নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীগুলোই এ দেশের প্রাণ। কোনোটি ছোট আবার কোনোটি বড় হলেও প্রতিটি নদীরই নির্দিষ্ট অঞ্চলে নিজস্ব অবদান আছে। নদীগুলোই যেন এসব অঞ্চলের সভ্যতার সূতিকাগার। কিন্তু নদীর সেই প্রাণোচ্ছ¡ল অববাহিকা এখন যেন ভাটা পড়েছে। ভরাট, দূষণ, দখলে বিপর্যস্ত নদ-নদী। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও নদীমাতৃক বাংলাদেশেই নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা সরকারি পর্যায়ে এখনও নির্ভুলভাবে নিরূপণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে ১১টি নদ-নদী চিহ্নিত করা হয়েছে। উৎসমুখ থেকে পতিতমুখ পর্যন্ত নদীগুলোর দৈর্ঘ্য ৮৭৯ কিলোমিটার।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক মাস পর দেশের নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে কাজ শুরু করে অন্তর্বতী সরকার। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দুই মাসের মধ্যে নদ-নদীর সংখ্যা নির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেন। উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এই কাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো, বিআইডবিøউটিএ, নদী রক্ষা কমিশন ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়। গতকাল মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) রাজধানীর গ্রীন রোডে পানি ভবনে ‘বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা নির্ধারণ’ বিষয়ক অবহিতকরণ সেমিনারে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়। বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় নদ নদীর সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় করে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ও গত ৫ নভেম্বর নিজেদের তথ্য সাইটে নদ-নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণপূর্বক তথ্য তুলে ধরে। এতে চট্টগ্রামে ১১টি নদীর তথ্য দেয়া হয়। যার মধ্যে একটি খাল হিসেবে খতিয়ান শিটে লিপি আছে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্য মতে, চট্টগ্রামের ১১ নদ-নদীর উৎসমুখ থেকে পতন মুখ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৮৭৯ কিলোমিটার। এরমধ্যে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ৩৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ইছামতি নদী পাহাড়ী এলাকার কাউখালী থেকে উৎপত্তি হয়ে রাগুনিয়ার কর্ণফুলী নদীতে মিলিত হয়েছে। রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, চান্দগাঁও, বোয়ালখালী, কর্ণফুলী,বাকলিয়া, পতেঙ্গা, আনোয়ারার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কর্ণফুলী নদী। মিজোরামের শৈত্যগ্রামের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তি হওয়া ১৬১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদী আনোয়ারা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। চন্দনাইশের চান্দখালী নদীর দৈর্ঘ্য ৪২ কিলোমিটার। এ নদী সাগু নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়েছে। লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলার ডলু টংকাবতী নদীর দৈর্ঘ্য ৫৩ কিলোমিটার। বান্দরবান সদরের পাহাড়ী এলাকা থেকে উৎপত্তি হয়ে নদীটি চন্দনাইশে সাগু নদীতে পতিত হয়েছে। ফটিকছড়ি ও মিরসরাই উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ১৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফেনী নদী। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা এলাকা থেকে উৎপত্তি হয়ে নদীটি স›দ্বীপ, সোনাগাজি, ফেনী হয়ে বয়ে গেছে। সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর উপর দিয়ে বয়ে গেছে ২৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সাগু নদী। মিয়ানমার সীমান্তের বান্দরবানের থানচি থেকে এ নদী উৎপত্তি হয়ে বাঁশখালী হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান ও চান্দগাঁও থানা হয়ে বয়ে গেছে ১০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ হালদা নদী। এ নদী খাগড়াছড়ির রামগড় পাহাড়ি এলাকা থেকে উৎপত্তি হয়ে রাউজান, চান্দগাঁও হয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিলিত হয়েছে।
পটিয়ায় তিনটি নদী চিহ্নিত করা হয়েছে। পটিয়ার শ্রীমাই লোকেমুখে খাল হিসেবে প্রচার পেলেও আরএসে নদী হিসেবে রেকর্ডভুক্ত আছে। ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ নদী লট ৭৫ শ্রীমাই মৌজার বুদবুদির ছড়া নামক স্থান থেকে উৎপত্তি হয়ে বাহলী মৌজার চাঁনখালী খালের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। পটিয়ার শিকলবাহা মুরালীও খাল হিসেবে পরিচিতি থাকলেও এটিও নদী হিসেবে লিপিবদ্ধ। আনোয়ারা অংশের সাগু নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি কর্ণফুলী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। পটিয়ার শিকলবাহার চন্দ্রখালী তেকোটা এলাকা থেকে উৎপত্তি হয়ে দুই কিলোমিটার নদীটি কর্ণফুলীতে পতিত হয়। রাগুনিয়ার শিলক খাল বান্দরবান থেকে উৎপত্তি হয়ে কর্ণফুলী নদীতে পতিত হয়েছে। ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ শিলক খতিয়ানে খাল হিসেবে লিপি আছে। এসব নদীর বেশিরভাগই পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি থেকে উৎসমুখ। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার উপর দিয়ে নদীগুলো প্রবাহিত হয়েছে।
জানা যায়, নদীর সঠিক তথ্য তুলে আনতে জেলা প্রশাসকগণ কর্তৃক পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটি, জেলা নদী রক্ষা কমিটি, সংশ্লিষ্ট সকল সরকারী প্রতিষ্ঠান, বাপাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী, এনজিও, মিডিয়া, নদী বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকলের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জেলার নদীর তালিকা প্রণয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। বিভাগীয় কমিশনার ও সচিব পর্যায়ে ফলোআপ সভা অনুষ্ঠান এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক ছক প্রণয়ন ও কমিটি গঠন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিভাগভিত্তিক ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বলেন, সকল বিভাগীয় কমিশনার কর্তৃক ডিসিদের তালিকা সমন্বিত করে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সভা করে স্ব স্ব বিভাগের নদীর তালিকা প্রণয়নপূর্বক পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও নদী রক্ষা কমিশনে প্রেরণ করে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক পাসম, বাপাউবো, বিআইডব্লিউটিএ ও সিইজিআইএস এর কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে জেলা ও বিভাগওয়ারী নদ-নদীর তালিকা যাচাইপূর্বক খসড়া স্টেকহোল্ডারগণের মতামতের জন্য খসড়া নদীর তালিকা উপস্থাপন করা হয়েছে।