‘গাঙ্গে’-প্রাচীন চট্টগ্রামের নাম কিরাত অতঃপর বিস্ময়কর ইতিহাস আলোচনা

1

সোহেল মো. ফখরুদ-দীন

ইতিহাসের আলোকে প্রাচীন চট্টগ্রামের পরিচয়। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে রচিত Periplus of the Erythraean Sea (পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সী ) -বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ইতিহাসগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত-একটি অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদ বা দলিল । গ্রিক ভাষায় রচিত এই গ্রন্থটি রোমান ও মিশরীয় নাবিক ও ভ্রামণিকগণ যৌথভাবে রচনা করেন। এটি মোট ৬৬টি অধ্যায়ে বিভক্ত, যেখানে সমুদ্রপথে ভ্রমণ, বাণিজ্যিক কেন্দ্র, প্রত্নতাত্ত্বিক এবং উপকূলীয় অঞ্চলের বিবরণ রয়েছে। গ্রন্থটি চারবার ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে-১৮০০, ১৮৭৯, ১৯১২ ও সর্বশেষ ১৯৮০ সালে। এই গ্রন্থে ১৮টি আফ্রিকান অঞ্চল, ১৮টি আরব অঞ্চল, ২৭টি ভারতীয় অঞ্চল এবং ৩টি চীনা অঞ্চলসহ কয়েকটি অজানা অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ভ্রমণবৃত্তান্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো টলেমির মানচিত্রের ব্যবহার, যেখানে ‘কিরাদাই’ বা ‘কিরাত’ নামক একটি রাজ্যের কথা উল্লেখ রয়েছে।
প্রাচীন চট্টগ্রাম: কিরাত থেকে চাটগাঁ Periplus-এ গঙ্গার পূর্ব মোহনা অ্যান্টিবোলেই থেকে দক্ষিণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নাম উঠে আসে, যেমন:
১. পেন্টাপলিস (বাণিজ্যিক অঞ্চল/ চট্টগ্রাম ),
২. কাতাবেদা নদীর মুখ, ( কর্ণফুলী নদী),
৩. বারাকৌটা (বাজার), রামু,
৪. তোকাসানা নদীর মোহনা ( বার্মার একটি নদী) ।
উনিশ শতকের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ক্রিশ্চিয়ান লাসেন এই চারটি স্থানের ভূ-পরিচয় তুলে ধরেন নি¤œরূপে:
১) পেন্টাপলিস-বর্তমান চট্টগ্রাম,
২) কাতাবেদা-কর্ণফুলী নদী,
৩) বারাকৌটা-রামু,
৪) তোকাসানা-আরাকানের কালাদান নদী।
এ বিশ্লেষণ চট্টগ্রামের ইতিহাসকে যে কতটা প্রাচীন করে তোলে, তা সহজেই অনুমেয়। যেখানে ঢাকার বয়স প্রায় এক হাজার বছর এবং কলকাতার বয়স মাত্র ৩০০ বছরেরও কম, সেখানে চট্টগ্রামের ইতিহাস হাজার বছরের সীমা অতিক্রম করেছে বহু আগেই।
মহাভারত ও প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে চট্টগ্রাম- প্রাচীনতম ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে চট্টগ্রামের আদিনাথ, চন্দ্রনাথ, কাঞ্চননাথ এবং মহর্ষি মেধশমনির নাম একাধিকবার শ্লোকে শ্লোকে উল্লেখিত হয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, চট্টগ্রাম অঞ্চল তখন থেকেই আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল।
বিশিষ্ট অনুবাদক হারুন রশীদের “পৃথিবীর প্রাচীনতম ভ্রমণপঞ্জি: সমুদ্রপথে গ্রিস থেকে বাংলায়” শীর্ষক অনুবাদ গবেষণা প্রবন্ধে এইসব ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে, যা চট্টগ্রামের ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করে।
