ইলিয়াস বাবর
আপনি তো বেশ ভালোই আছেন, ভাবি পাইছেন, বেড়াচ্ছেন; ফোনের ও প্রান্ত থেকে এরকম কথা শুনে কিছুটা ভটকে যাই। মাথা যেন ঘুরছে। সকাল-সন্ধ্যা করি গাধার চাকরি, দিনের আলো কি বিকেলের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ হয় না যে মানুষের, তার বিরুদ্ধে এমন কথা কেউ বলে আন্দাজে আবার সেই বানোয়াটীপনাকে যখন দিব্যি দিয়ে আদায় করে নিতে চায় বৈধতা, তখন কথার তাপমাত্রা বাড়তে পারে। তাকে বলি, আপনি বোকার স্বর্গে আছেন। তবুও তিনি তার কথায় স্থির থাকলে স্বখেয়ালে গালি চলে আসে। গ্রামের ছেলে, গালি আমরা দিতে জানি। কিন্তু তিনি তখনই জুড়ে দেন আরেকটা অভিযোগ, আপনি তো অমনই, মুখ খারাপ; গল্পেও দেখি আমদানি করেন গালিগালাজ। যাদের মন খারাপ তাদের মুখ খারাপ হয়, গল্পের ভাষাও। ফোন রেখে দিলেও বিষয়টা বেশ ভাবিয়ে তোলে বৈকি।
আসলে গল্প কী? গল্পের সাথে গল্পকারের সম্পর্ক কোথাই? গল্পের বাজার চলতি যে সংজ্ঞা রবিবাবু দিয়ে গেছেন, যেটা কি না বহুল ব্যবহার আর সময়ের কালিমায় অনেকটা ম্লান। তবুও মনের খেয়ালে অনেকে তা আওড়ে যান। কিন্তু এটাই সবচে সত্য যে, একজন গল্পকার তার গল্প নির্মাণের কালে কোন সংজ্ঞা কি একাডেমিক পরিকাঠামোর ধার ধারেন না। এমনকি প্রকরণগত যে সব মারপ্যাচ আর করণকৌশলের ভেতরে গল্পপ্রকাশ পরবর্তী যে সব ট্যাগে ঠেলে দেয়া হয় তা নিয়েও বিন্দুমাত্র ভাবিত হন না গল্পকার। তিনি কেবল গল্পটাই নির্মাণ করেন এবং তা উপভোগ করেন। এটা অনেকটা এমন, বুলেটটা বের হয়ে গেল, ফিরিয়ে আনার সুযোগ তো নেই-ই, কোন লক্ষ্যে গিয়ে আঘাত হানে তাও আগে থেকে বলে দেয়া দুষ্কর। ফলে গল্পকারের চিন্তার সাথে বেশির ভাগ সময়েই পাঠকের চিন্তার বেমিল হতে পারে। বেমিলের এই ঘটনা গল্পটাকে শুইয়ে দেয় এমন অর্থ প্রচার করে না বরং গল্পের বহুমুখি প্রকল্প হয়ে উঠাকে সমর্থন করে। কিন্তু ফোনের ও প্রান্তে যিনি অভিযোগ করেছেন তার মনোস্কামনা অন্যরকম। তিনি এটাই কবুল করতে ও করাতে চান যে, গল্পে যা-ই লিখলেন তা-ই গল্পকারের জীবনের ঘটে যাওয়া কি একান্তই দেখে ওঠা ঘটনা। কে তাকে বলতে যাবে, সৃজনশীলতার সবচে বড় শক্তি সৃজনকারের প্রাসঙ্গিক কল্পনা। কল্পনার স্মার্টনেস ছাড়া কোন শিল্পই পূর্ণতা পায় না। যিনি কেবল বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে সোনা ফলান তিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলেন বটে সেইসাথে আরো একটা বিষয় তাকে ক্রমাগত উজ্জীবিত করতে থাকে, তা তার কল্পনার ঐশ্বর্য। একজন পাঠক কি অপরাপর লেখক হিসেবে যিনি এই কল্পনার রাজ্যটাকেও জোর করে অভিজ্ঞতা কি বাস্তবতার অন্দরে ঠেলে দিতে চান তাকে মূর্খ বা অন্ধ কোন নামে ডাকা যাবে তার ভার সময়ের কাছে ছেড়ে দেয়া বোধহয় সমীচিন হতে পারে।
