বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গুমের পেছনে কারা ছিল, কীভাবে ভিকটিমদের নির্যাতন ও হত্যা করা হত, সেই বিবরণ গুম সংক্রান্ত কমিশন তাদের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফাইন্ডিং হচ্ছে, র্যাবের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এই ঘটনায় প্রধান ভূমিকা রেখেছে। খবর বিডিনিউজের
হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যরা বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন দ্বিতীয় ইন্টেরিম প্রতিবেদন জমা দেন। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করে এ প্রতিবেদনের বিষয়ে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। তিনি বলেন, প্রফেসর ইউনূস এই প্রতিবেদন শুনে কয়েকটি দিক নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের কাছ থেকে আশু করণীয় বিষয়ে দ্রুত মতামত নিতে হবে, যাতে আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে গত ২৭ অগাস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এই কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিশন গত ১৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। পরদিন এ প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশও করা হয়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করা হয় ওই প্রতিবেদনে। ‘গুমের’ ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশও করা হয়। গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রধান বিচারপতি মঈনুল ইসলাম এবং সদস্যরা বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেন। দ্বিতীয় প্রতিবেদনে কী এসেছে, সেই তথ্য তুলে ধরে প্রেস সচিব বলেন, কমিশনের তথ্য মতে, অনেক ভিকটিমকে নৌকায় করে নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে হত্যা করে পেটে সিমেন্ট ভরে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। কাউকে গুলি করে, কাউকে ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করা হয়, আবার কারও মরদেহ বস্তায় ভরে ট্রেনলাইনে ফেলে দেওয়া হয়, যাতে ট্রেন চলার সময় তা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আবার কাউকে চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়। ভিকটিমদের স্বজন এবং কিছু ‘পার্পেট্রেটরের’ সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এসব তথ্য প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে জানান শফিকুল আলম। তিনি বলেন, এই ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ এতটাই হৃদয়বিদারক যে প্রফেসর ইউনূস বলেছেন, এগুলো সংরক্ষণের জন্য ‘হরর মিউজিয়াম’ স্থাপন করা প্রয়োজন। গণভবনে যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মরণে একটি মিউজিয়াম করা হচ্ছে, সেখানে এসব নৃশংসতার দলিল থাকবে।
প্রেস সচিব বলেন, ‘একটি বড় ফাইন্ডিং হল, অনেক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এইসব কর্মকান্ডে যুক্ত হয়েছেন শুধুমাত্র পদোন্নতি বা পুরস্কারের লোভে, যেমন পিপিএম/বিপিএম পাওয়া, ঢাকায় পোস্টিং পাওয়া ইত্যাদি। অনেকে এই কাজে জড়াতে চাননি, এমনকি কেউ কেউ চিঠি দিয়ে জানান যে তারা এই অপারেশনে থাকতে চান না। এমন দুটি চিঠির উল্লেখও কমিশনের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে।
একজন সাংবাদিক জানতে চান, যতগুলো অভিযোগ এখন পর্যন্ত জমা পড়েছে, তার মধ্যে র্যাবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে। সেই র্যাব সদস্যরা কি পুলিশ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত, নাকি বিজিবি বা সেনাবাহিনী থেকে এসেছিলেন? এই প্রশ্নে প্রেসসচিব বলেন, যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে, তার বিশ্লেষণ কমিশন করছে। চূড়ান্ত রিপোর্টে এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে থাকবে— কে কোন বাহিনী থেকে এসেছিলেন এবং কীভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
গত ১২ ফেব্রæয়ারি ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া তিনটি গোপন বন্দিশালা ঘুরে দেখেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদ এবং গুম তদন্ত কমিশনের সদস্যরাও। তিনশর বেশি মানুষ এখনো নিখোঁজ। তারা জীবিত না মৃত—এ বিষয়ে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে কিনা, তা জানতে চান একজন সাংবাদিক। প্রেস সচিব বলেন, এটি কমিশনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কমিশন যেটা করছে—ভিকটিমদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছে, কীভাবে তাদের অপহরণ করা হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছিল, কীভাবে টর্চার করা হয়েছে এবং কারা এতে জড়িত ছিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতে সম্ভাব্য অপরাধীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। র্যাব, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সদস্যদের ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে কিছু আয়নাঘরের সন্ধান পেয়েছি। কিন্তু তিনশর বেশি মিসিং ব্যক্তির বর্তমান অবস্থা—তারা বেঁচে আছেন কি না, কোথায় আছেন, কেউ মারা গেলে তার লাশ কোথায়—এই বিষয়গুলো জানার জন্য আমরা নিরলস চেষ্টা করছি। প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে তার প্রেস সচিব বলেন, তিনি আজকেও বলেছেন, এরা আমাদের ভাই, বোন। তাদের সন্ধান আমরা যেভাবেই হোক পেতেই হবে।’ যতদিন পর্যন্ত শেষ নিখোঁজ ব্যক্তিরও সন্ধান না পাওয়া যায়, ততদিন এই কমিশন কাজ চালিয়ে যাবে। প্রধান উপদেষ্টা গুমের বিচারের বিষয়ে কমিশনকে কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন কি না এমন প্রশ্নে প্রেস সচিব বলেন, অবশ্যই, যারা গুমের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতেই হবে। এখন পর্যন্ত ১,৮৫০টি কেসের মধ্যে ১,৩৫০টি স্ক্রুটিনাইজ করা হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, প্রায় সাড়ে তিন হাজার গুম হয়েছে। আমাদের কাজগুলো অনেক সময়সাপেক্ষ এবং ডিটেইলে করতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যারা জড়িত তাদের বিচার হবে।