জাহিদুল করিম কচি
বাংলাদেশের জাতীয় পরিসরে অসাধারণ নেতৃত্বগুণ থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ আঞ্চলিক উন্নয়নে সর্বাধিক ভূমিকা পালন করেন। তাদের মধ্যে একজন কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল্লাহ আল নোমান। হাজার বছরের গৌরবদীপ্ত এবং ঐতিহ্য বহনকারী চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, অবকাঠামো উন্নয়নসহ সামষ্টিক অগ্রগতিতে এক অমূল্য রতœ আব্দুল্লাহ আল নোমান রেখেছেন অসাধারণ অবদান।
বেশিরভাগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, ভদ্র ও রুচিশীল, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদ হিসেবে সমধিক পরিচিত আব্দুল্লাহ আল নোমান অদম্য সাহস, সাংগঠনিক নৈপুণ্যতা, প্রবল দেশপ্রেম, আদর্শবান নেতা হিসেবে সকলের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, মনন ও জীবনব্যাপী ছিল চট্টগ্রামের উন্নয়ন, ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা।
এতদঞ্চলের অজগ্র নেতাকর্মীর সাথে ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা, প্রতিশ্রুতি, ভরসাময় যোগাযোগ ছিল অতুলনীয়। প্রাজ্ঞ ও জনবান্ধব রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ আল নোমান ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি এলাকা থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ষাটের দশকের শুরুতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নোমান যোগ দিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নে। মেননপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ছাত্রজীবন শেষে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে যোগ দেন শ্রমিক রাজনীতিতে। পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ছিলেন আব্দুল্লাহ আল নোমান। গোপনে ভাসানীপন্থি ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত হন। ১৯৭০ সালে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে জাতি তাঁর অবদান শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ রাখবে। যুদ্ধ শেষে আবারও ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। ১৯৮১ সালে শহীদ জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের পর তিনি যোগদেন দলটিতে। চট্টগ্রামের বহুমাত্রিক উন্নয়নে তিনি ছিলেন সদা সজাগ এবং উদগ্রিব। বিশেষত শিক্ষার মানোন্নয়নে আন্তরিক প্রয়াস এবং তার সাথে শিক্ষা বোর্ডের প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলাÑ এসব ছিল তার বৃহত্তর স্বপ্নের সুনিপুণ বাস্তবায়ন।
তিনি ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’র যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ৯০ এর গণআন্দোলনে শহীদদের স্মরণে বাকলিয়ায় শহীদ এনএমজে ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠার অবদান ইতিহাসে চিরজাগরুক থাকবে।
বহুমাত্রিক উন্নয়নসমূহের মধ্যে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীতে উন্নীতকরণের ঘোষণা, তৃতীয় কর্ণফুলী পিলার সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করতে সরকারকে বাধ্য করা, চট্টগ্রাম টিভি কেন্দ্র স্থাপন, বিশ্বমানের চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণ, ১৯৯৫ সালে মাস্টার প্ল্যানের প্রণয়ন, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নির্মাণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তার সময়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জেনারেল হাসপাতালের উন্নয়নও ত্বরান্বিত হয়েছে। জনহিতৈষী এবং পরোপকারী আব্দুল্লাহ আল নোমান মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা, কবরস্থান, খেলার মাঠ, ছোট-বড় রাস্তা, নালা-নর্দমা নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নগরীর প্রভূত উন্নয়ন সাধনে কার্যকর ভূমিকা রাখেন।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিএনপিকে সাংগঠনিক নৈপুণ্যতায় সংঘটিত করার কাজটি তিনি নিজ হাতে করেছেন। তার হাত ধরেই তৈরি হয়েছে অনেক নেতা। চট্টগ্রাম বিএনপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন বহু বছর। দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিবও ছিলেন একসময়। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। একটি বাসযোগ্য এবং পরিকল্পিত চট্টগ্রাম নগরী গড়তে নিরন্তর প্রচেষ্টা ছিল তার। সিটি গভর্নমেন্ট ছাড়া নাগরিক সেবা পুরোপুরি দেয়া সম্ভব নয় মনে করতেন তিনি। সবসময় নগরীর উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রাখার দাবি রাখতেন আব্দুল্লাহ আল নোমান। সাধারণ চলন প্রবাহের মধ্যে তিনি পরিণত হয়েছেন একটি প্রতিষ্ঠানে।
সৃজনে, মননে, নিজ কর্মগুণে অনন্য মানুষে উপনীত হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ আল নোমান। গুণগত মানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ করতে হলে, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে যারা রাজনীতি করতে চান তাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে এই নেতার কর্মময় জীবন। চট্টগ্রামের উন্নয়ন-অগ্রগতির ইতিহাসে তার রেখে যাওয়া অবদানগুলো চিরকাল মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে।
(আমরা চাটগাঁবাসীর উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারের মূল প্রবন্ধ হিসেবে আজ উপস্থাপন হবে।)
লেখক : সদস্য সচিব, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব