খেটে খাওয়া মানুষের ভরসা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ’র (টিসিবি) পণ্য। স্বল্পমূল্যে ভোগ্যপণ্য ক্রয় করা যায় বলে নিয়মিত ভিড় লেগে থাকতো ট্রাক সেল কার্যক্রমে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে টিসিবি’র পণ্য ক্রয়ে প্যাকেজ প্রথা চালু করায় গরিবরা টিসিবিবিমুখ হয়ে পড়ছে। এতে কমে গেছে ক্রেতার সংখ্যাও। যদিও প্যাকেজ বিক্রি করার কোন নিয়ন নেই বলে জানিয়েছেন টিসিবি’র কর্মকর্তারা। এতে একদিকে যেমন ব্যাহত হচ্ছে সরকারের উদ্দেশ্য, অন্যদিকে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য ক্রয় করতে পারছেন না দরিদ্ররা। তবে ছোলা ও পেঁয়াজের স্টক শেষ হয়ে গেলে এ অবস্থা আর থাকবে না বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
গতকাল বুধবার নগরীর সিডিএ ১নং, কোতোয়ালী, আন্দরকিল্লা, আগ্রাবাদ ও জামালখান এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, প্যাকেজে বিক্রি করা হচ্ছে টিসিবি’র পণ্য। বেশ কিছু ক্রেতা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী পণ্য কিনতে চাইলেও বিক্রেতারা পণ্য বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানান।
একটি সূত্র জানিয়েছে, আমদানি করা পেঁয়াজ আগামী সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে। আর ছোলাও সোমবারের দিকে শেষ হয়ে যাবে। তখন আর প্যাকেজে বিক্রি করতে পারবে না।
টিসিবি’র ট্রাক সেলাররা জানান, ছোলা, খেজুর, চিনি, মসুর ডাল ও সয়াবিন তেল ট্রাকের মাধ্যমে নিয়মিত নগরীর ৩০টি পয়েন্টে বিক্রি করা হচ্ছে। সেখানে প্রতিদিন ছোলা দেয়া হচ্ছে ৪০০ কেজি ও মশুর ডাল দেয়া হচ্ছে ৬০০ কেজি। এছাড়া চিনি ৮০০ কেজি, পেঁয়াজ এক টন (১০০০ কেজি) ও সয়াবিন তেল এক টন। টিসিবি থেকে এখনো খেজুর সরবরাহ না করায় তা বিক্রি করা যাচ্ছে না। বর্তমানে ছোলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা, মশুর ডাল ৫৫ টাকা, চিনি ৫৫ টাকা, সয়াবিন তেল লিটার ১০০ টাকা ও পেঁয়াজ ২০ টাকা। নতুন যোগ হতে যাওয়া খেজুর ৮০ টাকা দামে বিক্রি হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।সিডিএ ১নং এলাকায় টিসিবির ট্রাকে ৯৫০ টাকা প্যাকেজ করে ৬টি পণ্য বিক্রি করছেন ডিলারের প্রতিনিধিরা। এর মধ্যে ছিল ১০০ টাকা লিটার দরে ৫ লিটার তেল, ৫৫ টাকা দরে ৩ কেজি করে ছোলা, ৫৫ টাকা দরে ২ কেজি করে চিনি ও ৫৫ টাকা দরে ১ কেজি মসুর ডাল, ৮০ টাকা দরে এক কেজি খেজুর এবং ২০ টাকা দরে ২ কেজি পেঁয়াজ। লকডাউনের মধ্যেও ক্রেতারা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে তীব্র দাবদাহ উপেক্ষা করে পণ্য সংগ্রহ করেন। তবে প্যাকেজ করে পণ্য বিক্রি করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে। গ্রাহকের চাহিদামত পণ্য কিনতে না পারায় সরকারের উপর অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
সিডিএ ১নং এলাকায় টিসিবির পণ্য কিনতে আসা বয়োবৃদ্ধ হাজী ইউসুফ নামে এক ক্রেতা জানান, ‘টিসিবি থেকে ডাল, তেল ও চিনিসহ বাজার থেকে অন্যান্য পণ্য কিনতে আমি বাসা থেকে একহাজার টাকা নিয়ে বের হয়েছি। কিন্তু প্রয়োজন না থাকা সত্তে¡ও আমাকে টিসিবি থেকে ৯৫০ টাকা দিয়ে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এতে আমার অন্য পণ্য কিনতে টাকার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।’
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব এলাকায়ও প্যাকেজে পণ্য বিক্রি করতে দেখা গেছে, সেখানে প্রতি প্যাকেজ বিক্রি হচ্ছে ৬৭৫ টাকায়। যেখানে ১০০ টাকা দরে সয়াবিন তেল ৪ লিটার, ৫৫ টাকা দরে ৩ কেজি ছোলা ও ৫৫ টাকা দরে ২ কেজি চিনি বিক্রি করা হচ্ছে। প্যাকেজে বিক্রির কথা শুনে অনেককে লাইন ছেড়ে চলে যেতে দেখা গেছে।
প্রেসক্লাব এলাকায় পণ্য কিনতে আসা মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, ‘অনেকের সামর্থ্য নেই প্যাকেজে পণ্য কেনার। তাই বিক্রেতারা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে যখন পণ্য দিচ্ছেন না, তখন খারাপ লাগবে সেটাই স্বাভাবিক।’
রনি মিত্র নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘সরকারি সুবিধা ও দামে সাশ্রয় বলে আমরা এখান থেকে পণ্য কিনতে আসি। আমাদের অনেক পণ্যের প্রয়োজন না থাকা স্বত্তে¡ও বাধ্য হয়ে কিনতে হয়। সুতরাং এখান থেকে না কিনে দোকান থেকে কিনলে আরও ভাল হবে মনে করি। ওখানে তো আর এভাবে প্যাকেজ থাকবে না।’
জামালখান এলাকায় টিসিবি’র ডিলার এম এ ছবুর এন্ড ব্রাদার্সের পণ্য বিক্রেতা মো. দিদারুল আলম বলেন, ‘আমাদের সবকিছু সমন্বয় করে পণ্য বিক্রি করতে বলা হয়েছে, তাই করছি। তা না হলে নির্দিষ্ট কিছু পণ্য বিক্রি হবে, আর অন্য পণ্যগুলো অবিক্রিত থেকে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ডিলার। কে সমন্বয় করে পণ্য বিক্রি করতে বলেছেন এমন প্রশ্নে কিছু বলেননি ওই বিক্রেতা।’
বিক্রয়কর্মীরা বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষেরা প্যাকেজ কিনতে আর্থিক অসঙ্গতির কথা জানাচ্ছেন। অথচ অনেকেই একসঙ্গে ৫ লিটার, ১০ লিটার করে তেল কিনতে আসেন। কিন্তু পেঁয়াজ কিনতে চান না। এর আগে গত বছর এই বড় বড় পেঁয়াজ নেয়ার জন্যই মানুষ হাহাকার করেছেন। তারা বলেন, পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য। আমাদেরকে টিসিবি থেকে এ পণ্যটাও নিয়ে আসতে হয়। ক্রেতারা না নিলে আমাদের অনেক ক্ষতি। ইতোমধ্যে অনেক পেঁয়াজ ফেলে দিতে হয়েছে বলেও জানান বিক্রেতারা।
টিসিবি’র আঞ্চলিক প্রধান জামাল উদ্দিন আহমেদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্যাকেজ করে পণ্য বিক্রির কোনো নিয়ম নেই। তবে পণ্য কেনার জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে। কেউ নিলে নিবে, না নিলে নাই। কোনো ডিলার পণ্য নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকলে তারা তা অন্যায় করছে। আমাদের কাছেও ইতোমধ্যে কিছু অভিযোগ এসেছে। আমরা তদারকিতে আছি। তবে এ ধরনের ডিলারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সকালে মিটিং এ আমি বিষয়টা সকল ডিলারদেরকে পরিষ্কার করবো।’
তিনি বলেন, ‘পচনশীল পণ্য পেঁয়াজ। তাই পেঁয়াজ বিক্রির জন্য তারা হয়তো এ ধরনের পন্থা অবলম্বন করছেন। একই সাথে আগামী সোমবার থেকে ছোলাও বিক্রি বন্ধ করে দেয়া হবে। তখন প্যাকেজ নিয়ম হয়তো আর থাকবে না।’
আগামী ৬ মে পর্যন্ত টিসিবি’র পণ্য বিক্রি কার্যক্রম চালু থাকবে। এরপরে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানান আঞ্চলিক প্রধান।
উল্লেখ্য, গত ১৮ মার্চ দুপুর থেকে টিসিবি পণ্য বিক্রি শুরু করে। এসব পণ্য নিয়মিত নগরের ২ নম্বর গেট, আগ্রবাদের হোটেল সাংরিলা’র সামনে, চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং গেটের সামনে, জামালখান প্রেসক্লাবের সামনে, আলকরণ, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের সামনে, নিউমার্কেট মোড়, বিবিরহাট, মুরাদপুর, উত্তর কাট্টলি, হালিশহরে এ ব্লকে, মাদারবাড়ি, কর্ণফুলীর ব্রিজ ঘাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, আমবাগান, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, বহদ্দারহাট পুলিশ বক্স, সিমেন্ট ক্রসিং, কাটগড় স্টিলমিল, ইপিজেড থানার সামনে, বন্দর থানার সামনে ও পোর্ট কলোনির পোর্ট বাজার মিলিয়ে ৩০টি স্থানে এসব পণ্য ট্রাকের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে।