গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন
চট্টগ্রামকে বলা হয় বাণিজ্যিক রাজধানী। দেশের মহানগরের মধ্যে আকারের দিক দিয়ে ঢাকার পরই চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাশে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরের একদিকে পাহাড় ও অন্যদিকে সমুদ্র। দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরটি চট্টগ্রাম শহরেই। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা এসেছিলেন চট্টগ্রামে। তিনি এ শহরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। চতুর্দশ শতকে বাংলার সুলতানরা এ চট্টগ্রামে একটি টাকশাল স্থাপন করেছিলেন। চট্টগ্রাম নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর একটু আলাদা গর্ব আছে। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। তা শুধু এ কালে নয়, ১৯১৫ সালেই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেছিলেন, ‘শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-মহিমায় মহিমান্বিত বলিয়া নহে, অতি প্রাচীনকাল হইতে রাজনীতির সহিত ঘনিষ্ঠভাবে বিজড়িত থাকায়, চট্টগ্রাম রাজনৈতিক লীলাক্ষেত্র এবং ঐতিহাসিকের গবেষণার প্রকৃষ্ট স্থানও বটে।’ দেড়শ বছর আগে ব্রিটেনের নাগরিক আর্থার লয়েড তাঁর স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ লিভস ফ্রম আ ডায়েরি ইন লোয়ার বেঙ্গল-এ চট্টগ্রাম শহরের মনোমুগ্ধকর বর্ণনা দিয়েছেন ঠিক এইভাবে, ‘ভাটিবাংলার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা চাটগাঁ। নিচু টিলা, তার চূড়ায় বাড়ি, ঘুরে ঘুরে হেঁটে উঠতে হয়। কোনো কোনো পাহাড়ে বা টিলায় উঠলে চমৎকার সব দৃশ্য চোখে পড়ে। দূরে দিগন্তে কর্ণফুলী গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে, চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো পাহাড়ের চূড়ায় বিন্দুর মতো সাদা বাংলো।’ তিনি ১৮৭১ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত দুই দফায় চট্টগ্রামের কালেক্টর ছিলেন। একসময় চট্টগ্রামে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছিল। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে ছিল চট্টগ্রামে একটি বড় বসতি যা মগ দস্যুরা ধ্বংস করে দিয়েছে। এ জেলায় ছিল আরব আর বর্মিদের, আর ছিল পর্তুগিজ আর ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য। ঐতিহাসিকভাবে চট্টগ্রামকে বলা হয় প্রাচ্যের রাণী।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের যে কোন জেলার মত চট্টগ্রামেরও রয়েছে সমৃদ্ধ, গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।অন্তরঙ্গ- বহিরঙ্গ দুইভাবেই এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রকাশ উচ্চ,প্রকট, জোরদার, আন্তরিক ও গৌরবময়। যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গে তার প্রবলতর উপস্থিতি খুব সহজেই অন্য অঞ্চলের মানুষের চোখে পড়ে।
চট্টগ্রামের মানুষের অতিথিপরায়ণতার কথা সুবিদিত।আর অতিথি আপ্যায়নের কথা আসলে অবধারিতভাবে মেজবানের কথা চলে আসে।মেজবান যেন চট্টলার মানুষের বিশাল কলিজার পরিচয় দেয়। কোন উপলক্ষকে সামনে রেখে গরীব-দুঃখী,পাড়া- পড়শী ,আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের জন্য যে ভোজের আয়োজন করা হয় তার নাম মেজবান। ‘মেজবান’একটি ফারসি শব্দ। চট্টগ্রামের ভাষায় একে বলে ‘মেইজ্জান’। মতান্তরে কেউ কেউ ‘মেজ্জান’ ও লিখে থাকেন। মেজবান বা মেইজ্জান প্রকৃতপক্ষে কোনো আলাদা শব্দ নয়। মেইজ্জান হলো মেজবানের একটি আঞ্চলিক রূপ। ঠিক কবে থেকে মেজবানের প্রচলন হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, ১৫০০ কিংবা ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মেজবানের প্রচলন হয়ে আসছে। কেননা বিজয়গুপ্তের পদ্মপুরাণ কাব্যগ্রন্থে কবি শাহ বারিদ খানের রচনায় মেজবান শব্দটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই ‘মেজমান’ (আপ্যায়ন) এবং ‘মেজোয়ানি’ (আপ্যায়ন কারি) দুটি শব্দের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যা থেকে পরবর্তীতে ‘মেজবান’ শব্দটি কালের পরিক্রমায় আসে।
মেজবান যে খাবারের জন্য সব থেকে বেশি জনপ্রিয় তা হলো, বাবুর্চির হাতে রান্না করা গরুর মাংস। অন্যান্য জেলার গরুর মাংসের তুলনায় চট্টগ্রামের মানুষদের হাতে রান্না করা গরুর মাংসের স্বাদ আলাদা। তা ছাড়া গরু উৎপাদনের দিক দিয়ে ও চট্টগ্রাম পিছিয়ে নেই। মূলত চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, চন্দনাইশসহ সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে এ গরু উৎপাদন হয় বেশি। তবে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষেরা গরুর পরিবর্তে এখন ছাগল কিংবা মহিষ ও জবাই করেন মেজবান উপলক্ষে। গরম সাদা ভাতের সাথে মেজবানী গরুর মাংস খাওয়ার পর ওর স্বাদ আলাদা করা বুঝা যায়।শুধু যে মেজবানে গরুর মাংস রান্না করা হয় তা নয়।এছাড়া মেজবানে পরিবেশন করা হয় নলা কাঁজী, যার অন্য নাম নিহারী। নিহারী কাঁজী, একটু হালকা টক স্বাদযুক্ত হয়।এর সাথে পরিবেশন করা হয় ভুনা ডাল কিংবা মাসকলাইয়ের ডাল দিয়ে রান্না করা গরুর হাঁড়ের মাংস। অনেক সময় এতে বুটের ডাল ও ব্যবহার করা হয়। এছাড়া থাকে, লাউয়ের তরকারি। একসময় মেজবান চটগ্রামের সামাজিক গন্ডিতে সীমিত থাকলেও হালে দেশের নানা প্রান্তে মেজবান অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম শহরের বদরপাতি মহল্লার সরের জাহাজের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গোলাম রসুল সওদাগরের পুত্র আবদুল জব্বার ছিলেন কংগ্রেসী এবং স্বদেশী আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক।আবদুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ নিজ নামে লালদিঘির মাঠে বলীখেলার প্রবর্তন করেন। সে কারণে লালদিঘির খেলা বা মেলার চাইতেও জব্বারের বলীখেলা হিসেবেই এটি লোকমুখে সমধিক প্রসিদ্ধ।
আবদুল জব্বার সওদাগর বলীখেলাটি এখন চট্টগ্রাম বৃহত্তম বার্ষিক লোকউৎসব। চট্টগ্রাম কেন বাংলাদেশেও বোধ করি এত বড় খেলা ও মেলা দ্বিতীয়টি নেই। বলীখেলা দিয়ে শুরু হলেও পরে চট্টগ্রামের লোকশিল্প ও কৃষিজ পণ্যসামগ্রীর প্রদর্শন ও বেচাকেনাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলে এটি জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা হিসেবে পরিচিতি হয়ে ওঠে। নগরের আন্দরকিল্লা, বক্সিরহাট, লালদিঘি পাড়, কেসিদে রোড, সিনেমা প্যালেস, শহীদ মিনার সড়ক, কোতোয়ালি মোড়, জেল রোডসহ প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে এ মেলার বিস্তৃতি ঘটে।
সাম্পান শব্দটা এসেছে চীনা শব্দ ‘সাং পাং’ থেকে। এর অর্থ হচ্ছে তিন মাথা। সাধারণত নৌকা বা অন্যান্য নৌ-যানের দুটো মাথা বা গলুই থাকে। সাম্পানে গলুই থাকে তিনটি। সামনে একটা, পেছনে দুটো। পেছনের গলুই দুটো মেষের শিংয়ের মতো দু’ভাগে বিভক্ত। এ কারণেই এর নামকরণ করেছে সাম্পান। আরাকানি ভাষায় সাম্পানকে বলে ‘থাম্মান’। জাপানিরা বলে ‘জুমপেন’। মালয় ভাষায় বলে ‘সামপেন’। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘সাম্মান’।
কারো কারো মতে, সাম্পান একটি ক্যান্টনিজ শব্দ। এ ভাষায় ‘সাম’ অর্থ তিন এবং ‘পান’ অর্থ কাঠের টুকরো। এ থেকে সাম্পান নামের উদ্ভব। এর আভিধানিক অর্থ ‘তিন টুকরো কাঠ’। একটি সম্পূর্ণ কাঠের টুকরো দিয়ে চ্যাপ্টা তল, তার দুই পাশে আস্ত আরো দুটি টুকরো জোড়া দিয়ে চীনা সাম্পানের কাঠামো তৈরি হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের সাম্পান আস্ত কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় না। তাতে ব্যবহৃত হয় কাঠের সরু ফালি। চট্টগ্রামের সাম্পানের কিছু উপাদানের নকশা চীনা সাম্পানের মতো।
চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি লিখেছেন, ‘…মুসলমান কারিগরগণ সাম্পান প্রস্তুত করে। পুরাকালে এদেশে সাম্পানের ব্যবহার ছিল না; প্রথমতঃ রেঙ্গুন হইতেই ইহার আমদানী হয়। এখন ইহা এদেশে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হইতেছে। এবং প্রতি বৎসর ছোট বড় শত শত সাম্পান প্রস্তুত হয়। এ দেশীয় সাম্পানওয়ালারা ঐ সকল সাম্পানে করিয়া আকিয়াব, রেঙ্গুন, সুন্দীপ প্রভৃতি স্থানে গমনাগমন করে। পালসহযোগে ইহা স্টিমারের ন্যায় খুব বেগে চলে। পাল তুলিয়া পবন ভরে সাম্পান বহর যখন কর্ণফুলী নদী বাহিয়া সারি সারি চলিতে থাকে তখন দূর হইতে ইহার দৃশ্য বড় নয়ন মনমুগ্ধকর। বর্তমানে এত বড় বড় সাম্পানও তৈয়ার হয় যে তাহার এক একটিতে ২০০০ আড়ি ও ততোধিক ধানের বোঝাই করিতে পারা যায়।’
‘সাম্পানের ‘কেঁ..কুরুত… কেঁ…কুরুত’ শব্দটা হালিশ চালানোর সময় ককিয়ে ওঠার শব্দ। সাম্পানের পেছনের দিকে দুই পাশে দুটি খুঁটি আটকানো থাকে। সেই খুঁটি দুটির সঙ্গে বেতের আংটা দিয়ে হালিশকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। মাঝি দাঁড়িয়ে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে দুই হাতে হালিশে চাপ দিলে বেত আর কাঠের সংঘর্ষে ‘কেঁ…কুরুত… কেঁ…কুরুত’ শব্দের সৃষ্টি হয়। এ শব্দটি চট্টগ্রামের সাম্পানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।
শুঁটকি মাছ পছন্দ করে না, এমন বাঙালি সম্ভবত বিরল।গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শহর পর্যন্ত সবার কাছেই শুঁটকির সমান কদর।আমাদের দেশে একেক সময় একেক ধরনের শুঁটকি পাওয়া যায়। বিশেষ মৌসুমে শুঁটকি তৈরির ধুম পড়ে উপক‚লীয় এলাকায়। চট্টগ্রামের শুঁটকি নিয়ে অন্যান্য জেলাতেও বেশ সুনাম রয়েছে। সারিবদ্ধভাবে শুঁটকি শুকাতে দেখা যায় শহরের কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে। কর্ণফুলী ছাড়াও চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকায় বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি বানানো হয়ে থাকে। কর্ণফুলী নদীর উত্তর-দক্ষিণ তীরঘেঁষা বাকলিয়া, ইছানগর, ডাঙ্গারচর, কর্ণফুলী ঘাট ও জুলধায় গড়ে উঠেছে এ খাতের বিভিন্ন পল্লীগুলো। বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া, কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকার গভীর সমুদ্র থেকে জেলেদের সংগ্রহ করা মাছ কর্ণফুলীর তীরে আনা হয়। শ্রমিকের সহজলভ্যতা এবং নৌপথ যোগাযোগের সুবিধার ভূমিকা রয়েছে এতে। এছাড়া কক্সবাজার, মহেশখালী, মাইশদিয়া, কুতুবদিয়া, কর্ণফুলী, চরচাক্তাই, রাঙাবালি অঞ্চলে শুঁটকি উৎপাদনের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত হয়ে থাকে।
বিস্কুটের কথা আসলে বেলা বিস্কুটের কথা বলতেই হবে। বড় সাইজের শক্ত এ বিস্কুটের কদর একসময় চট্টগ্রামবাসীর ঘরে ঘরে ছিল।সকালের নাস্তায়, স্কুলের টিফিনে, বিকালের হাল্কা নাস্তায় চায়ের সাথে বেলা বিস্কুট ছাড়া চট্টগ্রামবাসীকে ভাবা যেত না। কালের ছোঁয়ায় খাদ্যাভাসের পরিবর্তনে বেলা বিস্কুটের আগের অবস্থান না থাকলেও এখনো বিশেষ একটি অবস্থান ধরে রেখেছে। কথাসাহিত্যিক আবুল ফজলের আত্মজীবনী ‘রেখা চিত্রে’ শৈশব কৈশোরকালের একটি লাইন এ রকম ‘ঘুম থেকে উঠে পান্তাভাতের বদলে খাচ্ছি গরম-গরম চা বেলা কি কুকিজ নামক বিস্কুট দিয়ে। কুকিজ ইংরেজি নাম বেলা কিন্তু খাস চাটগেঁয়ে।’
চট্টগ্রামের রয়েছে বহু প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য, কিংবদন্তি এবং উত্তরাধিকার। আজ থেকে দু’হাজার বছর আগেই গ্রীক বণিকেরা চট্টগ্রামে বাণিজ্যতরী পাঠিয়েছিল। ভিনদেশিদের চট্টগ্রামে আগমনের এই ধারা অব্যাহত থাকে মধ্যযুগ হতে আধুনিক কাল অবধি। আরাকান হতে বৌদ্ধ, ত্রিপুরা হতে হিন্দু, আরব ও মধ্য এশিয়া হতে মুসলমান, পর্তুগাল, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের নানা দেশ হতে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী ভাগ্যান্নেসিরা প্রাকৃতিক এই সমুদ্র বন্দর দিয়ে একে একে প্রবেশ করেছে বাংলায়। মসলা, মসলিন আর মুক্তোর নেশায় কর্ণফুলীর তীরে জাহাজ ভিড়িয়েছে পৃথিবীর তাবৎ দেশের বণিকরা। এ সকল জাতিগোষ্ঠি ও ধর্মাবলম্বীদের সকলেই পায়ের চিহ্ন রেখে গিয়েছে এই শহরের বুকে, আনাচে কানাচে। কিছু চিহ্ন হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে, কিছু রয়ে গেছে মহাকালের সাক্ষী হয়ে। এ পথ দিয়ে চলে যাওয়া পথিকগণের স্মৃতি চিহ্ন টুকুকেই আমরা লালন করি ‘ঐতিহ্য’ বলে।
লেখক : গবেষক ও ডেপুটি রেজিষ্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার