চট্টগ্রাম আদালত ভবন নানা কারণে প্রায় সময় পত্রিকার শিরোনাম হয়ে আসছে। আদালত ভবনে বিচার প্রার্থী, আসামি, আইনজীবী থেকে সাধারণ মানুষ কেউ যেন নিরাপদ নয়। কিছুদিন আগে একজন তরুণ আইনজীবীর বর্বর হত্যাকাÐকে কেন্দ্র করে পুরো চট্টগ্রামে গৃহদাহ শুরু হওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সাইফুল ইসলাম নামে এ আইনজীবী আদালতের কাজ সেরে বাসায় ফেরার পথে হত্যা করে দুস্কৃতকারীরা। এ ঘটনার পর মহানগর এপিপি অ্যাডভোকেট নেজাম উদ্দিনের সই জাল করা ওকালত নামাকে কেন্দ্র করে তোলপাড় চলে আদালতে। এসব ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আদালত ভবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র হারিয়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে। যা চট্টগ্রাম আদালত ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে আবারও প্রশ্নের উদ্রেক করে। চট্টগ্রামের ইতিহাসের অংশ এ আদালত ভবন যা পরির পাহাড় নামেও বেশ পরিচিত। এ ভবনে রয়েছে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ সরকারের বিচারিক আদালতের কর্মকর্তাদের অফিস। রয়েছে দেশ ও জাতির গুরুত্বপূর্ণ নথি। কয়েকশত বছরের ভূমিসহ মামলার হাজার হাজার নথি এ আদালতে রয়েছে। এ আদালত ভবন থেকে নথি গায়েব হবার বিষয়টি আইনজীবীরা রহস্যজনক বললেও বাস্তবে কেন বা কারা এ নথি গায়ের করেছে, তা তদন্ত করে বের করার দাবি রাখে। গত জুলাই আগস্টেও ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর দেশের অধিকাংশ থানা জ্বালিয়ে দেয়ার ফলে অপরাধের অনেক নথি ও তথ্য এমনিতেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এর মেধ্যে আদালত থেকে নথি গায়েব হওয়ার ঘটনার পশ্চাদে বাস্তবতা কী? তা খুঁজে বের করা জরুরি। সবচেয়ে রহস্যের কথা গায়েব হওয়া নথিগুলো কোন লকারে বা কক্ষের ভিতর ছিল না, ছিল রুমের বাইরে পলিথিন মুড়ানো অবস্থায়। যে জায়গায় নথিগুলো ছিল সেইখানে কিন্তু সিসিটিভি ক্যামরাও ছিল না। গায়েব হওয়ার সময় আদালত শীতকালনী অবকাশের বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে যারা এ নথিগুলো গায়েব করেছে, তারা অবশ্যই সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। আমরা মনে করি, এ সুযোগটি আদালতের নিরপত্তায় নিয়োজিত দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতার কারণেই হয়েছে। এ দায় তাদের অবশ্যই নিতে হবে। গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম আদালতের এক হাজার ৯১১টি মামলার নথির (কেস ডকেট বা সিডি) খোঁজ মিলছে না। আইনজীবীরা বলছেন, নথি গায়েব হওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক। পুলিশ বলছে, কোতোয়ালি থানায় জিডি করার পর থেকেই তদন্ত শুরু হয়েছে। রুমের বাইরে যেখানে নথিগুলো রাখা ছিল সেখানে সিসি ক্যামেরা ছিল না। তবে মহানগর আদালতের পিপি বলছেন, এসব নথি হারানোয় মামলার বিচারকাজে তেমন প্রভাব ফেলবে না। নথি হারানোর ঘটনায় রবিবার চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মফিজুল হক ভুঁইয়া। চট্টগ্রাম আদালতের সিনিয়র আইনজীবী ও সচেতন নাগরিক কমিটি চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ফৌজদারি মামলা বিশেষ করে পুলিশ কেস যেগুলো, সেগুলোতে কেস ডকেট মামলা বিচার এবং প্রমাণের জন্য অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এই মামলাগুলো বিচারাধীন। মামলার অপরিহার্য অংশ কেস ডকেট এরকম অরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয় শুনে আমরা বিস্মিত ও হতবাক।’ কোতোয়ালি থানার ওসি আবদুল করিমের ভাষ্য মতে, বস্তায় ভরে নথিগুলো পিপি কার্যালয়ের সামনে রাখা ছিল। আদালতের অবকাশকালে অফিস বন্ধ থাকায় গত ১৩ থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নথিগুলো হারিয়ে গেছে বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে। জিডিতে বলা হয়েছে, মহানগর পিপি অফিসে প্রায় ২৮-৩০টি আদালতের কেস ডকেট রক্ষিত ছিল। পিপি অফিসের জায়গা স্বল্পতার কারণে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল পিপি অফিসের সামনের বারান্দায় প্লাস্টিকের বস্তায় এক হাজার ৯১১ কেস ডকেট পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় রক্ষিত ছিল। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) শাকিলা সুলতানা জানান ‘এগুলো মামলার সিডি। সিডির ডিজিটাল কপি সংরক্ষিত থাকে। এখান থেকেও তা পুনরুদ্ধার করা যাবে।’
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মফিজুল হক ভুঁইয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এগুলো বাইরে ডাম্পিং অবস্থায় ছিল, কে বা কারা নিয়ে গেছে। এই জন্য আমি জিডি করেছি। এগুলো বর্তমানে মামলার বিচারকাজে কোনো প্রভাব ফেলবে না। গুরুত্বপূর্ণ এসব নথি আদৌ উদ্ধার হবে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। তবে আদালতের সাথে সংশ্লিষ্টদের দাবি চট্টগ্রাম আদালত ভবন এখন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছে। এ ভবনে যেখানে অপরাধের বিচার হয়, সেখানে কিন্তু অপরাদ সংঘটিত হচ্ছে। এটি কারো জন্য ভালো লক্ষণ নয়। আদালতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পারন করতে হবে।