নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
হঠাৎ টর্চ লাইটের আলো চোখে পড়ায় ঘুম ভেঙ্গে যায় আনোয়ারুল আজিমের। পাশে শোয়া অনিলকে ধাক্কা দেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে অনিলও সাড়া দেন। দু’জনে অন্ধকারে তাকিয়ে দেখেন অনেক পাকিস্তানি সৈন্য দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। বাইরে সেনাদের কথোপকথন শুনে বুঝতে পারলেন তাদের আশ্রয়কর্তাই পাকিস্তানি সৈন্যদের ডেকে এনেছে। সৈন্যরা গৃহকর্তা চাকমাকে জিজ্ঞেস করছে, তার কাছে মেয়েলোক আছে কিনা। সে বললো নেই, পাশের পাহাড়ে আছে। আজিম গুণে দেখলেন সংখ্যায় ২৮ জন। সৈন্যরাই তাদের চোখে টর্চ মেরেছে। আজিম ও অনিল প্রমাদ গুণলেন আর বোধ হয় শেষ রক্ষা হবে না, এখনই পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে মারা পড়বেন। তারপরও সাহস হারাননি। মরার আগে বাঁচার কোনো উপায় আছে কিনা সেটা দেখে নিলেন।
বাইরে তখন পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে চাকমা বলছে এদের কাছে অস্ত্র নেই। আর এক পাহাড়ে নীলাকান্ত’র কাছে আছে। তখন ২৬ জন সৈন্য তাকে ধরার জন্য চলে যায়। তাদের পাহারা দেয়ার জন্য দু’জনকে রেখে যায়। তারাই মেয়েলোকের কথা জিজ্ঞাস করছিল। পাশের পাহাড়ে মেয়ে আছে শুনে তারাও সেদিকে রওনা হয়ে যায়।
আজিম ও অনিল আত্মরক্ষার জন্য তৈরি হয়ে নিলেন। চাদর মুড়ি দিয়ে নিচে ঝাঁপ দেন। কারণ নিচে ছিলো কাঁটা ঝোপ। ক্রলিং করে করে হাত-পা কেটে ছিড়ে অনেক কষ্টে আধ মাইল দূরে যাবার পর একজন বৃদ্ধ লোকের সাথে তাদের দেখা হয়। তিনি আজান দিচ্ছিলেন। তারা তাকে বললেন তারা বরযাত্রী, মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, নারায়ণহাট যাচ্ছিলেন। তাদেরকে যদি তিনি যুইগ্যাছোলা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারেন, তাহলে তাকে ভাল বখশিস দেবেন। তিনি তাদেরকে যুইগ্যাছোলা (বর্তমানে সেমুতাং) পর্যন্ত পৌঁছে দেন।
যুদ্ধদিনের এই লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেন আনোয়ারুল আজিম। আমারও সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে ওঠে। ভারত থেকে দেশে আসার পথে মানিকছড়ি রাজবাড়ির পাশে পাহাড়ের উপর একটি উপজাতীয় বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ফটিকছড়ি থানা বিএলএফ কমান্ডার আনোয়ারুল আজিম, তাঁর সঙ্গে ছিলেন অনিল চন্দ্র ঘোষ। সেখানে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন দু’জন।
যুইগ্যাছোলা থেকে নারায়ণহাটে এসে একটি চা বাগানে আশ্রয় নেন আজিম ও অনিল। ফরহাদাবাদ থেকে কমান্ডার জহুর ও গোলাম রব্বানী মনু এসে তাদেরকে ফরহাদাবাদ কমান্ডার জহুরের বাড়িতে নিয়ে যান। ফরহাদাবাদে অবস্থান করে হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন লোকজন এবং ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপের সাথে যোগাযোগ করেন।
চট্টগ্রামের রাজনীতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রণী সাহসী নেতা আনোয়ারুল আজিম। ১৯৪৯ সালের ১৮ জানুয়ারি ফটিকছড়ি থানার দৌলতপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম বজলুর রহমান চৌধুরী। পিতামহ ঠান্ডা মিয়া চৌধুরী। মাতার নাম লায়লা বেগম। মাতামহ আহমদ মিয়া মাস্টার, নিবাস ফরহাদাবাদ, হাটহাজারী।
আনোয়ারুল আজিম ১৯৬৫ সালে কাটিরহাট হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৮ সালে নাজিরহাট কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৭২ সালে একই কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন।
১৯৬৩ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন আনোয়ারুল আজিম । সে বছর লালদিঘির মাঠে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জনসভায় তাঁর বক্তৃতা শুনে তিনি রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হন । সেদিনই সিদ্ধান্ত নেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব যে দল করেন তিনিও সে দল করবেন। ১৯৬৪ সালে তিনি নাজিরহাট হাই স্কুল থেকে কাটিরহাট হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সেখানে ছাত্রলীগের শাখা গঠন করেন। ১৯৬৫ সালে নাজিরহাট কলেজে যাবার পর তিনি স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন স্কুলে সরাসরি ছাত্র সংগঠনের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের ব্যানারে ছাত্রলীগের কর্মকান্ড চালানো হতো। ১৯৬৬ সালে নাজিরহাট কলেজ ছাত্রলীগের শাখা গঠন করা হয়। শ্রী ইন্দু নন্দন দত্ত (পরবর্তীকালে জাসদ নেতা) ও আনোয়ারুল আজিম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬৪ সালে ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন ও ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন আনোয়ারুল আজিম। ১৯৬৪ সালে নাজিরহাট কলেজে স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। নুরুল আফসার চৌধুরী ভিপি ও ডা. হারুন-এর রশিদ জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন অভিযাত্রিক নামে আত্মপ্রকাশ করে; আনোয়ারুল আজিম প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন; এডভোকেট মোহাম্মদ আলী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, সে সময় উত্তর চট্টগ্রামের ছাত্র রাজনীতি নাজিরহাট কলেজকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো। হাটহাজারী, ফটিকছড়ি এবং রাউজানের কিছু এলাকায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নাজিরহাট কলেজের ব্যাপক প্রভাব ছিলো। হাটহাজারীর এমএ ওহাব ও ফটিকছড়ির বাদশা আলমের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রলীগ প্রথম নাজিরহাট কলেজ ছাত্র সংসদ দখল করেছিলেন। ভিপি নির্বাচিত হন হারুন ও জিএস চকরিয়ার নাসির।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রলীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভ করে। আনোয়ারুল আজিম ভিপি ও জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী (বর্তমানে জাসদ নেতা) জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে জেলা ছাত্রলীগ নেতা এসএম ইউসুফ, ছাবের আহমদ আসগরী ও গোলাম রব্বান নাজিরহাট কলেজে আসা যাওয়া করতে থাকেন। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে যেতেন এএমএম শহীদুল্লাহ ও আবু তাহের মাসুদ। এইসব জেলা নেতৃবৃন্দের যাতায়াত নিঃসন্দেহে নাজিরহাট কলেজে ছাত্র রাজনীতিকে জোরদার করেছিলো। শুধু কলেজ নয়, নাজিরহাট কলেজের ছাত্র নেতা, বিশেষ করে ছাত্রলীগ নেতারা নাজিরহাটের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন।
ডন-৭০ কাল থেকে ফটিকছড়ির বিভিন্ন স্থানে বাদশা আলমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। এসময় যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন, তারা হলেন, সালেহ আহমদ চৌধুরী, ইউসুফ মাস্টার, আবা মিয়া মাস্টার, হারেস চৌধুরী, আফতাবউদ্দিন, এসএম ফারুক, হাবিবুর রহমান চৌধুরী, মুসা চৌধুরী, আবুল হাশেম, রফিকউদ্দিন সিদ্দিকী, আহমদ ছাপা, আমানউল্লাহ নিজামী, সেকান্দর চৌধুরী, আলমগীর মুন্সি, আবদুল মান্নান চৌধুরী, মোহাম্মদ গণি, শামসুল আলম, অধ্যক্ষ ইসমাইল, দীন মোহাম্মদ, আখতার কামাল, নুরুল ইসলাম তালুকদার, গৌরি শঙ্কর, মোহাম্মদ খালেদ, খায়রুল বশর চৌধুরী, শামসুল হুদা পাখি, রফিকুল আলম, সি-ইন-সি স্পেশাল আবদুল হালিম, রুহুল আমিন, ইউসুফ আহমদ চৌধুরী, ইউসুফ খান, এসএম হোসেন চৌধুরী, মাহবুব, কবির সওদাগর, মীর আহমদ।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম ইউসুফ আনোয়ারুল আজিমকে বললেন স্বাধীনতার জন্য গোপনে প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষে জায়গা খুঁজে বের করতে। আজিম দুটি জায়গা নির্বাচন করেনÑ একটি খিরাম ও আরেকটি শোভনছড়িতে। একটি চাইনিজ রাইফেলও যোগাড় করেছিলেন।
৬৯ এ হাটহাজারী-ফটিকছড়ি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহব্বায়ক হিসেবে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন আনোয়ারুল আজিম। সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন খায়রুল বশর চৌধুরী, মুসা চৌধুরী, শামসুল আলম, আহমদ ছাফা; হাবিবুর রহমান চৌধুরী, আমানুল্লাহ নিজামী, সেকান্দর চৌধুরী, রাজেন্দ্র প্রসাদ দে, অনুজ দে।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ নাজিরহাট কলেজ ছাত্র সংসদের সভা চলছিল। সংসদ কক্ষে একটি ছোট রেডিও ছিলো। আনোয়ারুল আজিম হঠাৎ শুনলেন ইয়াহিয়া খান অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিয়েছেন। এই ঘোষণা সভাস্থলে এমন একটি ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলো যে তারা সঙ্গে সঙ্গে সভা শেষ করে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ছাত্র-শিক্ষক-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলটি স্লোগান দিতে দিতে দক্ষিণে সরকারহাট, উত্তরে ফটিকছড়ি বিবিরহাট পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করে। দু’তিন হাজার লোক নিয়ে শুরু হওয়া মিছিলটি শেষ পর্যন্ত ১৫ হাজার লোকের এক বিরাট গণমিছিলে পরিণত হয়। ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’, ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিলো।
মিছিলের পর রাতে নাজিরহাট কলেজ হোস্টেলের ১০নং রুমে সভা করে তারা সিদ্ধান্ত নেন ২ মার্চ দুপুর ২টা থেকে কলেজ মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া হবে। যথারীতি প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ দিতেন ফ্লাইট সার্জেন্ট দবির ও আনসার কমান্ডার আবদুস সাত্তার। প্রতিদিন সর্বনিম্ন ৫০ জন থেকে সর্বোচ্চ ২০০ জন পর্যন্ত প্রশিক্ষণে অংশ নিতেন।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য তারা রেডিও নিয়ে বসেছিলেন। ভাষণ প্রচার না করায় সেই রেডিও আছড়ে ভেঙে ফেলেন।
অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার সাথে সাথে একদিকে মানুষের মধ্যে উদ্দীপনা ও অন্যদিকে আতংক পরিলক্ষিত হয়। একটি থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। চট্টগ্রাম কলেজের মাঠে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিলো; অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, এজাহরুল হক, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি জালাল উদ্দিন আহমদের সহযোগিতায় সেই নাটক নাজিরহাট কলেজে এনে মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেন আনোয়ারুল আজিম। তারাও এসেছিলেন। নাটক দেখার জন্য ৬০/৭০ হাজার লোক জমায়েত হয়েছিলো ।
২৫ মার্চ সকালে আজিম, হাবিব, ইউনুস শহরে এসেছিলেন খবরাখবর নেয়ার জন্য। রাতে হেটে নাজিরহাট যাওয়ার সময় ১২টার পর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান। আনোয়ারুল আজিমের নেতৃত্বে নাজিরহাট সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ২৬ মার্চ সকাল থেকে নাজিরহাটে রিক্সা নিয়ে মাইকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে থাকেন এবং জনসাধারণকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহবান জানান। শহরের পতনের পূর্ব পর্যন্ত শহরে যুদ্ধরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর এবং বাঙালি সৈনিকদের জন্য রসদ নিয়ে যান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের পর সবাই নাজিরহাট গিয়ে আশ্রয় নেন। নাজিরহাট একটি ট্রানজিট ক্যাম্পের মত ছিলো। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত নাজিরহাট মুক্ত ছিলো। ১৪ এপ্রিল সকালে সবাই রামগড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন রফিক, এম.এ ওহাব এমপিএ, মির্জা আবু মনসুর এমপিএ, বাদশা আলম, এসএম ফারুক, আবদুল হালিম।
প্রতিরোধ যুদ্ধ চলাকালে ফতেয়াবাদে রাস্তা কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। উদালিয়া চা বাগান, নাজিরহাটে তাদের ঘাঁটি ছিলো। তারা রামগড়ের পতনের দিন ফেনী নদী পার হয়ে ভারতের সাবরুমে যান। একরাত সাবরুমে কাটিয়ে পরদিন সাবরুম থেকে হরিণা যান। হরিণায় সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এক পর্যায়ে এসএম ইউসুফ এসে বললেন দেশে যেতে হবে। ইতিমধ্যে আনোয়ারুল আজিমের দু’জন সহযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম ও আহমদ ছফা শাহাদাতবরণ করেন। নাজিরহাটের পতনের পূর্বে রাউজান রাবার বাগান থেকে ১৩ জন পাকিস্তানি সৈনিককে গ্রেফতার করে আনা হয়।
শেল্টার, প্রশিক্ষণ ও রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব নিয়ে আনোয়ারুল আজিমকে হরিণা থেকে দেশে পাঠানো হয়। তার সঙ্গী হন নাজিরহাট কলেজের ছাত্রনেতা অনিল চন্দ্র ঘোষ। বৈষ্ণবপুর সীমান্ত দিয়ে ঢুকে এক রাত এক দিন হেটে মানিকছড়ি রাজবাড়ির পাশে পাহাড়ের ওপর একটি উপজাতীয় বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়েন। এরপরে এখানে যে ঘটনা ঘটে সেটা প্রথমেই বর্ণনা করা হয়েছে।
ফটিকছড়ির মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের মধ্যে ছিলো দবির চৌধুরী, আহমদ ছাপা, মইনুদ্দিন, হাবিব, আলমগীর, কাদের, সেকান্দর, আমানউল্লাহ চৌধুরী, খায়রুল বশর, দিদার, ফজলুল আমিন মাস্টার, হাশেম, মোহাম্মদ ইদ্রিস, সি-ইন-সি হালিম, এস.এম ফারুক, জয়নাল আবেদিন, আনসার সাত্তার ও ইউসুফের গ্রুপ। এদের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর সমন্বিতভাবে ছোট ছোট গেরিলা অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রথমে স্বাধীনতা বিরোধী শান্তি কমিটি, দালাল, রাজাকার ক্যাম্প, চা বাগানের মিলিশিয়া ক্যাম্প, বিআরটিসি বাস, নাজিরহাট কলেজে পাকিস্তানি সৈন্যের ক্যাম্প, নাজিরহাট রেললাইন, তহসিল অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে আক্রমণ চালান। এরপর ১৪ আগস্ট তারা বিভিন্ন স্থানে একযোগে অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। সৈন্য আনা নেয়ার কাজে ব্যবহৃত গাড়ি চলাচলেও বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। যারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, তাদেরকেও সংগঠিত করেন। কাটিরহাট, সরকার হাট, উদালিয়া, কর্ণফুলী টি এস্টেট এর মধ্যে এলাকায় যাদের সাথে তাদের যোগাযোগ হয়, তাদের মধ্যে ইউসুফ মাস্টার, আখতার কামাল, কবির সওদাগর, নুরুল ইসলাম তালুকদার, মোখতারুল আলম, তৌহিদুল আলম ফসিউদ্দৌলা, আবদুল কাদের, গৌরিশঙ্কর চৌধুরী, মীর আহমদ, রুহুল আমিন চৌধুরী, ইলিয়াস মানিক, হাবিবুল্লাহ, জুনায়েদ,জোবায়ের চৌধুরী, ইউসুফ আহমদ চৌধুরী, কাজী ইসলাম, জাহেদ, দেলা মেম্বার, মোহাম্মদ হোসেন, নেছারুল হক, অধ্যাপক শফিউল আলম, মৃদুল, জহুরুল হক, আবদুস সালাম, আবদুস সবুরের নাম উল্লেখযোগ্য। তাদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল, খাবার, যোগাযোগ, অপারেশনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
এরই মধ্যে আনোয়ারুল আজিমকে আবার ভারতে যাওয়ার জন্য খবর দেয়া হয়। মোহাম্মদ ইদ্রিসসহ তারা পঞ্চাশ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা ভারতে যান। বিএলএফ ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন থানার তিনশ মুক্তিযোদ্ধাকে হরিনা থেকে আগরতলা নিয়ে যান। সেখান থেকে তাদেরকে হাফলং ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়। আনোয়ারুল আজিম লিডারস ট্রেনিংয়ে টানডুয়া যান। ট্রেনিং শেষে উদয়পুর ক্যাম্পে আসেন। যাদেরকে বিএলএফ-এর ট্রেনিং দেয়া সম্ভব হয় নি, তাদেরকে হরিনায় পাঠিয়ে ১০ দিন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ৬ ডিসেম্বর আনোয়ারুল আজিম ৭/৮শ’ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দেশে