গুজব অপপ্রচার ও টিসিভি ক্যাম্পেইন

1

লিটন দাশ গুপ্ত

দেশে পানিবাহিত যে কয়টি সংক্রামক রোগ রয়েছে তাদের মধ্যে টাইফয়েড হচ্ছে অন্যতম। প্রতিবছর এই টাইফয়েডের কারণে প্রায় ৪ লাখ ৭৮ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং তার মধ্যে ৮ সহ¯্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। যাদের ৬৮ শতাংশই শিশু বলে জানা যায়। টাইফয়েড এর বাংলা হলো ‘আন্ত্রিক জ্বর’। ‘আন্ত্রিক’ বলতে প্রধানত অন্ত্র বা পেটের ভিতর ‘নাড়িভুঁড়ি’কে বোঝানো হয়, যা পরিপাকতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্র নিয়ে গঠিত এবং খাদ্য হজম ও পুষ্টি শোষণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এখানে ‘সালমোনেলা টাইফি’ নামক একপ্রকার ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই সংক্রামক রোগটি সংক্রমিত হয়। যা প্রধানত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। এমনিতেই আমাদের দেশে পানিদূষণ, উচ্চ জনঘনত্ব, কার্যকর স্যানিটেশনের ঘাটতি ইত্যাদির কারণে টাইফয়েড উচ্চ সংক্রমণপ্রবণ একটি দেশ বলা যায়। এইসব বিবেচনায় রেখে দেশে প্রথমবারের মতো শিশুদের বিনামূল্যে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। শিশু মানে ৯ মাস শিশু থেকে শুরু করে ১৫ বছর বয়সী সকল কিশোর-কিশোরীকে বিনামূল্যে এই ‘টিসিভি’ টিকা দেয়ার কর্মসূচি শুরু হয়েছে। গত ০১ সেপ্টেম্বর তারিখ থেকে টাইফয়েড টিকা কার্যক্রম শুরু হবার কথা থাকলেও পরবর্তীতে ১২ অক্টোবর এই কর্মসূচির শুরু হয়। টিকার এ ক্যাম্পেইন চলবে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৫ কোটি শিশু কিশোর কিশোরীকে এই টাইফয়েডের টিকা দেয়া হবে বলে জানা যায়।
এইদিকে টিকাদান শুরুর আগে থেকেই এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলছে অবাধ গুজবের ¯্রােত। গ্রাম থেকে শহরে পারিবারিক পরিসরে কিংবা হাট বাজারের আড্ডায় বা আলোচনায় চলছে টিকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। একদিকে দেশজুড়ে শিশু কৈশোরদের টাইফয়েডের টিকার কার্যক্রম যেমন চলছে, অন্যদিকে এই কার্যক্রমের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে নানা রকম গুজব। চারিদিকে মিথ্যা অসত্য এবং অপতথ্যের ফুলঝুরি ছড়িয়ে পড়েছে। এই যেমন- এই টিকা নিলে নাকি মেয়েরা ভবিষ্যতে মা হতে পারবে না, ছেলেশিশুরা বাবা হতে পারবেনা। টিকার পেছনে রয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রসমুহের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবার অপতৎপরতা। বাংলাদেশ গরিব রাষ্ট্র বলে এইদেশের শিশুদের গিনিপিগ বানিয়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক টিকার কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। এই টিকায় ব্যবহৃত উপাদানগুলো হালাল নয়। এই রকম বানানো হচ্ছে হরেক রকম আজগুবি গল্প। আমি আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখেছি এইসব গুজবে সাধারণ শিক্ষার্থী, অভিভাবকেরা সিদ্ধান্ত হীনতায় রয়েছেন ও বিভ্রান্তিতে পড়েছেন।
আমাদের দেশে দ্রæত গুজব ছড়ানো বিষয়টি নতুন নয়। বলা যায় চলমান বিভিন্ন গুজবের মধ্যে সর্বশেষ সংস্করণ হচ্ছে এই টিসিভি টিকা। ‘টিসিভি’ মানে ‘টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন’। গত বছর জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধের কিশোরীদেরদেও দেয়া হয়েছিল ‘এইচপিভি’ বা হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস টিকা। তখনও এমন গুজব ছড়িয়েছিল। তখনও সকল প্রকার গুজব উপেক্ষা করে মেয়ে শিক্ষার্থীরা মোটামুটি সন্তোষজনক হারে টিকাগ্রহণ করেছে। এখানে টাইফয়েড কেবল শিশুদের হয় তা নয়। টাইফয়েড যেকোন সময় যেকোনো বয়সেই হতে পারে। তবে শিশু ও বয়স্ক বিশেষ করে যারা কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি, তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। টিকা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে একসময় টাইফয়েডে ৩০ শতাংশ মানুষ মারা যেত। পরবর্তীতে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হবার পর মৃত্যুর হার কমে এসেছে। কিন্তু টাইফয়েডের ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে সেই অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। অর্থাৎ টাইফয়েড হলে চিকিৎসক কর্তৃক যে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হত, এখন সেই অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ হচ্ছে না। তাই প্রতিষেধক হিসাবে ১৫ বছর পর্যন্ত বয়সীদের এই টিকা প্রদান। যাইহোক যে কথা বলছিলাম টিসিভি টিকা নিয়ে চলমান গুজব। স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষজ্ঞগণ বলছে, টাইফয়েড টিকা নিয়ে যা কিছু শোনা যাচ্ছে সবই গুজব। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান ও নেপালের শিশুদের এই টাইফয়েড টিকা অনেক আগেই দেয়া হয়েছে। এছাড়া সব মিলিয়ে পৃথিবীর আরো আটটি দেশে শিশুদের এই টাইফয়েডের টিকাটি দেয়া হচ্ছে। কোন প্রকার সমস্যা হয়নি বা হবার সম্ভাবনাও নাই। উল্লেখ্য এই টিকা ২০২০ সাল থেকে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ কর্তৃক যাচাই করা এবং এটি নিরাপদ ও কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত। তাই কোন প্রকার সমস্যা হবার প্রশ্নই আসেনা। তবে টিকা দেওয়ার পর কিছু মৃদু ও সাময়িক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। যেমন- গত কয়দিনে টিসিভি টিকা পাওয়া শিশুদের মধ্যে মাত্র ৯ শতাংশ শিশুর সামান্য জ্বর এসেছিল। এছাড়া টিকা প্রদানের স্থানে হালকা ব্যথা অনুভব ও সামান্য ফোলা বা লাল হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা দেখতে পেয়েছে, যা স্বাভাবিক। আর এইসবের জন্য অতিরিক্ত কোনো চিকিৎসার দরকার হয়না। এমনিতে দুয়েকদিন পর উপসর্গগুলো চলে যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টাইফয়েড টিকা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ালেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেমে নেই টিকাদান কর্মসূচি। যারা সচেতন তারা এই সব গুজব পরোয়া করেনা। আমরা যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাস বা উপজেলা কেন্দ্রিক সংশ্লিষ্ট তারা দেখতে পাচ্ছি টিকার হার মোটামুটি সন্তোষজনক বলা যায়। কিন্তু পুরো দেশের চিত্র একই নয়। তাই লক্ষ্যমাত্রা পৌঁছাতে হলে গুজব বিরোধী প্রচার চালিয়ে গুজব নিষ্ক্রিয় বা প্রতিহত করে, টিকা ক্যাম্পেইনকে সফল করতে হবে। একসময় টিকা নিয়ে টেলিভিশন ও রেডিওতে ব্যাপক প্রচার করা হত। ফলে সাধারণ মানুষের ভেতরে টিকাসংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাপকভাবে উৎসাহ পরিলক্ষিত হত। বর্তমানে ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম সেরা প্রচার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এই মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে। তাই রেডিও টেলিভিশনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও টাইফয়েডের টিকা নিয়ে ইতিবাচক প্রচার বাড়াতে হবে। যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় ‘টিসিভি’ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট