গাজা নিয়ে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা ট্রাম্পের

1

আকতার কামাল চৌধুরী

নেতানিয়াহুর অবস্থা যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পাওয়া। তিনি অতটা হয়তো আশা করেননি। সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তাঁকে পাশে রেখেই ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি গাজা দখলে নিয়ে নিবেন। এজন্যে গাজা খালি করবেন। গাজার মানুষকে গ্রহণ করার জন্য মিশর-জর্ডানকে অনুরোধও করেন।
ট্রাম্পের মুখ থেকে এ কথা শোনার পর খুশিতে ডগমগ নেতানিয়াহুর চেহারা আত্মতৃপ্তিতে লাল হয়ে।
কী ভয়ানক, কী দূর্বিনীত ঘোষণা ট্রাম্পের! যা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। কোনো মদ্যপ ব্যক্তি বেসামাল অবস্থায় ট্রাম্পের মত এরকম জঘন্য ঘোষণা দিতে পারে। জাতিসংঘ বলেছে,ট্রাম্পের এই ঘোষণা জাতিগত নিধনের সামিল’।
৫০ হাজারেরও অধিক ফিলিস্তিনিকে খুন আরও লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে পঙ্গু আর পুরো গাজাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। শেষপর্যন্ত রক্ত পিপাসা মিটে গেলে অনেকটা শর্তযুক্ত যুদ্ধবিরতিতে সই করে।
যুদ্ধবিরতির শর্তানুযায়ী উভয়পক্ষে বন্দী বিনিময় চলতে থাকে। এরমধ্যে সদ্য ক্ষমতার চেয়ারে বসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডাকে ওয়াশিংটনে হাজির হন নেতানিয়াহু।
বিশ্ববাসীর ধারণা ছিল, এবার গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি আর দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের জন্য চাপ দেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যেহেতু তিনিই এ যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে নিজের কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন এভাবেই, -’নির্বাচনে তাঁর ঐতিহাসিক বিজয়ের ফলেই গাজায় মহাকাব্যিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ‘।
কিন্তু দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান তো নয়-ই, বরং সবাইকে অবাক করে দিয়ে গাজার বাসিন্দাদের তাড়িয়ে নিজেরাই গাজা দখলের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। এটি ট্রাম্পের আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয়। হতে পারে, কট্টর ইসরায়েলপন্থী হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিওর মনোবাসনাও তা-ই।
একটা জাতিকে বাস্তুচ্যুত করে রিফিউজি বানিয়ে তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটির উপর বিলাসবহুল অবকাশযাপন কেন্দ্র করার পরিকল্পনা! বাহ্! নির্লজ্জতা, বিবেকহীনতার একটা সীমা থাকা দরকার। ট্রাম্পের সেটাও নেই। শুধু ট্রাম্প কেন, ফিলিস্তিন ট্রেজেডীর বিগত ৫৮ বছরের ইতিহাসে দু’একজন ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের তা ছিল না।
আলাদা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও প্রয়োজনীয়তাকে প্রথম স্বিকৃতি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন। তাঁর একান্ত ইচ্ছাতেই দীর্ঘ আলোচনার দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৯৩ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করে উভয়পক্ষ। এই চুক্তি ইতিহাসে অসলো চুক্তি নামে পরিচিত। চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ইয়াসির আরাফাত ও আইজাক রবিনকে দুপাশে দাঁড় করিয়ে, উভয়ের কাঁধে হাত রেখে করমর্দন করান।
অসলো চুক্তির শর্তানুযায়ী পিএলও, ইসরায়েল পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পাঁচ বছর পর গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ফিলিস্তিন সফর করে পিএলসি (প্যালেস্টাইন লেজিসলেটিভ কাউন্সিল) -এ বক্তৃতাও দেন।
নিদারুণ বাস্তবতা হলো ক্ষমতার পালাবদলের পর যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল কেউ-ই আর এই চুক্তি বাস্তবায়নে মাথা ঘামাননি। সংকট যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে যায়। আজীবন লালন করা স্বাধীনতার স্বপ্নীল সূর্যকে আর দেখা হয়ে ওঠেনি হতভাগ্য ফিলিস্তিনিদের। একবুক হতাশা আর স্বপ্নভঙ্গের ক্ষত নিয়ে একদিন মৃত্যুবরণ করেন ইয়াসির আরাফাত। অভিযোগ আছে,করমর্দনের সময় হাতে বিষ প্রয়োগ করে ইসরায়েল তাঁকে হত্যা করেছিল।
