ? ভেবে দেখতে হবে। এই আতংকিত এবং শংকিত মিলে চট্টগ্রাম বন্দর হোক ষড়যন্ত্র মুক্ত এটাই চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক