‘চট্টগ্রামকে ক্লিন গ্রিন ও হেলদি সিটি হিসেবে গড়তে চাই’

0

পূর্বদেশ : মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এক বছর কেমন সময় কাটালেন?
মেয়র : দীর্ঘ ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে দেশ মুক্ত হওয়ার পর একটি ‘বিশেষ সময়ে’ বলতে গেলে দেশের টালমাটাল অবস্থার মধ্যে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে যদি বলি, শুরু থেকেই দায়িত্ব পালন ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জের মতো। কারণ, দেশ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়ে মানুষের দীর্ঘদিনের জমে থাকা আশা-আকাক্সক্ষার ঢেউ আসছিল একের পর এক। কিন্তু আমি এই শহরে বেড়ে উঠা একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে যেহেতু আমার জানাশোনা-অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাই সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পেরেছি। আমি সে জন্য আমার টিমকে ধন্যবাদ জানাবো এবং নগরবাসীকে ধন্যবাদ জানাই, তারা দায়িত্ব পালনে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছেন।
পূর্বদেশ : চট্টগ্রাম শহরের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা, দীর্ঘদিন ধরেই বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতে নগরী পানির নিচে তলিয়ে যায়। গত এক বছরে এই সমস্যা সমাধানে কি করতে পেরেছেন?
মেয়র : নগরীর জলাবদ্ধতার সমস্যা দীর্ঘদিনের। এটি কোনো প্রাকৃতিক সমস্যা নয়, এটি মানবসৃষ্ট ব্যাপার। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন ১৫-২০ বছর আগে শহরের জলাবদ্ধতা হলেও তা এতটা প্রকট ছিল না। এই সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে খাল দখল করে প্রভাবশালীরা বাড়িঘর তৈরি করেছে, নালা-নর্দমা দখল করে দোকানপাট নির্মাণ করেছে, আর নগর সংস্থার যেখানে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানোর কথা, তা করেনি। তার ওপর গত এক দশক ধরে ছিল প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যরে অত্যাচার। সব মিলিয়ে জলাবদ্ধতার রূপ ভয়াল হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ’র অধীনে মেগা প্রকল্পের কাজ চলছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন সেটা বাস্তবায়ন করছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর আমার প্রচেষ্টাকে তাদের কাজে সাথে যুক্ত করেছি। আমি নিজে বিভিন্ন স্পটে গিয়ে নগরীর খালগুলো উদ্ধার এবং পরিষ্কার করার জন্য কর্পোরেশনের কাজের গতি বাড়িয়েছি। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ১৬শ কিলোমিটার নালা পরিষ্কার করা হয়েছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবার বর্ষার শেষের দিকে আপনারা দেখেছেন, ভারী বৃষ্টিতেও শহর খুব একটা ডুবেনি। জলাবদ্ধতা নিরসনে ইতোমধ্যে প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ অগ্রগতি অর্জন করেছি আমরা। মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আশা করছি জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে নগরী মুক্তি পাবে।
পূর্বদেশ : শহরের পরিচ্ছন্নতা ও আলোকায়ন সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এ ব্যাপারে কতটুকু সফল হয়েছেন বলে মনে করেন?
মেয়র : চট্টগ্রাম শহরকে ক্লিন, গ্রিন, হেলদি ও নিরাপদ শহর হিসেবে গড়ে তোলা-ই আমার প্রধান লক্ষ্য। ক্লিন সিটি করতে গেলে শহরের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম সঠিকভাবে করতে হবে। দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি দেখলাম শহরকে পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন রাখতে হলে আমাকে কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ নগরীর বাসিন্দাদের ময়লা-আবর্জনা ফেলার ব্যাপারে সচেতনতা নেই, তারা ইচ্ছেমতো ড্রেন-নালা কিংবা খালে ময়লা ফেলে, সেটা একদিকে পরিবেশ দূষিত করে। অন্যদিকে জলাবদ্ধতারও কারণ। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশন যে পরিমাণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে, তার বাইরে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নানাভাবে থেকে যায়। এই অবস্থায় আমরা ‘ডোর টু ডোর’ বর্জ্য সংগ্রহ কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। ইতোমধ্যে ৪১টি ওয়ার্ডে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা ঘরে ঘরে গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করছে। তার জন্য একটি নির্দিষ্ট সেবা ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে গতি এসেছে। আর আলোকায়ন নিয়ে কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগ কাজ করছে, কোথাও সমস্যা হলে সেটা দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে।
পূর্বদেশ : কিন্তু এই ডোর টু ডোর বর্জ্য ব্যবস্থার ফি নিয়ে অসন্তোষ দেখা গেছে, এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি?
মেয়র : আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি সিস্টেম আমরা গড়ে তুলছি। শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে গেলে এই সিস্টেমে যেতে হবে। পৃথিবীর কোথাও বাসা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় না, সবাইকে নিজের ঘরের বর্জ্য নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে গিয়ে ফেলে আসতে হয়। আমরা এই সিস্টেম গড়ে তুলছি যে, আপনার ঘর থেকে বর্জ্য নিয়ে যাবে। তার জন্যই একটি নির্দিষ্ট ফি দিচ্ছেন। শতভাগ পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে ডোর টু ডোর বর্র্জ সংগ্রহ প্রকল্পের বিকল্প নেই। আগে বাসা বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা ছিল না। অনেকেই ইচ্ছামতো টাকা নিত। এখন বাসা প্রতি সর্বোচ্চ ৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, কেউ অতিরিক্ত টাকা নিলে সেই প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করা হবে। তবে আশার কথা হলো, আমরা বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন শুরু করেছি, প্রাথমিকভাবে এটি সফল হলে বিনামূল্যে নগরীর প্রতিটি ঘর থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হবে। হয়তো মাস ছয়েক নগরবাসীকে এই অর্থটা খরচ করতে হচ্ছে।
পূর্বদেশ : ‘ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি’র ধারণা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।
মেয়র : শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবেÑএই পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য যুগোপযোগী কৌশল-পদক্ষেপ নিতে হবে। সেটা আমরা করছি। এই যে ডোর টু ডোর করলাম; যাতে বাসাবাড়ির আবর্জনা খালে না যায়, রাস্তায় জমে না থাকে। নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জে রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হলেও চসিক সর্বোচ্চ ২২০০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারছে, বাকি প্রায় ৮০০ টন বর্জ্য নানা উপায়ে খাল, নালা হয়ে কর্ণফুলি নদীতে গিয়ে পড়ছে, যা মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় চসিক নতুন একটি ল্যান্ডফিল্ড ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমান দুটি ডাম্পিং স্টেশন হালিশহর ও আরেফিন নগর ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। যে কোনো সময় সেগুলোতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় চসিক ইতিমধ্যে নতুন একটি ল্যান্ডফিল্ড স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ জন্য ২০২৩ সালে হাটহাজারীর জঙ্গল দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজায় প্রায় ৫০ একর জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৯.৫০ একর জমি ইতিমধ্যে ক্রয় করা হলেও মালিকদের অনীহার কারণে বাকি জমি ক্রয় সম্ভব হয়নি। ফলে বিকল্প হিসেবে একই মৌজার পার্শ্ববর্তী সমতল ও টিলা শ্রেণির প্রায় ৪০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরিচ্ছন্নতার স্বার্থে এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হলে শহর ক্লিন সিটি হবে।
গ্রিন ও হেলদি সিটির ধারণাটি আরও জীবন ঘনিষ্ঠ ব্যাপার। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করা গেলেই মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারবে। এই শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। শহরে সবুজায়ন দরকার, গাছ লাগানো দরকার। কারণ, গাছ আমাদের পরম বন্ধু। আমরা ইতোমধ্যে ‘দশ লাখ চারা গাছ লাগানোর কর্মসূচি’ হাতে নিয়েছি এবং ৪১টি ওয়ার্ডে সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও এনজিওদেরও এ কাজে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে অনুমতি ছাড়া গাছ কাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, আমাদের দেশেও এ বিষয়ে কঠোর আইন প্রয়োজন। নির্বিচারে গাছ ও পাহাড় কেটে ফেলার ফলে প্রকৃতি আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ধস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ তারই ফল। তাই পরিবেশবান্ধব নগর গঠনে নো প্লাস্টিক নো পলিথিন নীতি অনুসরণ করতে হবে এবং ময়লা আবর্জনাগুলো ওয়েস্ট টু এনার্জি প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস বা সার উৎপাদন ব্যবস্থা অপরিহার্য। আমরা কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি, যাতে ময়লাকে সম্পদে পরিণত করা যায়। শহর ক্লিন ও গ্রিন হলে সেটি হেলদি সিটি হয়ে উঠবে।
পূর্বদেশ : সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি কেমন হয়েছে?
মেয়র : দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। ফলে রাজস্ব আদায়ে গতি এসেছে। এর মধ্যে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা পৌরকর আদায় করেছি আমরা। নগরবাসীর মৌলিক অধিকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বছরে ৭০ কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিচ্ছি আমরা। দায়িত্ব গ্রহণের পরই এ সেবাগুলো সচল রাখতে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে জোর দেই। বন্দর থেকে পৌরকর আদায়ের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে তদবির করি। ১০০ কোটি টাকা পাওয়ার ফলে নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি নাগরিক সেবা বাড়াতে পারব।
পূর্বদেশ : সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কথা এসেছে, গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি খাতে গত এক বছরের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই
মেয়র : দেশে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনই একমাত্র সেবাসংস্থা যে, অন্যান্য সেবার পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। আগেই বলেছি এই দুই খাতে বছরে ৭০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছি। দেশে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্কুলগুলোতে ‘স্কুল হেলথ কার্ড’ কার্যক্রম চালু করেছি। এ কার্ডের আওতায় শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বিভিন্ন ধরনের সেবা পাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে কর্পোরেশনের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা চালু করা হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, সিটি কর্পোরেশনের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে অনেকে অস্থায়ীভাবে কাজ করছিলেন। দীর্ঘদিন চাকরি করেও তারা ন্যায্য বেতন-ভাতা না পেয়ে হতাশ ছিলেন। এই ধরনের ২৫২ জন অস্থায়ী শিক্ষকের চাকরি স্থায়ী করেছি, স্বাস্থ্য বিভাগের ৭০ জনকে স্থায়ী করা হয়েছে। এই কাজটি অনেক বড় একটি মানবিক উদ্যোগ ছিল। শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর, তারা যদি নিজেদের চাকরির নিশ্চয়তা, বেতন-ভাতার নিশ্চয়তা না পান তাহলে পাঠদানে ব্যাঘাত ঘটবে। তাই বিষয়টি মানবিকভাবে চিন্তা করে দ্রæততার সাথে সমাধান করা হয়েছে।
পূর্বদেশ : নগরীতে খেলার মাঠ, শিশুপার্ক কিংবা বিনোদন কেন্দ্র পর্যাপ্ত নেই। এ কারণে শহরের শিশুরা প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তারা ঘরবন্দী জীবনযাপন করছে। এ সমস্যা সমাধানে আপনার উদ্যোগ কি?
মেয়র : খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন এটি। আজকের শিশুরাই আগামীর বাংলাদেশ। এই প্রজন্মের শিশুদের জন্য সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে জাতির সুন্দর ভবিষ্যৎ আশা করা যায় না। আমি বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। আমি এ ব্যাপারটি সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ তৈরি করবো, ইতোমধ্যে ১১টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিদ্রোহের স্মৃতিধন্য ষোলশহর বিপ্লব উদ্যানকে সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছি, আগের প্রশাসন এটিকে বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করেছিল। এখন সেটির সংস্কার কাজ চলমান, এটি সবার জন্য উন্মুক্ত প্রাকৃতিক স্থান হিসেবে থাকবে। আগ্রাবাদ শিশুপার্ক কিছু দিনের মধ্যেই চালু হতে যাচ্ছে, পাঁচলাইশের জাতিসংঘ পার্ক উন্মুক্ত করা হয়েছে। মহসিন কলেজের মাঠসহ বেশকিছু স্কুলের মাঠ নতুন করে সংস্কার করছি। আশা করছি, এভাবে আমরা শহরে শিশুদের জন্য খেলাধুলার পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা করতে পারব।
পূর্বদেশ : শহরে যানজট খুব বেড়েছে, ইদানীং প্রায়ই দীর্ঘ যানজটে মানুষের চরম ভোগান্তি হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার কোনো উদ্যোগ আছে?
মেয়র : নগরীর যানজট নিরসনে ট্রাফিক বিভাগ নিষ্ঠার সাথে কাজ করছে। যানজটের সাথে বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থার সম্পৃক্ততা আছে। তাদের সাথে সমন্বয় করেই সিটি কর্পোরেশন কাজ করে। আমি তাদের নিয়ে অনেকবার সভা করেছি, নির্দেশনা দিয়েছি। যানজট নিরসনে সবার অংশগ্রহণ ও দায়িত্ববোধ জরুরি। এজন্য পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও ট্রাফিক বিভাগের সমন্বয়ে একটি ‘যানজট নিরসন কমিটি’ গঠন করা হবে। এতে পারস্পরিক সমঝোতা ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পাবে। শৃঙ্খলা বজায় রাখলে শহরকে সহজেই যানজটমুক্ত করা সম্ভব।
সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে কর্ণফুলী এলাকায় নতুন বাস টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভূমি সংক্রান্ত কিছু মামলার কারণে তা আটকে আছে। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে এবং দ্রæত সমাধানের চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য হলো, চট্টগ্রাম নগরকে একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ, সুন্দর ও যানজটমুক্ত শহরে রূপান্তর করা। এ জন্য সকল সংশ্লিষ্ট পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য।
পূর্বদেশ : শুধু বর্জ্য অপসারণই তো পরিচ্ছন্নতা নয়, আরও অনেকভাবে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার উদ্যোগ কী?
মেয়র : আপনি ঠিকই বলেছেন। নগরীর বিভিন্ন স্থানে অনুমতিবিহীন পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও সাইনবোর্ডের মাধ্যমে নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এটার বিরুদ্ধে আমি নিজেই মাঠে নেমেছিলাম। আমি নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে বেআইনি পোস্টার, ব্যানার, সাইনবোর্ড উচ্ছেদ করি। ক্লিন সিটি গড়তে আমরা বদ্ধপরিকর। আমরা চাই শহরকে সুন্দর রাখতে সবাই যেন সচেতন হয়। যারা অনুমতি ছাড়া ব্যানার-পোস্টার টানাচ্ছে, তারা যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেগুলো সরিয়ে ফেলে। ভবিষ্যতে অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের পোস্টার, ব্যানার বা সাইনবোর্ড টানানো হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মনের তাগিদ থেকে আমি নিজে প্রতি মাসে অন্তত একবার মাঠে নামি এই ধরনের অভিযান পরিচালনার জন্য। কারণ, এই শহর আমাদের নিজের শহর। যদি আমরা নিজের শহরের প্রতি দায়িত্বশীল হই, তাহলে কেউই শহরকে নোংরা করতে পারবে না। ব্যানারের কারণে কত সুন্দর দৃশ্য ঢেকে গেছেÑসবুজ গাছপালা রাস্তার সৌন্দর্য। এসব সরানোর পরই বোঝা যায় শহর কত সুন্দর হতে পারে।
পূর্বদেশ : নগরীর ফুটপাতগুলো পাশের দোকানিরা দখল করে রাখে, তারপর রাস্তায় বাজার বসায় হকাররা, সড়কের মাঝখান দিয়েই চলাচল করতে হয় পথচারীদের। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
মেয়র : বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন ধরেই শহরের ফুটপাতগুলো নানাভাবে দখল হয়ে আছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ফুটপাত দখলমুক্ত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে আসছি। সিটি কর্পোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন। আপনারা দেখেছেন, আমি নিজেই উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছি। বিভিন্ন সড়কে গিয়ে দোকানিদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি, সতর্ক করেছি যেন ফুটপাত তারা দখল না করে। গত সপ্তাহেও আমি নিজে স্টেশন রোড এলাকায় গিয়ে সেখানকার ফুটপাত থেকে দোকানিদের পণ্য সরিয়ে দিয়েছি, তাদের সতর্ক করেছি। তবে দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের অভিযান টিম চলে আসলেই তারা আবারও ফুটপাত দখলে নিয়ে নেয়। এ জন্য আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার, ফুটপাত দখল করলে যে একদিন সে নিজেও সড়কে কোনো দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে, তা যদি বুঝতে পারে তাহলেই প্রকৃত পরিবর্তনটা আসবে।
পূর্বদেশ : চট্টগ্রাম একটি পর্যটন সম্ভাবনার শহর কিন্তু অবকাঠামোগত নানা ধরনের সংকটের কারণে পর্যটন আশানুরূপ বিকশিত হয়নি। পতেঙ্গা সৈকতের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে গেলে সেখানে নানা ধরনের উৎপাতে পর্যটকরা হয়রানির শিকার হন। আপনার মন্তব্য কী?
মেয়র : আপনি যেহেতু পতেঙ্গ সৈকতের উদাহরণ দিয়েছেন আমি আগে সেটা নিয়েই কথা বলতে চাই। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত চট্টগ্রামের পর্যটনের একটি সম্ভাবনাময় খাত। এটিকে সুন্দরভাবে ব্যবস্থাপনা করা গেলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পটে পরিণত করা সম্ভব। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন, এই ব্যবস্থাপনা নিয়ে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত যাতে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন স্পট হয়ে উঠে সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছি। আমি সিডিএ ও জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করেছি, সেখান থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি, দোকানগুলো কীভাবে নিয়ম মেনে ব্যবসা করবে তার একটি গাইডলাইন আমরা তৈরি করে দিচ্ছি। সৈকতে বিশৃঙ্খলভাবে যাতে কোনো দোকান না বসে তার জন্য কঠোর মনিটরিং করা হচ্ছে, কয়েকদিন পর পর আমরা সেখানে অভিযান চালাচ্ছি। পর্যটকরা যাতে হয়রানির শিকার না হন সে ব্যাপারে ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করছে, ভবিষ্যতে তাদের সাথেও সিটি কর্পোরেশন সমন্বয় করার চেষ্টা করবে। গত কয়েকদিন আগেও আমি সেখানে গিয়ে অবৈধভাবে বসানো দোকানপাট তুলে দিয়েছি। আমরা একটা নিবিড় মনিটরিংয়ের আওতায় এনে পতেঙ্গাকে বিশ^মানের পর্যটন স্পটে পরিণত করতে চাই। একইভাবে চট্টগ্রামের অন্যান্য পর্যটন স্পটগুলোও কীভাবে নতুন করে সাজিয়ে তোলা যায়, পর্যটকবান্ধব করা যায় তার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে।
পূর্বদেশ : আপনার ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা কি?
মেয়র : আমার ভিশন হচ্ছে চট্টগ্রামকে ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি করা। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে সার্বিক দিক থেকে মনিটরিং জোরদারের জন্য ‘আমাদের চট্টগ্রাম’ নামক একটি অ্যাপস চালু করতে যাচ্ছি। এই অ্যাপসের মাধ্যমে ১০ ধরনের সেবা নগরবাসী ঘরে বসেই পেয়ে যাবে এবং আমাদের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে। যেমন নগরীর কোথাও যদি কোনো নাগরিক ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখেন, রাস্তাঘাট ভাঙা দেখেন তিনি এই অ্যাপস ব্যবহার করে একটি ছবি তুলে দিলেই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা দ্রæত স্পটে গিয়ে তার সমাধান করবে।
আমরা ইতোমধ্যে বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনের কার্যক্রম শুরু করেছি, খুব দ্রæতই তার একটি পজিটিভ ফলাফল পেয়ে যাবো। দেশের প্রথম মনোরেল স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে, সেটা করা সম্ভব হলে শহর থেকে যানজট একেবারেই নির্মূল হয়ে যাবে।
বর্ষা শেষ হতে চলেছে, এখন রাস্তাঘাটে উন্নয়নের কাজ শুরু হবে। শীঘ্রই নগরীর ৫০টি বড় বড় সড়কের সংস্কার কাজ শুরু হবে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে আমি নগরবাসী সহযোগিতা চাই।
পূর্বদেশ : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মেয়র : আপনাকেও ধন্যবাদ।