চট্টগ্রামে প্রশাসনে ‘গুরুদায়িত্ব’ সামলাচ্ছেন ১৯ নারী

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

কর্মস্থলে একজন পুরুষ কর্মকর্তা হিসেবে অনেক দক্ষ। অন্যদিকে নারী কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত দক্ষ হিসেবে প্রমাণ দিতে হয়। যুগ যুগ ধরে সমাজে এমন ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অথচ সমাজের কাঠামো ভেঙ্গে দক্ষ বলেই পুরুষের সাথে সমান প্রতিযোগিতা করে কর্মকর্তা হচ্ছেন নারীরা। প্রতিনিয়ত পুরুষের মতো নারীরাও সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করছে। সামলাচ্ছেন তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব। চট্টগ্রামেও এমন গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে প্রশাসন সামলাচ্ছেন ১৯ নারী। যারা নিজ নিজ দপ্তরে কেউ অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এসিল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
গত বছরের ২৭ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) পদে দায়িত্ব পালন করছেন শারমিন জাহান। একজন নারী হয়ে বিভাগের ১১ জেলায় সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে নিজেকে সামিল রেখেছেন। প্রশাসন ক্যাডারের ২১তম ব্যাচের কর্মকর্তা শারমিন জাহান পূর্বদেশকে বলেন, ‘শত বাধা ডিঙিয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনে বহু নারী সফলতার সহিত কাজ করছে। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত মাঠে ঘাটে সবখানে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশাসনের কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ চিন্তা না করেই প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই এসেছি। আমি কর্মক্ষেত্রে কোন বাধার সম্মুখীন হই না। আমার কর্মক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন, অধিকার সবকিছু বিধিবদ্ধ করা আছে। যে কারণে আমি হয়তো কোন সমস্যার মুখোমুখি হই না। তবে অন্যরা যে হয় না তা কিন্তু নয়। কর্মক্ষেত্রে সকলের কাছ থেকে সহযোগিতা পাই। এরপরেও সামাজিকভাবে চলে আসা কিছু প্রথা এখনো আছে। যা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। এখন কেউ নারীদের কাজে বাধা দিলে সেই প্রতিবন্ধকতাও ডিঙিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো ক্ষমতা নারীদের আছে’।
প্রতিটি জেলার মুখ্য কর্মকর্তা হচ্ছে জেলা প্রশাসক। ডেপুটি কমিশনার, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা কালেক্টরের মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন একজন জেলা প্রশাসক। ভূমি ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমন্বয় সাধনসহ সাধারণ ও স্থানীয় নির্বাচনে মন্ত্রীপরিষদের একজন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন জেলা প্রশাসক। চট্টগ্রামের মতো দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী। ফরিদা খানম। প্রশাসন ক্যাডারের ২৫তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে চট্টগ্রামের প্রথম নারী জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চট্টগ্রামে যোগদানের পর থেকেই ছাত্র-জনতার গণঅভুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতি সামলে নিয়েছেন। ডিসি পার্কে মাসব্যাপী ফুল উৎসব করেছেন। রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন কঠোর উদ্যোগ। একজন নারী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম পূর্বদেশকে বলেন, ‘আগে যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে নারীরা ভালো কাজ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের সাফল্য ভালো। শুধু প্রশাসন ক্যাডারের কথা বলছি না, শিক্ষা ব্যবসাতেও মেয়েরা ভালো করছে। আমাদের এখন প্রায় ১৬জন নারী ডিসি আছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নারীদের দিয়ে কাজ করছে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। অতীতের তুলনায় অনেক বেশি নারী ডিসি পদে আছেন। একটা সময় যে নারীকে বাইসাইকেল চালানোর অপরাধে কটাক্ষ শুনতে হতো সেই নারী এখন বৈমানিক। নারীরা এখন সফল উদ্যোক্তা। সবকিছু মিলে নারীরা পুরুষের তুলনায় এগিয়ে।
জেলা প্রশাসক বলেন, নারীদের পরিবারকে সামলেই কাজ করতে হয়। আমাদের স্বামীরা ব্যবসা করে, চাকরি করে। আমাদের সোসাইটি এমনভাবে গড়ে উঠেছে স্বামী কখনো তার স্ত্রীর জন্য কর্মস্থল ত্যাগ করে না। কিন্তু স্ত্রী তার স্বামীর জন্য কর্মস্থল ত্যাগ করে। চ্যালেঞ্জও কিছু আছে। এখন আগের তুলনায় মেয়েরা মাঠে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।
চট্টগ্রাম প্রশাসনে শীর্ষ পর্যায়ে কর্মরত এই দুই নারী ছাড়াও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে তিনজন, সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) পদে সাতজন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদে সাতজন নারী কর্মরত আছেন।তারা হলেন- মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন, আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার, কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা জান্নাত, রাঙ্গুনিয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারজান হোসাইন, বোয়ালখালীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) কানিজ ফাতেমা, সাতকানিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারিস্তা করিম, লোহাগাড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাজমুল লায়েল, হাটহাজারীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) লুৎফুন নাহার শারমীন, চন্দনাইশের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ডিপ্লোমেসি চাকমা, কর্ণফুলীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) রয়া ত্রিপুরা।
অন্যদিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আরডিসি পান্না আক্তার, সহকারী কমিশনার খন্দকার ফারজানা নাজনীন সেতু, শিফাত বিনতে আরা, আফরিন ফারজানা পিংকি, জাকিয়া মুমতাহিনা, ফারজানা রহমান মীম, রুমানা পারভীন তানিয়া।
এই নারী কর্মকর্তারা জানান, প্রশাসনে একজন পুরুষ কর্মকর্তা যোগদানের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে ভাবনা থাকে উনি অনেক কাজ করতে পারবে। নারী হিসেবে যোগদান করলে ভিন্নভাবে দেখে। যদিও কাজের ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো নারী পিছিয়ে নেই। সমাজের কাঠামো ভেঙ্গে যারা এ পর্যন্ত এসেছে তারা অবশ্যই দক্ষ বলেই এসেছে। অথচ একজন নারী কর্মকর্তাকে বারবার দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু পুরুষ মানেই সবাই মনে করে দক্ষ কর্মকর্তা। এটা সামাজিকভাবে বহুদিন ধরে হয়ে আসছে। যদিও এখন পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। শুধু প্রশাসন ক্যাডারে নয়, সকল ক্যাডারেই নারীরা এগিয়েছে। শিক্ষা, ব্যবসাতেও নারীরা এগিয়ে আসছে। সংসার সামলে নিজের কাঁধে অর্পিত দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করছেন নারীরা। এক্ষেত্রে পরিবার থেকে ভালো সাপোর্ট পান নারী কর্মকর্তারা।
আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার পূর্বদেশকে বলেন, ‘রাতের বেলায় অনেক সময় মোবাইল কোর্টে বের হতে হয়। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই কাজ করতে হয়। তবে নারী হিসেবে সুবিধা একটু বেশিই পাই। নারী কর্মকর্তা হওয়ায় অনেকেই চাইলেও অনৈতিক সুবিধা নিতে সংকোচ করে। বাচ্চা, শ^শুর-শাশুড়ি, স্বামী থাকার পরেও যখন তখন দাপ্তরিক কারনে বের হতে হয়। পারিবারিক সাপোর্টটা বেশি পাই বলেই কাজ করতে সুবিধা হয়’।