চট্টগ্রামে খাবার পানিতে টাইফয়েডের জীবাণু

1

পূর্বদেশ ডেস্ক

বাংলাদেশে বিশুদ্ধ পানির সহজলভ্যতা দীর্ঘদিন ধরেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের অনেক জনগোষ্ঠী এখনও সঠিকভাবে পরিশোধিত পানি পান করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই পরিস্থিতি পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ানোর পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর দ্রুত বিস্তারের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
স¤প্রতি গবেষণায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন খাবার পানির উৎসে বহুমুখি অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ‘স্যালমোনেলা টাইফি’ নামক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। খবর বাংলানিউজের
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের গবেষণাগারে এ গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক ড. এ এম মাসুদুল আজাদ চৌধুরী।
এই দলে ছিলেন সহকারী অধ্যাপক সোহানা মিনা, এমএস থিসিস গবেষক পবিত্র দেবনাথ ও জাহিদ হাসান। গবেষণাপত্রটি প্রেস্টিজিয়াস সেল পাবলিকেশনের হেলিয়ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতাল, রেস্টুরেন্ট, বাসস্থান ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে খাবার পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। ১৫০টি নমুনার মধ্যে ৮টি (৫.৩৩ শতাংশ) ক্ষেত্রে স্যালমোনেলা টাইফি (টাইফয়েড) জীবাণু শনাক্ত করা হয়। এই জীবাণুগুলোর অধিকাংশই বহুমুখী ওষুধ প্রতিরোধী ছিল।
৮৭.৫ শতাংশ নমুনা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। স্যালমোনেলা টাইফি বেশিরভাগ নমুনায় gyrA, sul2, tem, int1 নামক অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন শনাক্ত করা হয়, যা এই জীবাণুর ওষুধ প্রতিরোধের ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করে। জিনগুলোর এক্সপ্রেশন লেভেলও বিশ্লেষণ করা হয় আরটি-পিসিআর ব্যবহার করে। কো-ট্রাইমক্সাজল ও সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক এখনও কার্যকর হলেও বেশকিছু জীবাণু এই ওষুধগুলোর প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, স্যালমোনেলা টাইফি জীবাণু মানুষের অন্ত্রে প্রবেশ করে টাইফয়েড জ্বর সৃষ্টি করে। পানি ও খাবার এই জীবাণুর প্রধান বাহক। পানির মাধ্যমে এর সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে দ্রুত মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু এমন হুমকি তৈরি করে, যেখানে প্রচলিত ওষুধ কার্যকর হয় না। এজন্য নতুন ও শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়, যা বেশ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য এটি আর্থিকভাবে অসম্ভব হয়ে উঠবে।
তাদের মতে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু অন্য ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে প্রতিরোধী জিন ভাগাভাগি করে (যেমন: রহঃ১ জিন), যা পরিবেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা যদি উন্নত করা না হয়, তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর বিস্তার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে। শিশু এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষ এই জীবাণু দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টাইফয়েড জ্বর শিশুদের মধ্যে মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা এবং এমনকি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে জনস্বাস্থ্যের জন্য কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো- নিরাপদ পানির সরবরাহের লক্ষ্যে নদী, পুকুর, টিউবওয়েল এবং সাপ্লাই পানির মতো উৎসগুলোর সঠিক পরিশোধন ও পরীক্ষা নিশ্চিত করা, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং চিকিৎসকদের যথাযথ ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া, টাইফয়েড জ্বরের বিরুদ্ধে টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করা। এতে সংক্রমণ কমবে এবং রোগীর চিকিৎসার প্রয়োজনও হ্রাস পাবে। পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া টাইফয়েড প্রতিরোধ সম্ভব নয়। সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর বিস্তার রোধে নতুন ওষুধ, ভ্যাকসিন ও প্রোবায়োটিক উদ্ভাবনে গবেষণায় বিনিয়োগ করার তাগিদ দিয়েছেন গবেষক অধ্যাপক ড. এ এম মাসুদুল আজাদ চৌধুরী।