তবে কিছু বিষয় আছে যা ঘটলেই কেবল একটা গুপ্তপথ খুলে যায় বিপুল সম্ভাবনার। যেমন, মহান একাত্তর (বাদ দেয়া যায় না, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন)। বাঙালির জীবনে একাত্তর না ঘটলে নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে যেমন পূর্ণ ধারণা পেতেন না তেমনি অনাবিস্কারের কালিমা তাকে বহন করতে হতো সুদীর্ঘকাল। সেই সাথে একজন মহান নেতা কিভাবে একটা জাতিকে এক সূত্রে গেঁথে দিতে পারেন হৃদয় দিয়ে তাও বিশ্ব দেখার সুযোগ পায়। ফলে এর ভেতর দিয়ে যাওয়া প্রজন্ম বা উত্তর প্রজন্মের সৃজনপ্রয়াসে একটা অকৃত্রিম ও মৌলিক অভিজ্ঞান যুক্ত হয়। যদি একাত্তর না আসতো, তাতে সাহিত্য তো বটেই বাঙালির জনজীবনেও আসতো না বৈচিত্রময় বিভা। কিন্তু আজকের দিনে লিখতে আসা গল্পকার তো একাত্তর দেখেননি, তার বেলা? তিনি কি তবে একাত্তরবাহিত সৃজনকলায় নিজেকে নিযুক্ত করবেন না? এখানেই বড় করে দেখা দেয় একজন লেখকের কল্পনার বিস্তার ও অতীতের গৌরবাশ্রিত ঘটনাকে বর্তমানে মিলিয়ে ভবিতব্যের সমান্তরালে দেখানোর সামর্থ্য। যারা প্রতিভাবান তারা শুধু দেশের নয় বিশ্বের যে কোন প্রান্তের ঘটনাকে দৈশিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করতে পারেন, মানবিক বিপর্যয়ে নিজের একাত্মতার সাথে শৈল্পিক সংযোগ ঘটাতে পারেন অনায়াসে। দুঃখের ভাষা এক, পরাজয়ের গ্লানি এক, বিজয়ের আনন্দ এক, ভেতরের রক্ত এক, সর্বোপরি মানুষ হিসেবে মর্যাদা এক; এই বোধ একজন গল্পকারকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। ফলে তার সৃজনক্রিয়ায় অভিজ্ঞতার চেয়ে বেশি প্রভাব রাখে কল্পনা, ভাষার চেয়ে বেশি বোধ।
তাই বলে অভিজ্ঞতার পরশপাথরকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। নিসর্গী ও কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়াকে আমরা দেখেছি লেখার জন্য জেলেদের সাথে দিনের পর দিন বেমান সাগরে কাটিয়ে দিতে, কথাকার হরিশংকর জলদাসকে যেতে হয়েছে ও-পাড়ায়। বর্তমান যুগটা স্পেশালিস্টের যুগ, ফলে আমরা ডাক্তার দেখাতে গেলেও আগের মতো এভারেজে না গিয়ে বরং বিশেষজ্ঞের কাছে যাই, তিনি হাজার টাকার টেস্ট দিন বা সিরিয়াল নিতে যত ঝক্কিই হোক না কেন! জামা কিনতে গেলে ব্রান্ড দেখে কিনি, কেন? তো সাহিত্যে জানাশোনার বিষয়টা আরো বেশি অধিকার নিয়ে দাঁড়ায়। অধ্যবসায় ও গভীরভাবে যিনি জানেন তারা এগিয়ে থাকেন। আবার যিনি জন্মের মাধ্যমে চেনেন তার সমাজকে তারচে বেশি আর কে তবে আঁকতে জানেন তার দেখা জনজীবনকে? এজন্যই বোধহয়, হরিশংকর জলদাসের জেলেজীবন নিয়ে লেখাগুলো এতবেশি দাগ কাটে পাঠকের। কিন্তু সেই একই লেখকের অন্য বিষয়ের লেখা পাঠককে ততটা টানে না বলেই বোধ করি। অদ্বৈত মল্লবর্মণ যেমন তিতাস নিয়ে, মহি মুহাম্মদকেও দেখি চা বাগান নিয়ে লেখতে; কারণ তারা ওসব চেনেন জন্মসূত্রে। যা কিছু আলগা তা বোঝা যায়, মেকিত্বের মেকাপটুকু আপনাতেই ভেসে ওঠে। কিন্তু একজন শাহনাজ মুন্নি যখন তাবলীগের চিল্লাহ নিয়ে অসাধারণ গল্প লেখেন তখন আমাদের অবাক হতেই হয় বৈকি! তার তো সুযোগ নেই চিল্লায় যাবার, কী করে তবে তিনি অমন গল্প নির্মাণ করলেন? তখন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে গভীরতর জীবনবোধ ও চারপাশের জীবনকে একজন গল্পকার কিভাবে দেখেন তার অংক। মনেপড়ে, কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশীদ একদা কবি শহিদুল আলীমের ব্যবসাকেন্দ্র চট্টগ্রামের ফলমন্ডি গেলে বিপুল বিস্ময়ে বলে বসেন, এ-তো গল্পের খনি! এখানে কত কত মানুষ যাওয়া-আসা করে, অজস্র চেহারার কত কত গল্প। একেকজন মানুষের পেছনে কত গল্প যে ঘুরে বেড়ায়, বাবর! না, সবাই গল্পের দেখা পায় না, সবাই গল্প দেখে না, সবার কাছে গল্প ধরাও দেয় না। ফলে অবুদ্ধির ঘট নিয়ে চিরকাল আফসোস করতে পারি বটে, মানুষের যাওয়া-আসা দেখি মগার সেসব মশলাকে গল্পের ভূবনে আনতে পারি না। কারা পারেন? যারা নিবিষ্ঠচিত্তে গল্প খোঁজেন, মানুষের পেছনে অচেনা মানুষটিকে খোঁজেন, হাসির পেছনের বিষাদটুকু চেনেন তারাই সবকিছুকে গল্পের দরবারে সোপর্দ করতে পারেন অনায়াসে। ফোনের ও প্রান্তে যিনি করে গেছেন নির্মম ফাজলামো তিনি হয়তো জানেন না, চলতি পথে, চেনা-অচেনা মানুষের কোলাহলে, আড্ডায়, পড়তে-পড়তে, লেখতে-লেখতে এমনকি ভাবতে-ভাবতেও গল্পের নির্মাণ হয়ে ওঠে। রাত জেগে, কপালে সিজদার দাগ, লম্বা দাঁড়ি, মক্কা-মদিনায় গিয়েও যেমন অনেকে পায় না অলৌকিক আনন্দ, তেমনি কেউ কেউ অনায়াসে, পার্থিব চলাফেরার ভেতরেই পেয়ে বসে অনেকটুকু। গল্পের খেলাটাও অনেকটা তাই। চিল্লায়ে মার্কেট পায় না, আকথার দোকানদারিতেও থাকে না গল্পের বীজ। যারা দক্ষ শিকারি তারা জানেন কখন টোপ দিতে হবে; কবে একটা আখ্যান গল্পের কাছে নৈবদ্য দেয় আপনাআপনি। অবশ্য বাংলা ছোটগল্পের রাজপুত্র হাসান আজিজুল হক বলেন ভিন্ন কথা! যখন একটা গল্প কি লেখা দ্রæত এগিয়ে যায় তখন তা বন্ধ করে দেন তিনি। অর্থাৎ লেখাটাকে থামিয়ে দেয়া হয় তার দ্রæতগতির চলার পথে। তাতে হয়তো তিনি নতুন করে ভাবনার অবসর পান, যেমনি একজন ড্রাইভার ব্রেক কষলে বুঝে নেন তাকে সামনের পথে কত গতিতে চালাতে হবে। আসলে গল্পের বাঁকবদল মূলত গল্পকারেরই স্বোপার্জিত টেকনিকের ইতিহাস। ফলে একটা ছোটগল্প যেমন শুধু অভিজ্ঞতার উপর ভর করতে পারে আবার স্রেফ কল্পনাতেও ভর করতে পারে। এবং স্থান-কাল-পাত্রভেদে ছোটগল্পের গন্ধ পরিবর্তন হয়, বদলে যায় তার চেহারা-সুরুত। কখনো কখনো মনে হতে পারে ছোটগল্প একই অঙ্গে নানা রূপের ছলনাপ্রিয় লাভ-ক্ষতি হিসেব করতে না-জানা চালাক বণিক।