সেই অসলো চুক্তি এখন আরব সাগরের গভীর জলরাশীর তলায় চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। অসলো চুক্তিতো নয়-ই, বরং গাজার নির্মম পরিণতিতে ফিলিস্তিনিদের টিকে থাকাই এখন দায় হয়ে ওঠেছে।
গাজা খালি করার হুঙ্কারে হতবিহ্বল তারা। পুরো আরব জুড়েই চলছে অস্থিরতা।
জর্ডান, মিশর,সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রপ্রধানরা ট্রাম্পের সাম্রাজ্যবাদী সিদ্ধান্তের তুমুল বিরোধিতায় নেমেছেন। জর্ডানের রাজা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে টাম্পকে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন।
সৌদি আরবের হিসাবে আলাদা। বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় বসেই ভীন্নমত দমনে মরিয়া হয়ে উঠেন। তিনি জানেন, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রকে তুষ্ট করতে না পারলে দেশে নিজের ইচ্ছার বাস্তবায়ন অসম্ভব।
তিনি ইতিহাস ভেঙে গোপনে ইসরায়েল সফর করেন। এমনকি ইসরায়েলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছে যান। এতেই খুশি যুক্তরাষ্ট্র। এটা যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের চাওয়াও বটে। এরমধ্যে হামাসের ইসরায়েল আক্রমণ সবকিছু ওলটপালট করে দেয়।
ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সমর্থন পেয়ে বেসামাল হয়ে উঠেন মোহাম্মদ বিন সালমান। প্রথমেই তিনি নিজের পরিবারকে সায়েস্তা করেন। একদিন সৌদি রাজতন্ত্র বিরোধী হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক জামাল খাশোগীকে হত্যা করেন। তা-ও আবার নিজের দেশে নয়,তুরষ্কের আঙ্কারায়,নিজস্ব বিমানে কিলার গ্রুপ পাঠিয়ে।
গাশোকী হত্যাকাÐ বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দেয়। চারদিকে নিন্দার ঝড় ওঠলে বেকায়দায় পড়েন ক্রাউন প্রিন্স। প্রিন্সের এই দুঃসময়ে রক্ষাকবচ হয়ে আসেন ট্রাম্প। এফবিআই-এর তদন্তে খাশোগী হত্যাকাÐে নির্দেশদাতা হিসেবে মোহাম্মদ সালমানের নাম প্রমাণিত হলেও তা পাশ কেটে যান ট্রাম্প। এভাবে ট্রাম্পের সরাসরি হস্তক্ষেপে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স দায়মুক্তি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন। সেই থেকে তিনি অতিশয় কৃতজ্ঞ ট্রাম্পের উপর।
ট্রাম্পের গাজা দখলের ঘোষণায় ক্রাউন প্রিন্স একটা মোচড় দিয়ে বসেছেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ছাড়া তিনি ইসরায়েলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজি নন। প্রিন্সের এই মনোভাবে গাজা দখলের মত জঘন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ট্রাম্প কিছুটা হোঁচট খাবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু ট্রাম্প কি দমার পাত্র? ন্যায়-অন্যায়বোধ কি ট্রাম্পের আদৌ আছে? তিনি আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা করেন? জাতিসংঘের মত সংস্থার অস্তিত্ব থাকতে তিনি কি অন্যের ভূখÐ দখলের ঘোষণা দিতে পারেন?
ট্রাম্পকে গাজা দখল যদি বৈধ হয়, তবে ইরাকের কুয়েত দখল অবৈধ হবে কোন যুক্তিতে? কিংবা হালে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে কী অন্যায় করেছে?
বস্তুত এসমস্ত যুক্তির কানাকড়িও দাম নাই গোঁয়ার ট্রাম্পের কাছে। ইসরায়েলের ব্যাপারে অন্ধ তিনি। গাজা যুদ্ধে হাজারো অনুরোধ সত্তে¡ও যে প্রাণঘাতী বোমা ইসরায়েলের কাছে সরবরাহ করেননি বাইডেন,ক্ষমতায় এসেই সে বোমা রাতারাতি ইসরায়েলে পাঠান ট্রাম্প। একচোখা ট্রাম্প কখনো ইসরায়েলের দোষ খুঁজে পান না। তাই তাঁর শাসনামলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র একটি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু, ট্রাম্পের গাজা দখলে একটি সুদুরপ্রসারি বার্তা আছে। এই ভূখন্ডকে আগামীতে ইসরায়েল তথা যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলবে। তখন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নিজের ইচ্ছামত ছড়ি ঘোরানোর আলাদা একটা মাওকা পেয়ে যাবে। আর ইসরায়েলও প্রবল প্রতিপত্তি নিয়ে একক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে পুরো তল্লাট তটস্থ করে রাখবে। যা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য মোটেই সুখকর নয়। এটি তারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই মঙ্গল।

লেখক : প্রাবন্ধিক