প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য
কর্মময় জীবনে ৩৬ বছর অধ্যাপনা করার কারণে দীর্ঘ দিন ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার উত্তরপত্র পরীক্ষণ করতে হয়েছে। বিশেষ করে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি’ বিষয়ের উত্তরপত্র পরীক্ষণ করতে গিয়ে দেখেছি, অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বর্ণনা করতো। কর্মময় জীবন শেষ করে অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর নিয়েছি আজ প্রায় সাত বছর। অথচ এখনো বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করেনি। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নীত হতে হলে যে সব শর্ত পূরণ করতে হবে তা অবশ্য অনেকাংশে বাংলাদেশ পূরণ করেছে। সবে মাত্র উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর পূর্ব থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলাদেশকে উন্নয়শীল দেশ হিসেবে উত্তরপত্রে উল্লেখ করতো। এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ একটি অনুন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃত। এদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত বিশ্বের তুলনায় কত যে নিম্ন তা পারস্পরিক তুলনা করলে বুঝা যায়। ইউরোপের দেশগুলো, চীন, জাপান এবং আমেরিকাকে উন্নত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ‘উন্নত দেশ’ বলা হয়েছে কতগুলো বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে। এ বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের দেশের ন্যায় এশিয়ায়, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশে অনুপস্থিত। এ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে প্রথমে হচ্ছে মাথাপিছু আয় অধিক পরিমাণে হতে হবে। আবার শুধুমাত্র মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলে হবে না। উৎপাদন, সেবা ও প্রাত্যাহিক জীবনে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। শিক্ষার হার, গড় আয়ু বাড়তে হবে, শিশু মৃত্যুর হার ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেতে হবে। সর্বপরি সমাজে বৈষম্যের হার শূন্যতে নামিয়ে আনা সম্ভব না হলেও তা অনেকাংশে হ্রাস করতে হবে। শিক্ষা, গবেষণা এবং সামাজিক বণ্টন ব্যবস্থায় থাকতে হবে আধুনিকতার ছোঁয়া। তবেই একটি দেশকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় উন্নয়নশীল দেশ এবং পরবর্তীতে উন্নত দেশ হিসেবে। বাংলাদেশে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এর অনেক কিছুরই অভাব রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু মৃত্যু হার, মাতৃমৃত্যু হার ইত্যাদি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও গবেষণা, গুণগত শিক্ষা, আয় বৈষম্য, যোগাযোগের অবকাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। এসব কারণে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ এখনো একটি অনুন্নত দেশ। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও এখনো উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উঠতে পারেনি। অথচ এদেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ।
১৯৪৭ সালের পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান তথা এ অঞ্চলে একটি বিশেষ সামাজিক নিয়ম প্রচলন ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের পুরোটা জুড়ে ছিল দরিদ্র শ্রেণি লোকের বাস। তৎমধ্যে গুটি কয়েক লোকের বিভিন্ন প্রকারের ব্যবসা ছিল। যেমন- শহর-গঞ্জে ব্যবসা, বন্ধকী ব্যবসা, অধিক পরিমাণ জমির মালিক ইত্যাদি শ্রেণির লোকেরা বেশ টাকা-পয়সা আয় করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাদের মধ্যে যে সব লোকেরা লক্ষ টাকার মালিক হতো তারা বাড়ির আঙিনায় সুউচ্চ বাঁশ বা গাছের মাথায় রাত্রিবেলা একটি হারিকেন জ্বালিয়ে রাখতো। এটাকে ‘লাখের বাতি’- বলা হতো, এটা দ্বারা সমাজে জানানা দেয়া হতো যে, উক্ত ব্যক্তি লক্ষ টাকার মালিক। অর্থাৎ সমাজে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। উক্ত ব্যক্তির মান-সম্মান এবং সামাজিক স্তর উপরে বলে সমাজের অন্যান্যরা ধরে নিত। অবশ্য তখন এই সমাজ ব্যবস্থায় চোর, ডাকাত একেবারে ছিল না বলা যায়। সেই সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্য ছিল অধিক। এ রকম লক্ষপতি বা ধনী ব্যক্তি এক মহকুমার মধ্যে একটিও ছিল না। অর্থাৎ সমাজ ব্যবস্থায় লক্ষপতি ছিল খুবই কম।
সমাজ পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে, সামাজিক রীতিনীতি, বিধি ব্যবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী, লুটেরা, নির্লজ্জ ব্যক্তি এবং ঘুষখোর এর পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ যেমন বেড়েছে তেমনি জীবন যাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে। কিন্তু শ্রেণি বৈষম্য, আর্থিক বৈষম্য ইত্যাদিও বেড়েছে বহুগুণ। এমনটি হওয়ার তো কথা ছিল না। ১৯৭১ এর পরবর্তী সময়ে এদেশের দরিদ্র শ্রেণির মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি ঘুষঘোর, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন অনেক বার। অথচ বাংলাদেশ এখনও একটি অনুন্নত দেশ। তবুও এদেশে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। অন্যান্য সময়ের কথা বাদ দিয়ে যদি কোভিড পরবর্তী অর্থাৎ ২০২০ সালের পরবর্তী সময়ের কথা বিবেচনা করি তবে দেখা যায়, এই সময়ে বাংলাদেশে কোটিপতি বেড়েছে বহুগুণ। শুধুমাত্র ২০২০ সালে বাংলাদেশে কোটিপতি বেড়েছে ৭ হাজার (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর প্রতিবেদন)। অথচ একই সময়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। এই সময়ে উৎপাদন কমেছে, কলকারখানা বন্ধ হয়েছে, দোকানপাট বন্ধ থেকেছে, জিডিপি সংকুচিত হয়েছে, কিন্তু ধনীরা ঠিকই আরো ধনী হয়েছে। ২০২১ সালে বিশ্বখ্যাত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি ধনীদের ‘ডিপোজিট’ বেড়ে দাঁড়াল প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, মহামারির পরপরই এই ‘ডিপোজিট’ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ হারে। এমনকি মহামারির ১৮ মাসে দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশি নাগরিকেরাই। অনুমান করা যায়, প্রায় পুরোটাই পাচার করা টাকা। অর্থনীতির সাধারণ তত্তে¡র বাইরে আরো অনেক অঘটন দেখা যায়। একদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ডলার সংকট আর অপরদিকে ভয়াবহ ডলার সংকটের মধ্যেও দেশে বিলাস বহুল গাড়ি আমদানি ঠেকানো যাচ্ছে না। গত চার বছরে শত শত বিএমডবিøউ, রেঞ্জ রোভার, মার্সিডিজ এর মত অত্যাধিক দামি গাড়ি প্রচুর আমদানি হয়েছে বাংলাদেশে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে যে, ২০০ শতাংশ শুল্ক বসানোর পরেও বিলাসী গাড়ির আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩০০ শতাংশ।
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়েলথ এক্স একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, দ্রæত ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় চীন, ভারত এমনকি দুবাইকে ফেলে বাংলাদেশ প্রথম হয়েছে। অন্যভাবে বলায় যায়, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে সারা দুনিয়ার মধ্যে চীন নয়, ভারত নয়, দুবাইও নয় বরং আমাদের এই ঋণগ্রস্ত বাংলাদেশই সবার শীর্ষে। এদেশে শিল্পায়নের গতি শ্লথ নতুন কোন কারখানা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। ক্রমাগত শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে। গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তবুও বাংলাদেশে ধনী আরো ধনী হচ্ছে। কিন্তু কিভাবে? বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশে ধনী হওয়ার সহজ উপায় আছে। প্রথমত, এই দেশে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর টাকা ফেরত দেয়া লাগে না। দ্বিতীয়, ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে নিজদের লোক বসিয়ে গোটা ব্যাংকই নিয়ে নেয়া যায়। তৃতীয়ত, কমিশন বাণিজ্য করেই হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়া সম্ভব। চতুর্থত, নির্বাহী ক্ষমতা থাকলে বিশাল বিশাল সুযোগ সুবিধা কোন শিল্পপতিকে পারিয়ে দিয়ে কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে কানাডার বেগম পাড়ায় বাড়ির মালিক হওয়া যায়। পঞ্চমত, প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে অবাস্তব খরচ দেখিয়ে প্রচুর পরিমাণ ভাগ-বাটোয়ারা করা সম্ভব। ষষ্ঠত, কিশোর গ্যাং লালন করে এলাকায় চাঁদাবাজি করে কোটিপতি হওয়া যায়। সপ্তমত, ক্ষমতাসীন ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক রেখে ক্যাসিনো কান্ডে জড়িত হয়ে কোটিপতি হওয়া যায়। আরো কতপথ খোলা আছে।
সবচেয়ে আশ্চর্য্যরে ব্যাপার হচ্ছে যে, এইসব কোটিপতিরা এত টাকার মালিক হয়েও দেশের ভেতর তেমন উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেনি। বিদেশে পাচার করে দিয়েছে তাদের দুর্নীতি করে আয়কৃত টাকা। আবার এইসব ধনীরা আয়করও দেয় না। এনবিআর (ন্যাশনাল বোর্ড অব রিভিনিউ) এর প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায়, দেশের ৮৭ ভাগ ধনীই আয়কর দেয় না। সুতরাং ধনীদের আছে শুধু আয় আর আয়। তেমন করও দিতে হয় না। অতএব বাংলাদেশের ন্যায় অনুন্নত দেশে ধনী হওয়া খুবই সোজা। শুধু প্রযোজন সুবিধা মত জ্যাক।
কিছুদিন আগে পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরটি খুবই চমকপ্রদ। ঈশ্বরদীতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল যেসব কৃষকেরা তৎমধ্যে ৩৭ জন কৃষক যথাসময়ে ব্যাংকে ঋণ ফেরৎ দিতে পারেনি। ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী হয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তার মধ্যে ১২ জনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠিয়েছে। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সরকারের কাছে তথা ব্যাংকের কাছে এইসব কৃষকের ঋণ ছিল মোট ৩০ হাজার টাকা।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি