নিজস্ব প্রতিবেদক
উপকূলে বিপদের মাস মে। এই মাস আসলেই উপকূলবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বাড়ে। গত দুই দশকে যত ঘূর্ণিঝড় হয়েছে বেশিরভাগই মে মাসে। যে কারণে এই মাসে আবহাওয়ার সতর্ক সংকেত জারি হলেই নিদ্রা হারায় উপকূলের মানুষ। গত এক সপ্তাহ ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’ ও ‘মন্থার’ প্রভাব থাকায় উপকূলের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যায়। যদিও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়ের গতি কমায় এ যাত্রায় বিপদ কিছুটা কমেছে। তবে আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহ পার হলেই ঘূর্ণিঝড় আতঙ্ক কিছুটা কাটবে বলে মনে করছেন উপকূলবাসী।
কক্সবাজারের ইনানী এলাকার বাসিন্দা ছাবের আহমদ স্থানীয় ভাষায় বলেন, ‘প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষ দিক থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময়ে বেশি তুফান হয়। কালবৈশাখীর ভয় থাকে। বৃষ্টি হলেই সাগরে পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। যে কারণে মে মাস আসলেই ভয় লাগে। একবার তুফান হলে বহু টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাতাসে আংশিক ঘর ভাঙলেও আর্থিক কষ্টে পড়তে হয়।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ছোটবড় কমপক্ষে ১৪টি ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে। যার বেশিরভাগই মে মাসে আঘাত হেনেছে। ২০০৭ সালের ১৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আকাশ’, ২০০৮ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ‘নার্গিস’, ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’, ২০১০ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘লায়লা’, ২০১৩ সালের ১৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’, ২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’, ২০১৭ সালের ৩১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’, ২০১৯ সালের ৪ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’, ২০২০ সালের ২১মে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’, ২০২১ সালের ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ২০২২ সালের ৭মে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনী’, একই বছরে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’, ২০২৩ সালের ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’, গত বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ উপকূলে আঘাত হানে।
চলতি মাসেও আন্দামান সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ শক্তিশালী হয়ে ‘শক্তি’ ও ‘মন্থা’ নামে দুটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার কথা বলেছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। সে কারণে সমুদ্র বন্দরে সতর্ক সংকেতও জারি করা হয়। শেষতক মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের গতি কমে গেলে বিপদমুক্ত হয় উপকূল। নামিয়ে ফেলা হয় সতর্ক সংকেত।
উপক‚লবাসী জানায়, ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে বেড়িবাঁধের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে। জলোচ্ছ্বাস ও পানিতে জমি, মাছের ঘেরসহ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব এলাকায় বিভিন্ন সময় আইলা, আম্ফান, সিডর, বুলবুল, মহাসেন, ডানা, রিমালের মতো ১৫টি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। যে কারণে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ভাবাস মিললেই ভয় আতঙ্ক বেড়ে যায়। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় রোমালের আঘাতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
পাউবো সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ১৪৮ কিলোমিটার সমুদ্র উপকূল রয়েছে। এরমধ্যে এখনো ঝুঁকিতে আছে প্রায় ৯০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বড়বড় প্রকল্পের আওতায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ চলমান আছে। এর বাইরেও অরক্ষিত বেড়িবাঁধ থাকায় বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হলেই লোকালয়ে পানি প্রবেশ করবে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত বেড়িবাঁধেরও উচ্চতা কম থাকায় বেশি জলোচ্ছ্বাসে পানি প্রবেশ করার শঙ্কা আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ.ম. জুলফিকার তারেক বলেন, ‘আগে যেসব বাঁধ নির্মিত হয়েছে সেগুলো উচ্চতা কম ছিল। এখন নতুন করে যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলোর উচ্চতা বেশি। যে কারণে পানি প্রবেশের সম্ভাবনা নেই। এছাড়াও যেসব এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ রয়েছে সেদিকে যাতে পানি প্রবেশ না করে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
বাঁশখালীর খানখানাবাদ এলাকার বাসিন্দা শওকত আলম বলেন, ‘এমন কোন ঘূর্ণিঝড় নাই যেগুলোতে বাঁশখালী উপকূল ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সাগরের পাড়ে যারা বসবাস করে তাদের মধ্যে সবসময় পানি আতঙ্ক থাকে। বাতাস হলেই তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যায়। তবে বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হলে কেউ বাঁচবে না। কারণ একদম সাগরের সাথে লাগোয়া প্রচুর ঘরবাড়ি আছে। যারা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বেশ কয়েকবার বসতভিটা পরিবর্তন করেছে।’