কর্ণফুলী নদীর নামান্তর: কালান্তরের সাক্ষী। কর্ণফুলী নদী নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে ভিন্ন ভিন্ন নাম পাওয়া যায়: ১) মধ্যযুগীয় বাংলা পুঁথিতে কর্ণফুলীকে ‘কাঁইচা খাল’ বলা হয়েছে, ২) মার্মা জনগোষ্ঠীর কাছে এটি পরিচিত ‘কান্সা খিওং’ নামে, ৩) ভারতের মিজোরামে কর্ণফুলী নদী ‘খাওৎলাং তুইপুই’ নামে পরিচিত। এসব নাম নদীটির ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে।
চট্টগ্রাম নামকরণ ও বিবর্তন – যদিও প্রাচীনকালে চট্টগ্রাম অঞ্চল ‘কিরাত’, ‘ক্রিসে’, ‘কিরাদিয়া’ নামে পরিচিত ছিল, আজ বিশ্ব দরবারে এটি ‘চট্টগ্রাম’ বা ‘চিটাগাং’ নামে প্রতিষ্ঠিত। ১৬৬৬ সালে মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খান এই অঞ্চলের নামকরণ করেন ইসলামাবাদ। এরপর স্থানীয়ভাবে প্রচলিত ‘চাটিগাঁও’ নাম থেকেই ব্রিটিশরা ‘চিটাগাং’ নামটি গ্রহণ করে। ‘চাটিগাঁও’-এর সংস্কৃত রূপ হয় ‘চট্টগ্রাম’, এবং স্থানীয় উচ্চারণে পরিচিত ‘চাটগাঁ’ হিসেবে। এর আরেকটি প্রচলিত নাম ‘চট্টলা’, যা সাহিত্যে ও লোকসাংস্কৃতিক ধারায় বহুল ব্যবহৃত।
১৭৭৬ সালের একটি ব্রিটিশ মানচিত্রেও ‘চট্টগ্রাম সরকার’ নামে প্রশাসনিক সীমানা চিহ্নিত থাকলেও সেখানে ‘চট্টগ্রাম’ নামটি সরকারি দলিলে প্রথম চালু হয় ব্রিটিশ আমলে।
প্রাচীন চট্টগ্রামের ৫৪টি নাম- চট্টগ্রাম ইতিহাসে নানা নামে পরিচিত ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো: ১) আদর্শদেশ, ২) সুহ্মদেশ, ৩) ক্লীং বা কালেন, ৪) রম্যভূমি, ৫) চিতাগাঁও, ৬) চিৎগাঁও, ৭) চট্টল, ৮) চৈত্যগ্রাম, ৯) সপ্তগ্রাম, ১০) চট্টলা, ১১) চট্টগ্রাম, ১২) চক্রশালা, ১৩) চন্দ্রনাথ, ১৪) চরতল, ১৫) চিতাগঞ্জ, ১৬) চাটীগাঁ, ১৭) শ্রীচট্টল, ১৮) সাতগাঁও, ১৯) সীতাগঙ্গা, ২০) কাঞ্চননগর, ২১) সতের কাউন, ২২) পুষ্পপুর, ২৩) রামেশ, ২৪) কর্ণবুল, ২৫) সহরেসবুজ, ২৬) পার্ব্বতী, ২৭) খোর্দ্দ-আবাদ, ২৮) পোর্টো গ্রান্ডো (বৃহৎ বন্দর), ২৯) ফতেয়াবাদ, ৩০) আনক, ৩১) রোশাং, ৩২) ইসলামাবাদ, ৩৩) মগরাজ্য, ৩৪) চিটাগং, ৩৫) কিরাত, ৩৬) যতরকুল, ৩৭) চক্রশা, ৩৮) কেলিশহর, ৩৯) হালিশহর, ৪০) পেন্টাপোলিস, ৪১) হরিকেল, ৪২) চতুঃগ্রাম, ৪৩) শাৎগঙ্গ, ৪৪) চিৎ-তৌৎ-গৌং, ৪৫) চাটিগ্রাম, ৪৬) চাটিজান, ৪৭) সুদকাওয়ান, ৪৮) চাটিকিয়াং, ৪৯) শাতজাম, ৫০) চার্টিগান, ৫১) জেটিগা, ৫২) জাফরাবাদ, ৫৩) ক্রিসে, ৫৪) কিরাদিয়া, ৫৫) গাঙ্গে বন্দর।
এই বিবর্তন আমাদের জানায়, চট্টগ্রাম শুধুমাত্র একটি ভূগোল নয়, বরং একটি বহুরূপী ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক পরম্পরার প্রতীক।
চট্টগ্রামের ইতিহাস শুধু একটি অঞ্চলের নয়, এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবাহমান ধারার এক শক্তিশালী সাক্ষ্য। এ ইতিহাসের আলোকে চট্টগ্রামকে বুঝতে হলে তার প্রাচীন নাম, বন্দর, নদী ও সংস্কৃতিকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। গবেষণালব্ধ এই জ্ঞান আমাদের জাতীয় ইতিহাস চর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করবে।
তথ্যসূত্র:- Periplus of the Erythraean Sea, টলেমির মানচিত্র, ক্রিশ্চিয়ান লাসেন, হারুন রশীদ – সমুদ্রপথে গ্রিস থেকে বাংলায়, ম্যাকক্রিন্ডল, ইউলিয়াম ভিনসেন্ট, ইউলফ্রেড এইচ শফার, বাংলাপিডিয়া, বিশ্বকোষ, বিশ্ব ইতিহাস পরিক্রমা ২০২৪-২০২৫ -সোহেল মো. ফখরুদ-দীন, দৈনিক প্রথম আলো, ঈদ সংখ্যা ২০২৫।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইতিহাস চর্চা পরিষদ;
সম্পাদক, ইতিহাস বিষয়ক অনিয়মিত কাগজ ‘কিরাত বাংলা’।