চট্টগ্রাম মহানগরীতে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ দুটি। এক. নির্বিচার পাহাড় কাটা; দুই. খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া। পাহাড় কাটার কারণে একদিকে ঢালু জমি সমতল হওয়ায় পানি আটকে থাকছে। আবার পাহাড়ের বালু খালের তলদেশে জমা হয়ে খালের গভীরতা কমাচ্ছে এবং বৃষ্টি ও বন্যার পানি অপসারণের ক্ষমতা হ্রাস করছে। এ ছাড়া খালের বিএস সীমানার ভেতরে অবৈধ ভবন নির্মাণ করায় এটির প্রশস্ততা কমে বৃষ্টি ও বন্যার পানি অপসারণের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সর্বশেষ কারণটি হলো, নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবনতি। ড্রেনগুলোর আবর্জনা খাল ভরাট করে ফেলেছে। বর্জ্যরে মধ্যে সবচেয়ে সর্বনাশা হলো পলিথিন ব্যাগ ও পিইটি বোতল।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, সেতু ও রেলওয়েবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের মতে, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট ও প্রকৃতির প্রতিশোধ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য চার মাসের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাহাড় কাটা বন্ধে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ অবিলম্বে ব্যবস্থা নেবে, এসব এলাকায় বিদ্যুৎ ও ওয়াসার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। পলিথিন ও পিইটি বোতলের ব্যবহার সীমিত করে এগুলো রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষে সেনাবাহিনী কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে, যাতে আগামী বর্ষার আগে নগরবাসী এর সুফল পেতে পারে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের স্লুইসগেটগুলোর অপ্রশস্ততা ও স্থাপিত পাম্পগুলোর নিম্ন ক্ষমতা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জলাবদ্ধতা নিরসনের কথা মাথায় রেখে মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা জোরদার করবে, যাতে বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে যায়। পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কালভার্টগুলোর উচ্চতা বাড়ানো হবে এবং ওয়াসা ও অন্যান্য ইউটিলিটির লাইন সরিয়ে নেওয়া হবে। সংস্থাগুলোকে বলা হয়েছে, কর্তব্য পালনে ব্যর্থ ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং বর্তমান কার্যক্রমের সাফল্যের ভিত্তিতে চলমান প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সুখবর হলো, জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে বহদ্দারহাটে নালার প্রশস্ততা বাড়ানো এবং নালার মাধ্যমে দুটি খালের (চশমা ও মীর্জা খাল) সঙ্গে সংযোগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য নালার ওপর নির্মিত সিটি করপোরেশনের বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় এ কাজ করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ হয়েছে ৮০ শতাংশ।
এছাড়া নগরের জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকাগুলোর নালা-নর্দমা ও খালগুলোর স¤প্রসারণ, খনন ও ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়েছে।
তবে ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ সহজে দূর হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে আগ্রাবাদের শেখ মুজিব সড়কের বক্স কালভার্ট দ্রুত পরিষ্কার এবং নতুন খনন করা বাড়ইপাড়া খালের সঙ্গে চাক্তাই ও কর্ণফুলী নদীর সংযোগ দেওয়া জরুরি বলে পরামর্শ দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এবার বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামে অন্তত পাঁচটি সভা হয়েছে। এসব সভায় নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রামের সেবা সংস্থাগুলোর করণীয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য মে মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এই তালিকা অনুযায়ী এখন কাজ চলছে।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তিন সংস্থা। এর মধ্যে সিডিএ দুটি, সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি করে প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে ৫ থেকে ১১ বছর ধরে। ইতিমধ্যে খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলোর কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে শুরু থেকে সিডিএর সঙ্গে সিটি করপোরেশনের দ্ব›দ্ব ছিল। এ জন্য এতদিন ধরে প্রকল্পের আওতার বাইরে থাকা ২১টি খাল খনন ও পরিষ্কারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়নি সিটি করপোরেশন। তবে এবার সে অবস্থান থেকে সরে এসে বির্জা খাল, নাছির খাল, কৃষি খাল ও সুন্নিয়া খাল পরিষ্কার ও খননে কাজ করছে সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া সরকারের কাছ থেকে থোক বরাদ্দ পাওয়া পাঁচ কোটি টাকায় নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের গুরুত্বপূর্ণ নালা-নর্দমা পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন। ইতিমধ্যে ১৩৯টি নালার তালিকা করে তা পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়েছে।
বৃষ্টি হলেই সড়ক-নালা একাকার হয়ে যাওয়ায় নালায় তলিয়ে যাচ্ছে অমূল্য প্রাণ। আমরা চাই, নগরবাসী জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাক।