মনিরুল ইসলাম মুন্না
যানজট নিরসন ও নগরবাসীর নিরাপদ যাতায়াত সুবিধার জন্য নগরীতে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার ও একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করেছে সরকার। কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার অভাবে কাক্সিক্ষত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসী। যেখানে নিয়মিত ঘটছে ছিনতাই, পাতা হচ্ছে সুতার ফাঁদ, যা আতঙ্কের বড় কারণ হিসাবে দেখা দিয়েছে। তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ পূর্বদেশকে বলেন, আমরা ফ্লাইওভার এবং এক্সপ্রেসওয়েতে নজরদারি বাড়িয়েছি। প্রতিটি থানার টিম ভাগ ভাগ হয়ে ডিউটি করছেন, সন্দেহ হলে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
নগরীর ফ্লাইওভার ও এক্সপ্রেসওয়ের মধ্যে বহদ্দারহাটে এম.এ মান্নান ফ্লাইওভার, মুরাদপুর-লালখান বাজার আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার, কদমতলী ফ্লাইওভার এবং লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দৈনিক হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করছে। ভুক্তভোগী ও যাতায়াতকারী চালক-যাত্রীরা বলছেন, ফ্লাইওভারগুলোতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ছাড়াও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ফ্লাইওভারের দুই প্রান্তে শক্ত সুতার ফাঁদ পেতে মোটরসাইকেল চালকদের কাছ থেকে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় অনেকের গুরুতর জখমও হয়েছে। এর বাইরে তরুণ-তরুণীরা মোটরবাইক ও গাড়ি থামিয়ে মাদকসেবন করে ফ্লাইওভারগুলোতে।
একদিকে যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব, অন্যদিকে ফ্লাইওভারকেন্দ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় সন্ধ্যার পর ফ্লাইওভার ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন অপরাধীচক্র।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, অব্যবস্থাপনা ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ফ্লাইওভার ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। এর মধ্যে ইদানিং যান চলাচল বেশি হওয়ায় তুলনামূলক কম দুর্ঘটনা ঘটলেও সুতার মাধ্যমে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে সর্বস্ব লুট করার ঘটনা ঘটেছে।
গত শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় এ সুতা গলায় আটকে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন সুজন তঞ্চঙ্গ্যা (২৬) নামে এক বাইক আরোহী। তার বাড়ি রাঙামাটির বিলাইছড়ি।
তিনি জানান, বিকেল সাড়ে তিনটায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দেওয়ানহাট দিয়ে উঠে কিছুদূর গেলে আগ্রাবাদের মাঝামাঝি স্থানে সুতার সাথে গলা আটকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আমার বাইকে আরও একজন ছিলেন। তবে আমি হাতে পায়ে বেশি ব্যথা পেয়েছি, পরে একটি ফার্মেসি থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছি। ঘটনার পর ১৬ থেকে ১৭ বছরের দুই কিশোরকে ঘটনাস্থলের পাশে দেখা গেছে। তবে পেছন থেকে আরও কিছু বাইক আসায় তারা দ্রুত সরে যায়।
ভুক্তভোগী বাইকারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানকার বিভিন্ন অংশে দুই পাশের রেলিংয়ে বেঁধে রাখা হয় নাইলনের চিকন সুতা। এগুলো স্বাভাবিক চোখে ধরাও পড়ে না। বলা যায়- অদৃশ্য সুতা। অনেকটা নির্জন এ ফ্লাইওভারে বেশি চলে মোটারসাইকেল। দ্রæত ছুটে চলা বাইক চালকদের চোখে পড়ে না এ সুতা। এ অবস্থায় চলার পথে অদৃশ্য সুতায় আটকা পড়েন চালক। মুহ‚র্তেই হাজির হবে ওঁত পেতে থাকা ছিনতাই চক্রের দল। ছিনিয়ে নেয় সর্বস্ব।
চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারে ছিনতাই করার এটি একটি অভিনব কৌশল। এ চিকন সুতার ফাঁদে আটকে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন অনেকে, ছিনতাই হয়েছে চালকের টাকা-পয়সা। এ সুতায় হাত ও গলায় জখম হয়ে আহতও হয়েছেন অনেকে।
গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১৩ জুলাই নগরীর আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার দিয়ে মোটরসাইকেলে চান্দগাঁওয়ের বাসায় ফিরছিলেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আরিফ চৌধুরী। ফ্লাইওভারের ২ নম্বর গেট অতিক্রম করার পর হঠাৎ নাইলনের সুতায় বাঁধা পেয়ে গাড়ি থেকে পড়ে যান তিনি। তখনই অল্পবয়সী দুটি ছেলে সাহায্য করার ভান করে তার কাছে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা ছুরি দেখিয়ে তার মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে দ্রæত মোটরসাইকেল নিয়ে সটকে পড়ে। এ ঘটনার পরদিন ১৪ জুলাই একইভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনার শিকার হন ব্যবসায়ী ইমরান চৌধুরী।
সেসব ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে ওই বছরের ২৯ আগস্ট ফ্লাইওভারকেন্দ্রিক এসব অপরাধে অভিযুক্ত এমন সাতজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কোতোয়ালি থানাধীন জামিয়াতুল ফালাহ মসজিদ সংলগ্ন মাঠের একটি পরিত্যক্ত বাসা ও চকবাজার থানাধীন দামপাড়া এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি দেশীয় এলজি, কাটার, কয়েকটি ছুরি উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে হৃদয় হোসেন (১৯), শহিদুল ইসলাম মনা (২২), চাঁন মিয়া (২১), হাসান (১৯), আরিফ (১৯), আনিচ (১৯) ও মহসিন উদ্দিন ওরফে টুকু (৩০)।
এরপর ২০২২ সালের ৭ ফেব্রæয়ারি ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারী চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হচ্ছে মো. মোবারক হোসেন (২৬), মো. হারুন অর রশিদ অরুন (৫৮), মো. মহিউদ্দিন শাকিল (৫২) ও মো. রিদোয়ান (২৭)।
তখন পুলিশ জানিয়েছিলেন, তারা নগরীর আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে ঘুরে ঘুরে ছিনতাই করে। কৌশল হিসেবে তারা ফ্লাইওভারে সুতা বেঁধে রাখত। তবে তারা তখন গ্রেপ্তার হলেও বর্তমানে তাদের অনেকেই জামিনে মুক্ত।
ওই ঘটনাগুলো পুনরায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ঘটাতে উদ্বিগ্ন নগরবাসী। নগরবাসীর ধারণা, ঘুরে ফিরে তারাই এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে।
গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, নগরজুড়ে থাকা বিভিন্ন ফ্লাইওভারের কোন অংশে বাতি জ্বললেও অনেকাংশ অন্ধকার। এর মধ্যে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার ও বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণের পর দীর্ঘদিন হলেও কিছু কিছু এলাকায় এখনও ‘আলোহীন’ অবস্থায় রয়েছে।
সিএমপি’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও গোয়েন্দারা সর্বদা তৎপর। ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। প্রতিটি ফ্লাইওভার ও নবনির্মিত এক্সপ্রেসওয়েতে পুলিশ নিয়মিত রোস্টারিং করে টহল দিচ্ছে। বিশেষ করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চারটি থানার পুলিশ যৌথ সিদ্ধান্তে ভাগে ভাগে টহল দিচ্ছে। সন্দেহজনক চালকদের বা বাইকারদের নিয়মিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া কোন ভুক্তভোগী যদি অভিযোগ দায়ের করে, সাথে সাথে মামলা নেওয়া হবে। এমনকি ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হবে।
পূর্বে যারা ফ্লাইওভারে ছিনতাইচক্রের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিল, তাদের নজরদারির বিষয়ে তিনি আরও বলেন, আগে যারা এসব ঘটনার সাথে জড়িত ছিল, তাদেরকে আমরা অবশ্যই নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসবো। প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।