প্রবেশ করেন। বাঁশখালীর মোখতার আহমদও তাদের সঙ্গে আসেন। ৭ ডিসেম্বর রামগড়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাঙ্কারের ওপর ভারতীয় বিমান থেকে বোমা বর্ষণের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা বিভিন্ন দিকে পলায়ন শুরু করে। তাদেরকে ধরার জন্য তারা তিন গ্রæপে বিভক্ত হয়ে তিনদিক থেকে এমবুশ করেন। দাঁতমারা শান্তিরহাটে এক গ্রæপ, সাপমারায় এক গ্রæপ এবং নারায়ণহাটের উত্তর পাশে নন্দীর স্কুলের মাথায় আরেক গ্রæপ অবস্থান নেয়। তাদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। কিছু পাকিস্তানি সৈন্য আটক করা হয়, যাদেরকে পরদিন যৌথ বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৮ ডিসেম্বর নারায়ণহাট হাইস্কুলে মাঠে সকাল ৭টায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন আনোয়ারুল আজিম। পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে ২০ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলো। বিজয়ের আনন্দে ভাসতে ভাসতে সেদিনই বিকেলে তিনি নাজিরহাট পৌঁছেন। কিন্তু সেখানে তখন প্রচন্ড যুদ্ধ চলছিলো।
তারা নাজিরহাট থেকে পিছিয়ে এসে বিবিরহাটে অবস্থান গ্রহণ করেন। রাত থেকে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর চতুর্মুখী আক্রমণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সামনে, যৌথ বাহিনী পেছনে। ১৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা সাদা পতাকা তুলে ক্যান্টনমেন্টের দিকে পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় নাজিরহাট বড় মাদ্রাসা, নাজিরহাট বাজার গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। নাজিরহাট ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টা/১১ টায় নৌকার ওপর গাছের গুঁড়ি দিয়ে ব্রিজ তৈরি করে হালদা নদী পার হয়ে বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে নাজিরহাটের হাটহাজারী অংশে পৌঁছেন নাজিরহাটের নেতা আনোয়ারুল আজিম।
আনোয়ারুল আজিমের স্ত্রীর নাম হাসিনা বানুু, তাঁদের ১ পুত্র, ১ কন্যা, কন্যার নাম জান্নাতুল নাইমা রেনি, এলএলবি অনার্সের ছাত্রী। পুত্রের নাম অম্লান হাসান, বিএসসি অনার্সের ছাত্র।
আনোয়ারুল আজিম মনে করেন স্বাধীনতা লাভের পর তাদের জাতিগতভাবে সামনে এগিয়ে যাবার যে সম্ভাবনা ছিলো, বঙ্গবন্ধু’র হত্যার ফলে তা থেকে জাতি বঞ্চিত হয়েছে। কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের অবাধ লুটপাটের ধারা ব্যাহত হবে বলেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। বিজয়ের অর্ধশতাধিক বছর পর এই দেশ এই স্বাধীনতা কাদের হাতে থাকবে, যারা এদেশের জন্ম দিয়েছে তাদের হাতে-না যারা এদেশ চায়নি তাদের হতে থাকবে এটাই তাঁর জিজ্ঞাসা। মানুষ তার প্রাপ্ত অধিকার, স্বাধীনতার সুফল যথাযথভাবে ভোগ করতে না পারলে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সব সময় হুমকির সম্মুখীন থাকবে। “নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের আবেদন ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান, ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম বিসর্জনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা অর্থবহ করে তোলার দায়িত্ব তাদের। যারা স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে, তারা আর কোন কিছু চাওয়ার জন্য আমাদের কাছে আসবে না। কিন্তু তাদের রক্তের প্রতি দায়বদ্ধতা আমরা যেন ভুলে না যাই। যাদের সুখী জীবনের জন্য তারা জীবন আত্মোৎসর্গ করেছে, তারাই একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করে জাতিকে দায়মুক্ত করবে এটাই আমাদের কামনা। গরিব কৃষক শ্রমিক, নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে”।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক