মো. দিদারুল আলম
দেশে নারী ও কন্যাশিশুর নির্যাতন ও ধর্ষণ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি এর মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্রই এর ভয়াবহ শিকার হচ্ছেন কন্যাশিশুসহ সকল বয়সী নারী। নৃশংসতার মাত্রা ও সংখ্যা বিবেচনায় সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতায় দেশবাসী আতংকগ্রস্থ সময় অতিবাহিত করছে। এ পরিস্থিতি অগ্রহণযোগ্য। নারী ও কন্যাশিশুর নির্যাতন ও ধর্ষণ, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়া, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা প্রভৃতি কারণে সামাজিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে যা সমতাভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার অন্তরায়। নারীর প্রতি এ ধরনের আচরণ দূর করতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সুপরিকল্পিত কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি।
নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের নিশ্চিয়তা প্রদানে বাংলাদেশ জাতীয় পরিমন্ডলে সংবিধানের আলোকে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও), নারী উন্নয়ন নীতিমালা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রভৃতি অন্যতম। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, নারী বা শিশুদের অনুক‚লে বিশেষ বিধান প্রণয়নে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করা যাবে না। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৫ এ নারীদের সম-অধিকার এবং তাদের ও কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারী-পুরুষের সমতার আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও ২০২৪ এ ৪০ ধাপ অবনমন হয়েছে, যার ধারাবাহিকতায় নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার সাম্প্রতিক প্রবনতা ব্যাপক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যা পুঁজি করে নারী ও কন্যাশিশুর বহুমাত্রিক অধিকার হরণ। শিক্ষাঙ্গণসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরে চলমান এ প্রবনতা চরম উৎকণ্ঠাজনক।
বিশেষ করে ঘরে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাদের কাছে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা সুরক্ষিত থাকে বলে সবাই আস্থা রাখে, সেই সব মানুষের হাতে তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা লঙ্ঘন হবার ঘটনা সবার মনে গভীর দাগ কেটেছে, নানান প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। ইউনিসেফের হিসেবে, বিশ্বে বর্তমানে বেঁচে আছেন এমন প্রতি আট নারী ও শিশুর মধ্যে ১ জন বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। আর বাংলাদেশে সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব অপরাধী প্রায়ই ভুক্তভোগীদের পরিচিত হয়ে থাকেন। শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ গঠনে সংবাদমাধ্যমেরও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। কর্তৃপক্ষগুলোকে নৈতিকতাসম্পন্ন (ইথিকাল) মিডিয়া ও শিশু সুরক্ষার নীতিগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া চলাকালে শিশুর মর্যাদা ও কল্যাণ রক্ষিত হয়। একইসঙ্গে সংবাদমাধ্যমগুলোকে নির্যাতনের শিকার শিশু ও ভুক্তভোগীদের পরিচয়, গোপণীয়তা ও মর্যাদা সুরক্ষিত রেখে দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশনে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হতে হবে। এক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলোকে খবরকে চটকদার করে অহেতুক উত্তেজনা তৈরি পরিহার করার এবং ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার ও কমিউনিটির আরও ক্ষতি হতে পারে এমন কাজ এড়িয়ে চলার নীতি অবলম্বন করতে হবে।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে দেশে সহিংসতার শিকার হয়েছে অন্তত ৯ হাজার ৬৭৭ শিশু, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮ বছরের কম। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক, ৪ হাজার ৮০১ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত আট বছরে ধর্ষণের শিকার শিশুদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। আর ১ হাজার ২৮ জনের বয়স সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে। ইউনিসেফ বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিশুর (০-১৭ বছর) সংখ্যা ৫ কোটি ৬৯ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশেরও বেশি। তার কমবেশি অর্ধেক মেয়ে শিশু। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে দেশের স্বাভাবিক অগ্রগতি ব্যাহত হবে বলে মনে করেন অধিকারকর্মীরা। শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন
দেশজুড়ে নারীদের প্রতি সহিংসতা ও হেনস্থার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই সমাজে নারী ও শিশু ধর্ষণ, হত্যা, ছিনতাই, গুম, অ্যাসিড সন্ত্রাস বেড়ে যাচ্ছে। গত ৫ মার্চ দিবাগত রাতে মাগুরা সদরে বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ৮ বছরের এক মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মেয়েটি মারাত্মক আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে। সে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। একইদিনে দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে ঢাবির এক নারী শিক্ষার্থীকে ‘ওড়না ঠিক নেই’ বলে নাজেহাল এবং হেনস্তা করা হয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দিন আগেই আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছিলেন, ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে অর্ধেক করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে এসব মামলায় তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। আর বিচার শেষ করতে হবে ৯০ দিনের মধ্যে। এ ছাড়া ডিএনএ সনদের পরিবর্তে শুধু চিকিৎসা সনদ ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচারক এ মামলার বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারবেন।
চট্টগ্রামে মো. মাহাবুবর রহমান নামের একজন এনজিও কর্মকর্তা ২০২১৯ সালে রহিমা নামের এক শিশুকে তার বাসায় আটক রেখে ধর্ষণ করেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জাতীয় চাইল্ড হটলাইন ১০৯৮-এ কল পেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চান্দগাঁও থানার পুলিশের সহযোগিতায় রহিমাকে আসামীর তালাবদ্ধ বাসা থেকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে, ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই রহিমার মা বিবি জহুরা চান্দগাঁও থানায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এ সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের গভীর উদ্বেগের বিষয় হলো, মামলার অভিযুক্তরা বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে, ভুক্তভোগী পরিবারের ওপর ভয়ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথে বাঁধা সৃষ্টি করছে। আসামী প্রভাবশালী হওয়ায় মামলাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
সমাজ থেকে শিশু নির্যাতন কিংবা শিশু ধর্ষণকারীদের উৎখাত করতে আমাদেরও সোচ্চার হতে হবে। যেখানে এ ধরনের জঘন্য ঘটনা ঘটবে সেখানেই গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিশু নির্যাতনকারীদের চিহ্নিত করে সমাজ থেকেও বিচ্যুত করার ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আইনের কোনো ফাঁক দিয়ে যাতে অপরাধীরা বের হয়ে যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এসব ঘটনায় প্রমাণিত হয় দেশে নারী ধর্ষণ ও সহিংসতা বেড়ে গেছে। এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় দেশবাসীর ন্যায় আমরাও গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছি। মাগুরার আট বছরের মেয়ে শিশুর ধর্ষক ও ধর্ষণের সহযোগিতাকারীদের অপরাধ এক ও অভিন্ন। এদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এরকম ধর্ষক নামের নিকৃষ্টদেরকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক