মনিরুল ইসলাম মুন্না
বিগত বছরের তুলনায় এ বছর স্বস্তিতে রয়েছে নগরবাসী। দেশের কয়েকটি জায়গায় লোডশেডিং হলেও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ায় কোনো লোডশেডিং করতে হচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগের। শুধুমাত্র কোনো এলাকায় উন্নয়নের কাজ চললে সেখানে নিরাপত্তার স্বার্থে সাময়িক বন্ধ রাখা হয় বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। গতকাল বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট ও উৎপাদন কেন্দ্র সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার সারাদেশে ১৫ হাজার ১২৭ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে ৫৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। তবে চট্টগ্রামে কোনো লোডশেডিং ছিল না। চট্টগ্রামে ১ হাজার ৪০৪ মেগাওয়াট চাহিদার সম্পূর্ণটাই পাওয়া যায়। তার আগেরদিন (মঙ্গলবার) সারাদেশে ১৪ হাজার ৮৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে ৯৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। সেদিনও চট্টগ্রামে ১ হাজার ৪৩৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার সম্পূর্ণটাই পাওয়া যায় বিধায় লোডশেডিং হয়নি।
তবে বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছিল। কারিগরি ত্রæটির কারণে তাদের একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেক কমে গেছে। এতে বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি বেড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় লোডশেডিং হচ্ছে।
অন্যদিকে মাটি মেশানো কয়লা ফেরত দেওয়ায় মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। বাড়তি চাহিদা থাকলেও কয়লার অভাবে ইউনিটটি চালু করা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ ঘাটতি পুরোটাই দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে।
বিপিডিবি ও বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূর্বদেশকে বলেন, এবার গ্রীষ্মে লোডশেডিং গতবারের চেয়ে বাড়তে পারে। গ্যাস ও কয়লা থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে আমদানি থেকে আসবে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে তেলচালিত কেন্দ্র থেকে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে তিন হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি হতে পারে। এতে গরমের সময় প্রতিদিন তিন ঘণ্টার মতো লোডশেডিং হতে পারে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, গ্রীষ্মকাল সামনে রেখে এপ্রিল-মে মাসে সারাদেশে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে ১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এবার এটি ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট হতে পারে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সম্প্রতি বিদ্যুৎ ভবনে গ্রীষ্মের প্রস্তুতি নিয়ে অনুষ্ঠিত সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ব্যবহারে সতর্ক করেছেন তিনি। এসি ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিটের উৎপাদন গত মঙ্গলবার সকাল থেকে বন্ধ রয়েছে। এতে সামগ্রিক বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। ৫০০ থেকে ৬০০ মেগাওয়াটের মতো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। পেট্রোবাংলার কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। পেট্রোবাংলা এখন ৯০০ থেকে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে। এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেমন সমস্যা হতো না। অপরদিকে কয়লার চালান ফেরত যাওয়ায় মাতারবাড়ী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ। মূলত এসব কারণে এখন দেশের কয়েকটি জায়গায় লোডশেডিং হচ্ছে। বাড়তি চাহিদার কারণে বাধ্য হয়েই সন্ধ্যার পর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো হচ্ছে। উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি বলে আমরা এই কেন্দ্রগুলো চালানোর পক্ষে নই। আশা করছি, সপ্তাহখানেকের মধ্যে আবার আদানি থেকে পুরো সক্ষমতার বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে।’
চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি মিলেই হচ্ছে বিপিডিবি চট্টগ্রাম জোন। পুরো জোনে গ্রাহক রয়েছে ১২ লাখের অধিক। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরে গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৮ লাখেরও বেশি। বাকিগুলো চট্টগ্রাম, কক্সবাজার জেলা ও পার্বত্য অঞ্চলের। আবার চট্টগ্রাম জোনে আলাদাভাবে রয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। তাদের গ্রাহক আছে ১১ লাখ আর চাহিদা ৩০০ থেকে ৩৫০ মেগাওয়াট।
বিপিডিবি বিতরণ দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির মজুমদার পূর্বদেশকে বলেন, চট্টগ্রামে পুরো রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ রাখার চেষ্টা করেছি। এখনও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বেশি হওয়াতে এখানে আমরা যতটুকু চাহিদা তার সমপরিমাণে বিদ্যুৎ আমরা পাচ্ছি। তাই এ অঞ্চলে লোডশেডিং নেই।
তাহলে কোনো কোনো এলাকায় সাময়িক লোডশেডিং কেন হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। সিডিএ’র জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্প চলমান। তাদের কাজ চলাকালে আমাদেরকে সাময়িক বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ জানালে আমরা ওই ফিডার লাইন বন্ধ করে দিই। একইভাবে কোন এলাকায় অতিরিক্ত লোডের ফলে একটি ট্রান্সফরমার বা ফিউজ পুড়ে গেলো, সেটি সারানোর জন্যেই তো সাময়িক বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে। আবার কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সচল করা হয়। তাছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের যদি কোনো কাজ থাকে তাহলে আমরা আগাম নোটিশ বা প্রিন্ট/ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করি। তবে সামনে চট্টগ্রামে লোডশেডিং হবে কি হবে না সেটা নির্ভর করবে জ্বালানির সরবরাহ এবং উৎপাদন কেন্দ্রের উপর। এখন পর্যন্ত জাতীয় গ্রিড থেকে আমরা এখনও চাহিদামত বিদ্যুৎ পাচ্ছি।