চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয় ও সক্ষমতা দুটোই বেড়েছে

1

মিঞা জামশেদ উদ্দীন

মুই কী হনুরে— হ্যাঁ, এমন প্রশ্ন জাগতে পারে; তবে প্রজাতন্ত্রের একজন নাগরিক হিসেবে যেমন জানার অধিকার আছে, তেমনি জবাবদিহিতারও ব্যাপারস্যাপার আছে। তবে যতক্ষণপর্যন্ত নিশ্চিত না হওয়া যাবে, তাতে কোনোভাবেই হেয়ালিপনা করার সুযোগ নেই, অর্থাৎ জাতিকে বিভ্রান্ত করা বা ধূম্রজালে রেখে নয়ছয় করা নৈতিকতা পড়ে না! তবে এসব বিষয়-আশয়দীও এড়ানো যারে না; এ কথা বলার কারণ যে, কোনো কিছুই দীর্ঘ-স্থায়ীত্ব নয়, এমন দৃষ্টান্ত একেবারে হাতের নাগালে! তাই, পারতপক্ষে গতরখেটে হলেও অনুসন্ধানে যাওয়া। অনেকটা নিজের খেয়ে বনের মহিষ পালন করার সামিল।
২৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক সাহেবের সাথে মুঠোফোনে কথা হয়। সঙ্গে ভাবতে থাকি, চট্টগ্রামের ছেলে হয়েও বন্দরে না যাওয়ার ঘটনা বিস্ময়কর; মূলত বন্দর কেন্দ্রিক কোন কাজও ছিলো না, খামাকা এমনি-এমনি যাওয়া অর্থহীন। তাছাড়া যাওয়া মানে, মহা ঝামেলায় জড়ানো। আগাম ছাড়পত্র নেওয়া এবং নানা প্রটোকল এ এক মহা ঝামেলা, ৩দিন আগ থেকে সিডিউল নেওয়া।
তবে কাছে-কিনারে থাকলে নাইবা দেখা-সাক্ষাতের বিষয়েও পোষানো যেত; তাছাড়া নিজের তো আর গাড়ি নেই। এখন গাড়ি ভাড়া, খনদন ও হোটেল ভাড়া গুনতে হবে। তবে আমার বেলায় তা ছিল ভিন্ন। বাড়ি যে খুব-একটা বেশী দূর, তা-ও না। সীতাকুÐ থেকে অনায়াসে আসা-যাওয়া যায়। গণপরিবহনে গেলে সর্বসাকুল্যে ভাড়া ৭০টাকা, এবং ফেরাসহ সবমিলে ৫শ টাকা বরাদ্দ হলে চলে। তার সাথে কোথাও দুপুরের আহারদি সারালে-ই হয়। অথচ দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯০শতাংশ হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব আয়েরও সর্বোচ্চ -প্রধান ক্ষেত্র এটি। আর সেখানে না গেলে কী করে-ই হয়। অথচ ২০২৪ সালে দেশের চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল নিয়ে আমার একাধিক কলাম প্রকাশিত হয়, ৭ আগস্ট ২০২৪ইং- দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায়। কলামের শিরোনাম ছিল, ‘বে-টার্মিনাল নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ঋণ পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত।’ ওই কলামের সারাংশ নগরীর হালিশহর উপক‚লে প্রস্তাবিত চট্টগ্রাম বে-টার্মিনাল। ২০২৪ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়ার পর ওই বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের বোর্ড অপ এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ৬৫০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৬৫ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন দেয়। তখন দেশীয় মুদ্রায় ৭ হাজার ৬৩৮ কোটি ২৭ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা। অবশ্য এখন ডলারের দাম বেড়েছে। এটি ছিল মেগা প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় দুটি কন্টেইনার টার্মিনাল, একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং একটি তেল ও গ্যাস টার্মিনাল প্রকল্প রয়েছে। বিশ্বব্যাংক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাংক বে-টার্মিনাল, মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের অর্থায়নের যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল, ওই প্রকল্পের অধীনে সমুদ্র স্রোত ও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া থেকে বন্দরকে রক্ষা করতে ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের জলবায়ুসহিষ্ণু আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পের আওতায় আরও কিছু প্রকল্প আছে। যেমন প্রবেশদ্বার, অববাহিকা ও সংযোগ চ্যানেলগুলো খনন করা। বিশ্বব্যাংকের এ প্রকল্প আধুনিকায়নে ও একক স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে, যা যা কিছু করার প্রয়োজন তা করা হবে। বলা যেতে পারে অপারেটিং সহ অন্যন্যা কার্যাদি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকছে-ই। এতে করে মালামাল ওঠা-নামা সময়ও কমবে। ফলে প্রতিদিন আনুমানিক ১মিলিয়ন বা ১০ লাখ মার্কিন ডলার সাশ্রয় হবে।
২৭ এপ্রিল, চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়া। তবে সচিব সাহেবকে দেখতে পেলাম, মহা ব্যস্থাতায় প্রহর গুণতে। অবশ্য তিনি আগ থেকে বলে দিলেন, ২ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবেন না। অবশ্য তাই হলো, নিজ অফিসকক্ষে দাঁড়ানো অবস্থা; রীতিমতো চেয়ারে বসারও ফুরসত নেই; সঙ্গে আরো জনাতিনেক ভদ্রলোকও দাঁড়িয়ে আছেন। তৎক্ষণাৎ জানতে পারলাম, এদের মধ্যে একজন এডিশনাল সেক্রেটারির পদমর্যদার কর্মকর্তা আছেন। সচিব সাহেব তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চায়ের সুব্যবস্থাও করতে বলে গেলেন। এক কথায় তিনি খুবই ব্যস্ত এবং বললেন, কাজের তাড়ায় বের হতে হচ্ছে। তিনি আরও বললেন, এক ডজনেরও বেশি মেজর-কর্ণেল অপেক্ষায় আছেন। আমি তাঁর মুখে এ কথা শুনে তো প্রথমে ঘাবড়িয়ে যাই। আবার যুদ্ধ লেগে গেল নাকি দেশে ; এমনিতে আজ সকালে ঘুম ভাঙে প্লেনের গর্জনে; মাথার ওপর পরপর তিনটি প্লেন গর্জে উড়ে গেল! মনও ধুরো-ধুরো করছে। কয়েকদিন ধরে পাক-ভারত যুদ্ধের ডামাডোল বেজে চলেছে, কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার ইস্যু নিয়ে। আমাদের সীমান্তে বরাবরই বিজিবি ও পিএসএফ-এর অবস্থান মুখোমুখি। শিলিগুড়ি ও ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তেও যুদ্ধের সাজসাজ রব। ভারত ওইসব সীমান্ত এলাকায় সৈনিক সমাবেশ করে রেখেছেন। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নিরাপদ করিডোর নিয়েও ভাবনা-চিন্তা চলছে। আর এমন মুখরোচক খবর বাতাসে ওড়ে বেড়াচ্ছে। আমজনতার মধ্যেও এ নিয়ে নানা কথাবার্তা এবং টানটান উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বন্দরে মেজর- কর্ণেল কেন? এখানেতো আমাদের নৌ ফৌজ-ই যেথেষ্ট। আমাদের নৌ-কমান্ডোদের সাথে যুক্ত আছে সাব মেরিনের মত অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। তাতে সক্ষমতাও বেড়েছে, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা জন্য সর্বদায় প্রস্তুত।
অবশেষে সচিব মহোদয় আশ্বস্ত করলেন, আমাদের প্রতিরক্ষা বিভাগের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা পরিদর্শন এসেছেন বন্দরের কার্যক্রম ও বে-টার্মিনাল নির্মাণস্থল দেখার জন্য। তিনি মূলত আমাকে সময় দিতে মোটেই রাজি নয়; তাই তড়িঘড়ি করে বের হওয়া। তবে একটি প্রশ্ন করা হয় আপনারা বলছেন, বন্দর বেসরকারি-কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেবেন না, কিন্তু বিদেশি অপারেটর নিয়োগ করা হচ্ছে? এ প্রশ্নে সচিব সাহেব বলেন, সেসবে অনেক যাচাই-বাছাই চলছে। তবে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ২৭ এপ্রিল, চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়া।
অন্যদিকে গত ২৪ এপ্রিল ১৩৮তম বন্দর দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বন্দরের শহিদ ফজলুল রহমান মুন্সি মিলনায়তনে সাংবাদিকের সাথে মতবিনিময় করেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়াল অ্যাডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চিটাগং কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার কথাটি বিভ্রান্তকর। এ দুটি টার্মিনাল মালিকানা কাউকে দিচ্ছি না, মালিকানা আমাদের থাকছে, শুধুমাত্র টার্মিনালের অপারেটর নিয়োগ করছি। তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেছেন, বে-টার্মিনালের কন্টেইনার টার্মিনাল-১ এবং কন্টেইনার টার্মিনাল-২ নির্মাণের জন্য পিপিপি অংশীদার পিএসএ সিঙ্গাপুর এবং ডিপি ওয়ার্ল্ডের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গত ২০ এপ্রিল বে-টার্মিনালের পিপিপি একনেক অনুমোদন করেছে। এছাড়া ২৩ এপ্রিল বে-টার্মিনালের চ্যানেলে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল প্রকল্প ২০২৯-২০৩০ সালের মধ্যে সমাপ্ত করা সম্ভব হবে আশা প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় টার্মিনাল অপারেটর এপিএম এর সাথে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। মাতারবাড়ী গভীরে সমুদ্র বন্দরকে ‘গেম চেঞ্জার’ উল্লেখ করেন। গত ২২ এপ্রিল মাতারবাড়ী গভীর প্রকল্পের ২টি জেটি নির্মাণে জাপানি প্রতিষ্ঠানের পেন্ট ওশান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও টোয়া কর্পোরেশনের সাথে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর ২০২৯ সাল নাগাদ অপারেশনে যাবে বলে আশা করেন।
প্রকল্প হিসেবে জাইকার সহযোগিতা বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটি দ্বিতীয় সংশোধনী ডিপিপি গত বছর ৭ অক্টোবর একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। তিনি আরো বলেন, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে প্রথম নয় মাসে ( জুলাই-মার্চ) ৩৭ হাজার ১৯১.৩২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। যা ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৬৩ শতাংশ বেশি। রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ পণ্য বন্দরের মাধ্যমে পরিবহন হয়। চলতি বছরের মার্চে রপ্তানি আয় গত বছরের মার্চের চেয়ে ১১.৪৪ শতাংশ বেড়েছে।
এবার উদাহরণ হিসেবে একটি জাতীয় বাজেটের কথা বলি। ২০২৩-২৪ সালে জাতীয় বাজেট ঘোষিত হয়, ৭ কোটি ৬১ হাজার৭৮৫ কোটি টাকা। এ পক্কলিত জিডিপির ১৫ দশমিক ২১ শতাংশ বাজেট ঘাটতি অর্থাৎ ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
বাজেটে ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎসহ থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়। রাজস্ব হিসেবে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৭০ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। যা আগামী অর্থবছরে চেয়ে ৬৭ হাজার কোটি টাকা হ্রাস। বাজেট ১৩টি খাতে-এ ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তার উল্লেখ কয়েকটি খাত: জনসেবা খাতে ২ লাখ ৭০ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। প্রতিরক্ষা খাতে ৪২ হাজার ১৪২ কোটি টাকা, জননিরাপত্তা খাতে ৩২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১ লাখ ৪ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে আমাদের বাজেটের সিংহভাগ বন্দর কেন্দ্রিক কাস্টমস ও ভ্যাট নির্ভর। সেখানে কৌশলে বন্দর হাতছাড়া হয়ে গেলে, এসব ১৩টি খাতের কি লাগাম টানা হবে? এতে আরেকটি বিষয় এসে যায়। ২০২৫ সালে, এ-এপ্রিল মাসের ১ সাপ্তাহের মধ্যে একসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের এতগুলো বিশাল আকৃতির মেগা প্রকল্প অনুমোদন করা। ২৩ এপ্রিল বে-টার্মিনাল, ২২ এপ্রিল মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র প্রকল্পসহ একাধিক প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। অথচ বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, তাদের আয় বেড়েছে। ২০২২-২০২৪ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট কাস্টমস ও ভ্যাট থেকে আয় হয়েছে ৬৮ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। যা বিগত বছরের চেয়ে ১২.২৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আয় হয়েছে। তাহলে বন্দরের নিজস্ব আয়ে কেন বে-টার্মিনাল সহ অপরাপর টার্মিনাল করা হবে না। তাছাড়া বে-টার্মিনাল বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য স্পষ্ট নয়। ২০২৩-২৪ সালে পতিত সরকার কর্তৃক বিশ্বব্যাংকের সাথে সম্পাদিত চুক্তি আবারও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর এ কথা বলতে দ্বিধা কোথায়?
লেখক : কবি, গবেষক ও কলামিস্ট