নিজস্ব প্রতিবেদক
উৎপাদনে গত অর্থবছরে রেকর্ড করলেও এবার ঘাটতি নিয়েই শেষ হচ্ছে লবণ মৌসুম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পাঁচ লাখ টনের মতো লবণ উৎপাদন কম হয়েছে। যা গত বছর উৎপাদিত লবণের চেয়েও তিন লাখ টন কম। চলতি মাসের শুরুতে মাঝারি বৃষ্টিপাতের কারণে শেষদিকে লবণ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এবার মৌসুম শুরুর ১৫ দিন আগে ৬৯ হাজার ১৯৮ একর জমিতে প্রায় ৪২ হাজার চাষি লবণ উৎপাদনে নামেন। মুনাফার স্বপ্ন নিয়ে এত বেশি চাষি মাঠে নামলেও লবণ উৎপাদন ও দামে হতাশ হয়েছেন তারা। যার প্রভাব পড়বে আগামী মৌসুমে। লবণ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন অধিকাংশ চাষি।
কক্সবাজারের বিসিক লবণ শিল্প উন্নয়ন কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভ‚ঁইয়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘মে মাসের শুরুতে বৃষ্টিপাত হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২১ লক্ষ টনের বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছে। এখন যাতে চাষিরা ভালো দাম পায় সেটাই চেষ্টা করছি। আবহাওয়া ভালো থাকা না থাকার উপর নির্ভর করে লবণ উৎপাদন। শুরুর মতো শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকলে লবণ উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হতো।’
বিসিক জানায়, প্রতি বছর মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য মে মাস পর্যন্ত লবণ উৎপাদনের ভরা মৌসুম। প্রতিবছর যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় তা অর্জনে ব্যর্থ হলেও উৎপাদন ছিল বাড়ন্ত। এবার গত বছরের তুলনায় প্রায় তিন লাখ টন লবণ উৎপাদন কম হয়েছে। গত মৌসুমে দৈনিক ৪৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হলেও তা এবার অর্ধেকে নেমে এসেছে।
চলতি মৌসুমে ৬৯ হাজার ১৯৮ একর জমি লবণ উৎপাদনে প্রস্তুত করা হয়। এরমধ্যে টেকনাফে ৪ হাজার ৪২১ একর, পেকুয়ার দরবেশকাটায় ১০ হাজার একর, কুতুবদিয়ার লেমশীখালীতে ৭ হাজার একর, ঈদগাঁওয়ের গোমাতলীতে ৫ হাজার একর, মহেশখালীর উত্তর নলবিলা, গোরকঘাটা, মাতারবাড়িতে ১৫ হাজার একর, চকরিয়ায় ডুলাহাজারা, ফুলছড়িতে ১১ হাজার একর, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডীতে ৩ হাজার ৯০০ একর, পটিয়ায় এক হাজার ৮৫০ একর ও বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনা, ছনুয়া, সরলে ৭ হাজার একর মাঠে লবণ উৎপাদনে কাজ করছেন চাষিরা। প্রায় ৪২ হাজার চাষি এবার লবণ মাঠে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। লবণ উৎপাদন অঞ্চলে এ শিল্পের সাথে পাঁচ লক্ষ মানুষ জড়িত। পাশাপাশি ২৫ লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল।
জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, উৎপাদন হয় ১৫ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২২ লক্ষ ১৭ হাজার মেট্রিক টন, উৎপাদন হয়েছে ১৬ লক্ষ ৫১ হাজার মেট্রিক টন, ২০২১-২২ অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ লক্ষ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন, উৎপাদন হয়েছে ১৮ লক্ষ ৩০ হাজার মেট্রিক টন, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৩ লক্ষ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন, উৎপাদন হয়েছে ২২ লক্ষ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ লক্ষ ২৮ হাজার মেট্রিক টন, উৎপাদন হয়েছে ২৪ লক্ষ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন। এই পাঁচ বছরে রেকর্ড উৎপাদন হলেও চাহিদার তুলনায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ২৬ লক্ষ ১০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। উৎপাদন হয়েছে ২১ লাখ ১ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন লবণ।
লবণ চাষিরা জানান, টানা ছয় মাস মাঠে পরিশ্রমের পর লবণের যে দাম পাওয়া যায় এতে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এভাবে চলতে থাকলে লবণ শিল্প থেকে চাষিরা মুখ ফিরিয়ে নিবে। প্রতি টন লবণ বিক্রি করে প্রায় ৫০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। গত অর্থ বছরে লবণ উৎপাদন যেমন বেশি হয়েছিল তেমনি দামও উঠেছিল ভালো। যে কারণে অনেক চাষি অধিক মুনাফার আশায় প্রতি কানি জমি ৫০-৫৫ হাজার টাকায় লাগিয়ত নিয়ে মাঠে নেমেছিল। কিন্তু এবার উৎপাদন ও দাম দুটিতেই হতাশ হতে হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বাজারে বেশি দামে লবণ বিক্রি করলেও মাঠে লবণের দাম দিচ্ছে কম। এখন ২০০-৩০০ টাকা লবণের দাম মিলছে। আবার এই দাম থেকে পরিবহনের জন্য ট্রলার ও ট্রাকে তুলে দেয়া পর্যন্ত কমপক্ষে ৪০-৫০ টাকা খরচ চাষিদেরকেই বহন করতে হচ্ছে। এছাড়াও লবণ মাঠ তৈরি, উৎপাদনে প্রতি মৌসুমে একজন শ্রমিকের বেতন দিতে হচ্ছে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। সবমিলিয়ে মাঠে যারা কাজ করছেন তারা হতাশ হলেও মিল মালিকরা লাভবান হচ্ছেন।
বাঁশখালীর ছনুয়া এলাকার লবণ চাষি আব্দুর রহিম বলেন, আমি দশ কানি জমিতে লবণ চাষ করেছি। কিন্তু আশানুরূপ উৎপাদন হয়নি। শেষ দিকে বৃষ্টি হওয়ায় লবণ উৎপাদন হয়নি। একদিকে লবণ উৎপাদন হয়েছে কম, অন্যদিকে দামও কম। সবমিলিয়ে চাষিরা এবার চরম হতাশ। সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমিয়ে দেয়া হয়। লবণ আমদানি করলে আমাদের উৎপাদিত লবণের দাম পাওয়া যায় না। অথচ আমদানিকৃত লবণের মান আমাদের উৎপাদিত লবণের কাছাকাছিও হবে না। দাম ৪০০ টাকার উপরে না পেলে লবণ শিল্পের ভরাডুবি হবে।
লবণচাষি ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘লোকসান গুনতে গুনতে চাষিরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে লবণ উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হবেন তারা। কিছু মিলমালিক সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। গত বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে দাম। প্রতি কেজিতে খরচের তুলনায় কমপক্ষে আট টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। অথচ বাজারে প্যাকেটজাত লবণের দাম কমেনি। লবণের মিল মালিকরা ৪০-৪৫ টাকাতেই প্রতি কেজি প্যাকেটজাত লবণ বিক্রি করছেন।’
উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান এবং গুণগত মানসম্পন্ন লবণ উৎপাদনের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে দেশে তৎকালীন ইপসিক, যা বর্তমানে বিসিক লবণ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। মাত্র ৬ হাজার একর জমিতে শুরু হওয়া লবণ চাষ এখন ৬৯ হাজার একর ছাড়িয়েছে। মূলত ২০০০ সালের পর সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে পলিথিন পদ্ধতিতে লবণ চাষ শুরু হলে উৎপাদনে গতি বাড়ে। সনাতন পদ্ধতিতে একর প্রতি লবণের উৎপাদন ছিল ১৭.২৫ মেট্রিক টন এবং নতুন পদ্ধতিতে প্রতি একরে লবণ উৎপাদিত হয় প্রায় ২১ মেট্রিক টন।