তাহলে গালি? গল্প-গল্পকার-গালি একসূত্রে বাঁধা বলে কারো কাছে ভ্রম হতে পারে। কিন্তু ফোনের ও-প্রান্তের মহৎহৃদয়ের লোকটিকে কে বোঝাবে, গল্পে গালি কেবল একটা অবস্থাকে বর্ণনা করে না বরং ওই গালি তখন একটা শ্রেণিকে রিপ্রেজেন্ট করে। লেগুনা কি বাসে আমরা দেখি ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’। অর্থাৎ আপনার আচার-আচরণ এমনকি মুখনিঃসৃত শব্দাবলী আপনার বংশের পরিচয় বহন করে। তাহলে কথার সাথে সংযোগ থাকে গোত্রের, বর্গের এটা আর অস্বীকার করা যায় না। ফলে গল্পকারকে তার চরিত্রের অবস্থান হিসেব করেই শব্দ নির্বাচন করতে হয়। আপনি ভদ্রলোক, কিন্তু চলতি পথে রিক্সায় লেগে পছন্দের জামার কোণাটা ছিঁড়ে গেলে আপনার মুখ খারাপ হতেই পারে, মেজাজ বিগড়ে দু-চার কথা বলতেই পারেন। গল্পকার তো মূলত মানুষের ওই বিশেষ সময়টাই ধরার আপ্রাণ চেষ্ঠা করে! সাধারণ বিষয়াদি তো সবার চোখেই ধরা দেয়, তাহলে কষ্ট করে আর গল্প পড়ে সময় নষ্ট করবো কেন বাপু? আমাদের বুঝতে হবে, শ্রেণি বিভাজনের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে ভাষা-প্রকাশও। একজন জেলের মুখের ভাষার সাথে একজন কেরানিকে মেলানো দুষ্কর। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সাথে সিলেটি আঞ্চলিক ভাষাকে মেলানো আকাশ আর জমিনকে মেলানোর মতো ব্যাপার। কিন্তু আমার গল্পের চরিত্র, যে কি না বেড়ে উঠেছে রাজশাহীর আলো-হাওয়ায় গল্পের প্রয়োজনে শুধু নয়, জীবনেরও প্রয়োজনে তার মুখে পয়লা আসবে তার এলাকাতো ভাষাই। হালের নাটকেও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে আঞ্চলিক ভাষা। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও আছে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণেও কিছু আঞ্চলিক শব্দ আছে এবং বলা যায় এরূপ শব্দ সমবায় ভাষণটিকে করে তুলেছে হৃদয়গ্রাহী ও কমিউনিকেটিব। “পদ্মা নদীর মাঝি”র ‘মাঝি আমারে নিবা লগে’ ডায়লগটি কেন এখনো কানে বাজে, কোন আবেদনে? মানিকবাবু জানতেন কোথাই কি লাগাতে হয়! এই জানাটা বেশি করে, বলতে গেলে হৃদয় দিয়ে জানতে হয় গল্পকারকে। আমরা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে দেখি, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় গল্পে আঞ্চলিক ভাষার সফল ব্যবহার করেন। এরপরে তারাশঙ্করের মতো ক্ষমতাবান লেখকের হাত ধরে তা এখন নিয়মিতই চলছে। গালির প্রসঙ্গ ধরে আঞ্চলিক ভাষার বিষয়টা চলো এলো। এটা এ কারণে যে, দুটোই স্থানিক বিষয়াশয় ও ব্যক্তির মৌল আচরণকে প্রকাশ করে। বিষয়টা এমন, এখন বর্ষাকাল তা গল্পকার গল্পে বলে দেন না বরং এমন নিখুঁত শব্দ-ছবি তিনি নির্মাণ করেন যা পাঠকমাত্রকেই ধারণা দেয়, এখন বর্ষাকাল। অবশ্য লেখকভেদে কিছুটা তারতম্য থাকতে পারে। কেউবা সংকেতে প্রকাশ করতে পছন্দ করেন, কেউবা ডিটেইলস। তেমনিভাবে গল্পে আসে শ্রেণির চরিত্র, ধর্মের বাহ্যিকতা, সংস্কারের ভিত্তিমূল, চর্চার বালাই ইত্যাদি। এবং আশ্চর্য হলেও সত্য, এর মৌল-প্রকাশ সুনির্দিষ্ট শব্দের সাহায্যে। শব্দই আপনাকে নিয়ে যাবে ভাব ও বোধের গভীরে। এখন কেউ অর্বাচীনের মতো যদি গল্পে ব্যবহৃত ভাষা নিয়েই অযৌক্তিক আলাপ তোলে তাকে কী বলা যেতে পারে?
আমাদের এক লেখকবন্ধু, প্রায় এক যুগ আগে যার সাথে লেখার সূত্রে পরিচয়। তিনি তার বাবাকে বলেছিলেন, আমি যদি রাজমিস্ত্রি হতাম তবে যন্ত্রপাতি কিনে দেয়া লাগতো, ব্যবসাপাতি করলে পুঁজি দেয়া লাগতো ইত্যাদি, যেহেতু আমি লেখক হতে চাই, আমাকে বই কিনে দেয়া লাগবে বা বই কেনার পর্যাপ্ত টাকা দিতে হবে। তার মুখ থেকে এমন কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলাম, বিশেষত ওই উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করতে যাওয়া এক কিশোরের এমন কথা শুনে। আজ ভাবি, তার দাবি যৌক্তিক ছিল এবং তিনি ছিলেন যথেষ্টরকম সচেতন। এভাবে আমরা অনেকেই ভাবতে পারি না বলে ভুল বাক্য, ভুল পরিচ্ছদে সাজানো গল্প নামের অল্প-অগোছালো কথার হতচ্ছাড়া ভাব নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। আরো অবাক করার বিষয়, ওই ছাপানো অগল্পকে যখন ফেসবুক নামক প্যাকেজ নাটকের বুকে সেঁটে দেয়া হয়, তখন চেহারাগুণে বা সম্পর্কগুণে পাওয়া লাইক-কমেন্ট নিয়ে সে-কি উলম্ফন! নির্লজ্জের মতো কেউ কেউ সেটা বলেও বেড়ান যে, দেখছেন, কতটা পেলাম? দুঃখের বিষয়, আমার ওই বন্ধুর গোফ-গজানো বয়সে যেটা মালুম হয়েছিল, প্রায় মাঝবয়সেও তাদের সেটা মনে করার সময় হয় না। কিন্তু গল্পচর্চা তো পরচর্চা নয় যে, টপাটপ আন্দাজে ঢিল মারলেই কিছু একটা লেগে যাবে! এক্ষণে আমার মনে পড়ে যায় হামীম কামরুল হকের প্রবন্ধের একটা অংশের কথা। প্রাসঙ্গিক বলে শোনা যাক, “লেখাও এক খেলা। যেমন মাঠে নামার আগে দিনভর অনুশীলন। সেটিও যে হুবহু কাজে লাগবে তা তো নয়। খেলা তো এক ধরণের যুদ্ধও। আমরা সবাই জানি যেকোনো যোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। নিজের অস্ত্রটিকে নিয়মিত পরিস্কার করতে হয়। তারপর প্রকৃত যুদ্ধের মাঠে প্রতিপক্ষের মার ও পাল্টা মার অনুযায়ী সাজাতে হয় রণকৌশল। পরিস্থিতির ফেরে রণকৌশলও বদলাতে হয়। সেই রণকৌশলটা সাজাতে অনুশীলনটা কাজে দেয়। কিন্তু তত্ত¡ মেনে, অনুশীলন করেও হুবহু সেই ছকে কোনো কিছুই করা যায় না। না লেখায়, না খেলায়, না যুদ্ধে, না জীবনে। কিন্তু লড়াইটা জারি রাখতে হয় সর্বত্র। অনুশীলনের লড়াই। কি লেখায়, কি খেলায়, কি যুদ্ধে, কি জীবনে।” (ছোটগল্প-লেখকের প্রস্তুতি, ছোটগল্প লেখকের প্রস্তুতি ও অন্যান্য বিবেচনা, হামীম কামরুল হক)। নিজেকে জারি রাখার এই পথযাত্রায় ছোটগল্পকারকে সদা সক্রিয় থাকতে হয় চিন্তায়-বোধে-আহরণে-লেখায়-রেখায়-দেখায়। এই প্রার্থণা, বলা ভালো, এই নিয়তি নিজেকে তৈরি করে নিতে হয় ক্রমাগত আবিস্কারের ভেতর দিয়ে। লেখক চান না-চান এই অধ্যবসায় কি জারি থাকাই তাকে পরিচিত করিয়ে দেন, তিনি গল্পকার, গল্পই তার আরাধ্য। হাসান আজিজুল হক এটাকেই কবুল করেন এভাবে, “আমি যা করি না কেন, জুটেছে একটি উপাধি— গল্পকার। তার কারণ বোধহয় যে লেখাগুলো গল্প বলা হয় সেই লেখাগুলোই লিখেছি বেশি। নিজের কাছে মনে হয়েছে, গল্পে টুকরোর ভেতর দিয়ে সমগ্রকে প্রকাশ করা যায়, বিন্দুতেই প্রতিফলিত করা যায় সূর্যকে।” (ছোটগল্পে থাকা না-থাকা, কথা কথাসাহিত্য, হাসান আজিজুল হক)। কালের এহেন স্বীকৃতি অর্জনে পাড়ি দিতে হয় বিপুল বন্ধুর পথ। অজস্র জীবনের ভেতর ঢুকে গিয়ে, অসংখ্য মানুষকে দেখে একান্ত জীবন যাপন করা একজন লোকের কাছে কম ঝক্কির নয় কিন্তু একজন জাত গল্পকার তাই করেন।
শেষ করার তাগদা আসছে ভেতর থেকে। ওই অবিবেচক বন্ধুকে আরেক বার ধন্যবাদ না জানালে বরং নিমকহারামি হয়ে যাবে! তিনি তার মতো করে না বললে, এমনকি গল্প যে সব দেখে লেখার বিষয় তা না বললে হয়তো গল্প নিয়ে এতটুক ভাবনার অবসর হতো না। কে গল্প লেখলো, কে গল্পের বই করলো, কোন গল্প ঠিকে থাকবে তা যেমন আমরা আগ থেকে জানতে পারি না, তেমনি মাইরি করে বলতে পারি না, কেবল বাস্তব অভিজ্ঞতাই গল্পের সূত্রপথ। কোন এক গল্পকার দুঃখের সুরে বলেছিলেন আড্ডায়, তার স্ত্রী নাকি গল্পে নায়িকার জুই নাম দেখে বেচারা গল্পকারের উপর এমন ক্ষেপলেন, শেষে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিল, জুই কোনভাবেই তার পুরনো প্রেমিকা নয়, এমনকি তার কোন প্রেমও ছিল না ইহজীবনে। জুই ফুলকে ভালোবাসে আর চরিত্রের সাথে নামটি যায় বলেই রাখা, ব্যস। পাঠকের কথা তাও মানা যায়, কিন্তু যিনি নিজেকে বিশাল লেখক ভাবেন, তাকে কি জবাব দেবেন এক্ষেত্রে! হয়তো কেউ বলবেন, কলিকাল, কলিকাল! এভাবে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় যারা দেয় আর ছোটগল্পকে ভাবে যারা আনাত্মীয় সখা তাদের জন্য কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবির হুমায়ূনের নেয়া সাক্ষাৎকারের একটা অংশ শুনিয়ে দেয়া যাক, … কারণ সৃষ্টিশীলতার একটা বড়ো উৎসই হচ্ছে ফেন্সি এবং ইমাজিনেশন। ক্রিয়েটিভিটি, ইমাজিনেশন যার ভিতর থাকবে না সে নতুন লেখা তৈরি করতে পারবে না।” (পাতাদের সংসার, পৃষ্ঠা: ৭৮২, সম্পাদক: হারুন পাশা)। বাঙালি গল্পপাগল জাতি, তাই বলে গালগল্পের দিন শেষ। অনুবাদ ও পরিপার্শ্বের কল্যাণে জানাশোনা আর বিশদের যে পরিবর্তন আসছে তা গভীরভাবে ধারণ করে মানুষের পাশে আরেকটা মানুষ হয়ে শুয়ে থাকে ছোটগল্প। মানুষের সাথে ছোটগল্পের এই পিরিতি অনিঃশেষ।