চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিন্ড

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বিশ্বের অন্যান্য বন্দরের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দর অনেক পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু এই পিছিয়ে থাকা নিয়ে কারো কোন দুঃখ দেখি না। সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে, কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর পাল্টায় না কেন? এ প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। এ জন্য চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বন্দরে উন্নীত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশ্বের খ্যাতিসম্পন্ন বন্দর ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
গতকাল বুধবার সকালে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ৫ নম্বর ইয়ার্ড পরিদর্শনের সময় বন্দর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি সাখাওয়াতকে (নৌপরিবহন উপদেষ্টা) বললাম, আমি আর কিছু শুনতে চাই না, এটার পেছনে লেগে থাক। পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের হাতে বন্দর ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দিতে হবে। সেটা যেভাবেই হোক। মানুষ রাজি না থাকলে তাদের রাজি করাতে হবে। মানুষকে রাজি করিয়েই সব করতে হবে। কাগজ উল্টালেই দেখা যায়, নেতারা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক যাচ্ছে। কিন্তু বন্দরের কথা যখন আসে- না না, এখানে কেউ আসতে পারবে না। ভাই, আমাদের এ হৃদপিন্ডেরও তো চিকিৎসা দরকার। এটার পেছনে আমাদের বিশ্বের সেরা চিকিৎসক দিতে হবে, যেন এটাকে বিশ্বসাইজের হৃদপিন্ড বানিয়ে দেওয়া হয়, কোন সমস্যা যাতে না হয়। এ হৃদপিন্ড ক্রমাগত মজবুত হবে, ক্রমাগত শক্তিশালী হবে, ক্রমাগত বৃহত্তর হবে।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদপিন্ড। এ হৃদপিন্ড শুধু বাংলাদেশের জন্য না, আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গেও সংযুক্ত। নেপাল, ভ‚টান, সেভেন সিস্টার্স যদি এটার সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে তারাও লাভবান হবে, আমরাও লাভবান হবো। আমরা চাই, সবাই মিলে যেন এ বন্দর থেকে অর্থনীতির শক্তিটা পাই।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বন্দরের পরিবর্তন নিয়ে আগে লেখালেখি করেছি, এবার দায়িত্বে আসার পর সুযোগ পেলাম সরাসরি কাজ করার। প্রথম দিন থেকেই এটিকে একটি প্রকৃত অর্থে কার্যকর বন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়া ‘চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে হলে আন্তর্জাতিক অংশীদারত্বও প্রয়োজন। বিদেশিদের সম্পৃক্ত করেই বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্ক্রিনে চট্টগ্রাম বন্দর এবং বর্তমানে বিশ্বের বন্দর পাশাপাশি দেখালে বোঝা যেত আমরা কোথায় পড়ে আছি। আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। কিন্তু এই পিছিয়ে থাকা নিয়ে কারো কোন দুঃখ দেখি না। চট্টগ্রাম বন্দর আমার কাছে কোন অপরিচিত জায়গা নয়। যেহেতু এখানে বড় হয়েছি। ছাত্রাবস্থায় এখানে এসেছি জাহাজ দেখার জন্য। যখন জাহাজ থেকে মাল খালাস করে, সেই দৃশ্য এক ভিন্ন জিনিস। খোলের ভেতর গিয়ে মাথায় করে বস্তা ওপরে ওঠাচ্ছে। তারপরে ক্রেন এলো পরবর্তী পর্যায়ে। সেই পর্যায় থেকে চট্টগ্রাম বন্দর আজ বর্তমান পর্যায়ে এসেছে।
তিনি বলেন, সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে, কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর পাল্টায় না কেন? এ প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। চট্টগ্রামবাসী হিসেবে এ পথে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে দেখা হয়। বিশেষ করে গাড়ি চলে না, আটকে যায়। ট্রাকে রাস্তা ভর্তি। যথাসময়ে মাল খালাস হচ্ছে না। প্লেন মিস করবে কিনা- কত দুর্ভাবনা। কাজেই বন্দর নিয়ে চিন্তা না করেও তো কোন উপায় নেই। আমি দায়িত্ব নেওয়ার প্রথমদিন থেকেই ভাবছি- কীভাবে বন্দরের পরিবর্তন করা যায়।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘লুৎফে সিদ্দিকীকে (বিশেষ সহকারী) দায়িত্ব দিয়ে বললাম- এটা তোমার দায়িত্ব, যেভাবে পার মেরে-ধরে এটাকে (বন্দর) সোজা করতে হবে। দুনিয়া তো এক জায়গায় আটকে নেই। দুনিয়া এর থেকে বহুদূর চলে গেছে। সার্বিকভাবে একটা বিরাট পরিবর্তন দরকার। কিন্তু এটার গরজ কারও খুব আছে বলে মনে হচ্ছে না।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি এখানে আসার আগে আবার আশিককে (বিডা চেয়ারম্যান) পাঠালাম। তাকে বললাম- যাও, সবার কাছে ব্যাখা কর আমরা কী করতে চাই, কেন চাই। সে-ও (আশিক) চেষ্টা করল। আমার চিন্তা হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতি পাল্টাতে হলে আমাদের পাল্টাতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর হলো আমাদের ভরসা। এটাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন কোন অধ্যায়ে প্রবেশের সুযোগ নেই। এর (বন্দরের) পথ খুলে দিলে বাংলাদেশের অর্থনীতির পথ খোলা। এর পথ না খুললে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে যতই লাফালাফি আর চাপাচাপি করি, কোন লাভ হবে না।’
নৌ পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন প্রধান উপদেষ্টার বন্দর উন্নয়নের আগ্রহের প্রশংসা করে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের আশেপাশে একাধিক টার্মিনাল নির্মাণ কন্টেইনার জট কমাতে সাহায্য করবে। তিনি আগামী ছয় মাসের মধ্যেই পরিবর্তন দেখা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য এবং তার ৯৮ শতাংশ নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল দিয়ে সম্পন্ন হয়। তাই বন্দর আধুনিকায়ন করার কোন বিকল্প নেই।
তিনি জানান, প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার কারণে ২০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, এ কারণে বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ ডলারের ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে।
এর আগে এদিন সকালে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে পৌঁছান প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় তাকে স্বাগত জানান চট্টগ্রামের মেয়রসহ অন্য কর্মকর্তারা। তারপর বিমানবন্দর থেকে সরাসরি চলে যান চট্টগ্রাম বন্দরে। সেখানে বন্দর ও জাহাজ চলাচল খাতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি ও বাণিজ্য সংস্থার নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবার নিজ জেলা চট্টগ্রাম সফর করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।