
ড. শামসুদ্দীন শিশির
কিছু কিছু আলোকশিখা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সংকীর্ণ মনের অন্ধকার দিগন্ত ভেদ করে দীর্ঘদিন জাতির চিত্তাকাশকে রাখে সমুজ্জ্বল। ঐতিহ্যবিদ আবদুল হক চৌধুরী তেমনই এক আলোক শিখা। সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমাজ মানসকে। যার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন তাঁর ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ’, ‘চট্টগ্রামের সমাজও সংস্কৃতি’ ইত্যাদি গ্রন্থে। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদÐ হয় তবে একটি সুষ্ঠু জাতি বিনির্মাণের একচ্ছত্র কারিগর হলেন শিক্ষক আবদুল হক চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষকতার মত মহান পেশা দিয়েই। তাঁর শিক্ষানুরাগী পিতার প্রতিষ্ঠিত নোয়াজিশপুর ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দে পর্যন্ত তিনি ঐ স্কুলে শিক্ষকতা করে ছিলেন। এরই মধ্যে ১৯৪৩ সালের ১৮ মার্চ ফটিকছড়ি থানার বক্তপুর গ্রামের মুন্সী কায়কোবাদ-এর প্রথমা কন্যা জোবাইদা বানু-র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। যিনি ছিলেন তাঁর আজীবনের সহযোগী। যা তিনি তাঁর নিজ জীবনীতেও উল্লেখ করেছেন। স্কুলে শিক্ষকতাকালে তাঁদের পারিবারিক পূর্ব পুরুষ মধ্যযুগের কবি কোরেশী মাগনের পরিচয় সন্ধান সূত্রে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সঙ্গে তার পত্রালাপ শুরু হয়। ১৯৪৪ খ্রীস্টাব্দে পটিয়ার সুচক্রদন্ডীতে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের আমন্ত্রণে গবেষণার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাঁর রচনা দেশে বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছে। আবদুল হক চৌধুরীর রচিত চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ (১ম ও ২য় খÐ); চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি, গ্রন্থ দু’টি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত¡ বিভাগের আকরগ্রন্থ হিসেবে পাঠ্যক্রমভুক্ত।
সদা হাস্যময় আবদুল হক চৌধুরী ছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রিয়। কারণ মানুষের কাছে গিয়ে ভালবাসা নিয়েছেন। তথ্য সংগ্রহ করে সত্যকে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন কখনই অন্যের লেখা বই থেকে নকল করে নিজের গবেষণাকে সমৃদ্ধ করতে চাননি। তাঁর মত মহৎ আত্মার মানুষই আমাদের সমাজে বড় বেশী প্রয়োজন। প্রতি বছর অক্টোবর মাস
আসলেই আমরা তাঁকে স্মরণ করি। কিন্তু আমার মনে হয় তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী সম্পর্কে এখনও অনেকেই জানেন না। তাছাড়া প্রকাশিত বই গুলোর কপিও ফুরিয়ে গেছে। তাই শিক্ষিত উদ্যোগী ব্যক্তি বর্গের কাছে আমার সবিনয় অনুরোধ আবদুল হক চৌধুরীর শ্রমের ফসল বই গুলো পুনর্বার ছাপানোর ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। উপমহাদেশের বরেণ্য গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোয়াজিশপুর গ্রামে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্ট। পিতা আলহাজ্ব সরফুদ্দীন ছিলেন রেঙ্গুন পোর্ট কমিশনের ড্রেজার হেসটিংস-এর দ্বিতীয় প্রকৌশলী। ঐতিহ্যের বাহক আবদুল হক চৌধুরী ছিলেন মধ্যযুগের কবি চন্দ্রাবতী কাব্য রচয়িতা কোরেশী মাগনের সপ্তম অধস্তন পুরুষ।
ইতিহাসের বরপুত্র আবদুল হক চৌধুরী অ, আ, ক, খ শিক্ষা শুরু করেন পিতৃগৃহে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন স্ব-গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন রাউজান আর আর এ সি ইনস্টিটিউশনে। বিদ্যা অর্জনের আগ্রহ পরবর্তীতে শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া প্রেরণা পাথেয় হয়েছিল। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর পরিবরে বিপর্যয় নেমে আসে পিতার একমাত্র পুত্র হওয়াতে তাঁকে বাস্তবতার মাথামুখি হতে হয়। অষ্টম শ্রেণির পাঠ শেষ হওয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আর এগোয়নি । থেমে থাকেননি তিনি। অদম্য সাহস নিয়ে পুথিগত বিদ্যার সীমিত গন্ডি পেরিয়ে প্রকৃত শিক্ষার সন্ধানে ছুটে বেড়িয়েছেন যুগের পর যুগ। নিরন্তর ইতিহাস সন্ধানী চট্টল গৌরব আবদুল হক চৌধুরী বাংলা ও বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পুরানো জনপদ এ চট্টলার অনেক অজানা বিষয়কে তাঁর আজীবন সাধনার দ্বারা লোক-গোচর করেছেন। চট্টগ্রামের সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সাহিত্য সম্পদের শিকড় সন্ধান করে খুঁজে বের করেছেন অনেক দুর্লভ উপাদান। মুক্ত চিন্তার অধিকারী, পরিশ্রমী দেশপ্রেমিক চট্টল বিশারদ আবদুল হক চৌধুরীর অক্লান্ত সাধনায় চট্টগ্রামের বুকে অতীতে বিরাজমান অনেক তত্ত¡ ও তথ্য উদ্ধার করে সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের। সাহিত্যবিশারদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হন। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের পরামর্শে ও উৎসাহে তিনি চট্টগ্রামের প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শনের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং এ সম্পর্কিত তথ্য, উপাত্ত সংগ্রহ ও অধ্যয়নের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
মহৎ ব্যক্তিত্বের অধিকারী নিরহংকার এই মানুষটির জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে সাধারণ মানুষদের কাছাকাছি। গ্রামের সহজ সরল মানুষদের ভালোবেসে তিনি আনন্দ পেতেন। মাটি ও মানুষের কাছাকাছি ছিল তাঁর অবস্থান। তাই জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে স্মৃতি বিজড়িত স্বগ্রাম নোয়াজিশপুরে। গ্রামের মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর নাড়ীর বন্ধন। গ্রামই ছিল তাঁর সর্বাধিক প্রিয়। কারণ গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থানের নাম, দীঘি, জলাশয় মসজিদ, মন্দির, দলিল দস্তাবেজ ইত্যাদি সংগ্রহ করেন এবং ইতিহাস পুনর্গঠনের কাজে আত্ম নিয়োগ করেন। এ জন্যই তিনি গ্রামের অবহেলিত মানুষের সংস্কৃতি ও মন মানসকে তাঁর গবেষণায় তুলে ধরতে এতটা পারঙ্গমতার পরিচয় দিতে পেরেছেন। তাঁর জীবন যাপনও ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে ও আড়ম্বরহীন, সচ্ছলতা থাকা সত্তে¡ও তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অতি সাধারণ পোশাকে দিন কাটিয়েছেন। পরিধানে নয়, মননে ঈর্ষণীয় হওয়াই ছিল তাঁর লক্ষ্য। আজকের যুগে এক্ষেত্রে তিনি এক ও অনন্য।
তিনি ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তাঁর অতুল স্পর্শী গভীর প্রতিভার যাদুস্পর্শে ঐশ্বর্য দান করলেন। তিনি একাই যেন একটি যুগ, একটি শতাব্দী। শতাব্দীর সিঁড়ি অতিক্রম করে কাল প্রবাহের বিস্তীর্ণ সীমানা পেরিয়ে তিনিই ইতিহাস মনা মানুষের চিত্তে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর প্রকাশিত মোট গ্রন্থ: ১১ টি। লেখালেখির বাইরে তিনি নিজেকে সমাজসেবায় সম্পৃক্ত রেখেছেন । এই কর্মীর আহরিত তথ্য নিয়ে চতুর প্রকৌশলীরা ঘরে বসে ইমারত নির্মাণ করবেন। বড় জোর কোন প্রসঙ্গ মিলিয়ে দেখার কষ্ট স্বীকার করতে পারেন। আবদুল হক চৌধুরী হয়তো শৃঙ্খলা মেনে চলেননি আর তার জন্য শৃঙ্খলা বড় নয়, বড় ছিল উপকরণ সংরক্ষণ, কাঁচামাল সরবরাহকারীর ও এক ধরনের শৃঙ্খলা বোধ থাকে, তিনি অবশ্যই দক্ষ যোগানদার, তার শ্রম ও শক্তি ব্যয়ের সঙ্গে মেধার মিশেল অস্বীকার করবে কে?
আমার ইচ্ছে চট্টগ্রামের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম জানুক আবদুল হক চৌধুরী কে ছিলেন? তা ছাড়া চট্টগ্রাম সম্পর্কে জানতে চাইলেও তারা আবদুল হক চৌধুরীর লেখার মাধ্যমেই জানতে পারবে। এ সময়ে অধ্যাপক মজির উদ্দিন মিয়া ও অধ্যাপক তসিকুল ইসলাম-এর ‘আবদুল হক চৌধুরী’ স্মারক গ্রন্থে’র একটি উদ্ধৃতি দেয়া প্রয়োজন। তাঁদের মতে “আমার মনে হয় মুহুর বন্যার মত কোন দুর্বিপাকে যদি চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, আরাকান ধ্বংস হয়ে যায় এবং বহু বৎসর পর কোন আবিষ্কারক কোন দ্বীপ বক্ষে ‘সী-ঈগল নীড়ে একখন্ড ‘চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা’ পেয়ে যান তা হলে সমগ্র জনপদ তার সকল কীর্তিসহ পুনরাবিষ্কৃত হবে।”
ঐতিহ্যবিদ আবদুল হক চৌধুরী ছিলেন একজন ধ্রæবতারা, একজন দিকপাল। ২০১২ সালে তাঁকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার একুশে পদকে ভ‚ষিত করেন । বাংলাদেশ যাদুঘরের অংশ হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ‘আবদুল হক চৌধুরী স্মৃতি যাদুঘর ও সংগ্রহশালা’ গবেষকের পৈতৃক ভিটায় চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার অন্তর্গত নোয়াজিশ পুরে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু জনবল নিয়োগ না দেওয়ার কারণে নির্মিত ভবন এবং অন্যান্য আসবাবপত্র ও গবেষণাগ্রন্থ নষ্ট হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আকুল আবেদন দ্রæততম সময়ের জনবল নিয়োগ দিয়ে ঐতিহ্যের ধারক যাদুঘরটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করুন।
প্রজন্মের কাছে গবেষক আবদুল হক চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিবছর স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করার অনুরোধ করছি। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মারক বৃত্তি প্রচলন করারও অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালের ২৬ অক্টোবর এই মহান গবেষক আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
লেখক : শিক্ষা চিন্তক











