অমল বড়ুয়া
নৃতাত্ত্বিকরদের মতে, গণতন্ত্র যে কোনও রূপেই হোক, কোনও দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ গোষ্ঠী বা উপজাতি থেকে স্বাভাবিকভাবেই উৎপত্তি হয়েছিল। এই জাতীয় গণতন্ত্রকে সাধারণত উপজাতীয়তা বা আদিম গণতন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। প্রাচীন এথেন্সে প্রায় ৪০৮ খ্রিস্টপ‚র্বাব্দে সরকারের রূপ হিসাবে গণতন্ত্র এবং সংবিধানের ধারণার উৎপত্তি হয়েছিল। সাম্প্রতিক দশকগুলির পন্ডিতরা অনুসন্ধান করেছেন যে, প্রথমে গণতান্ত্রিক সরকারের দিকে অগ্রগতি (গ্রিস ব্যতীত) অন্য কোথাও ঘটেছিল কিনা। কারণ গ্রীসে জটিল সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিকাশ মিশর এবং নিকট প্রাচ্যের প্রাচীনতম সভ্যতার আবির্ভাবের অনেক পরে ঘটেছিল। প্রাথমিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের আরেকটি নিদর্শন আসে ভারতের স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ‘সংঘ এবং গণ’ থেকে, যা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু করে কিছু কিছু অঞ্চলে চতুর্থ শতাব্দী অবধি বিদ্যমান ছিল। গ্রীক ঐতিহাসিক ডিয়োডরাস উল্লেখ করেছেন যে- স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি ভারতে বিদ্যমান ছিল। গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িককালে লিচ্ছবিদের একটি প্রধান পরিচালনা পর্ষদ ছিল যাতে ৭০৭৭ জন রাজা ছিলেন, প্রত্যেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের প্রধান ছিলেন। রাজা বা সরকার সমাবেশের সাথে তাঁর কার্যক্রমের সমন্বয় রেখে চলতেন; শাক্য, কলিয়, মল্ল এবং লিচ্ছবিদের ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ-দরিদ্র সকল পুরুষের জন্য এই সমাবেশের দ্বার খোলা ছিল। প্রথম প্রজাতন্ত্র ‘গণ বা সংঘ’ মল্লদের ক্ষেত্রে কুশীনগর শহরকে কেন্দ্র করে এবং বৃজি সংঘটি বৈশালী শহরকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গড়ে উঠেছিল এবং চতুর্থ শতাব্দী অবধি কিছু অঞ্চলে স্থায়ী হয়েছিল। আধুনিক পÐিতেরা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর সময়ে গণতন্ত্র শব্দটি চিহ্নিত করেছেন যা পরে অবক্ষয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল ফিলিপস হান্টিংটন তাঁর রচিত ‘দ্য থার্ড ওয়েভ: ডেমোক্রেটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’ গ্রন্থে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক যাত্রার তিনটি জোয়ারের কথা বলেছেন। ১৮২৮ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত প্রথম জোয়ারে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিশ্বের ২৯টি দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় জোয়ার শুরু হয়েছিল। গণতন্ত্রের তৃতীয় ও শেষ জোয়ারটি ছিল ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত, যখন দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া ও বিভিন্ন কমিউনিস্ট দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে।
কিন্তু আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় সেই পুরনো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এখন তীব্র সংকট ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ১৬৭টি দেশ ও অঞ্চলের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর প্রকাশিত প্রতিবেদনমতে, গণতন্ত্রের বৈশ্বিক গড় সূচক ২০২২ সালে ছিল ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ২৩ শতাংশে। ২০০৬ সালের পর থেকে গণতন্ত্র সূচকের এই পশ্চাৎপদতা ও স্থবিরতা অব্যাহত আছে। ২০২৩ সালে ফ্রিডম হাউসের প্রকাশিত ‘বিশ্বে স্বাধীনতা-২০২৩: গণতন্ত্রের সংগ্রামে ৫০ বছর পূর্তি’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, টানা ১৭ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা হ্রাস পাওয়ার কারণে গণতন্ত্রের ধারাবাহিক অবনমন ঘটছে। বিশ্বের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি (৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ) মানুষ কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরশাসনের অধীনে বাস করে, যেখানে পূর্ণ গণতন্ত্রে বাস করে মাত্র ৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ। ভি-ডেমের প্রতিবেদনমতে, ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ অর্থাৎ ৫৭০ কোটি মানুষ স্বৈরশাসনের অধীনে বাস করছে। বিশ্বের ১৭৩টি দেশের মধ্যে ৮৫টি দেশে গণতন্ত্র সংকটের মুখে আছে। জার্মানির ব্যার্টেলমান ফাউন্ডেশনের গবেষণার তথ্যানুযায়ীও বিশ্বে দুর্বল প্রশাসন ও গণতন্ত্রের সংকট দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাজার অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেওয়া বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের রোল মডেল দেশের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কমজোর ও দুর্বল হয়ে আসছে গণতান্ত্রিক কাঠামো শক্তিশালী করার প্রয়াস। গণতন্ত্র সূচক তৈরি করে এমন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য-উপাত্ত বলছে, নানা ধরনের আক্রমণের মুখে বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানগুলো সঙ্কটের মুখে পড়েছে, বিপরীতে দেশে দেশে নতুন ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ক্ষমতাসীনরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পরও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি জলাঞ্জলি দেয়ায় স্বৈরাচারীকরণের হার বাড়ছে। প্রসার ঘটছে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার। বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী বহু সরকার আইনের কোনো লঙ্ঘন না করেই নির্বাচনে কারচুপি করতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মধ্যে থাকবে বহু দল ও নির্বাচন এবং বিরোধী দলের সমালোচনা হচ্ছে এর অপরিহার্য অংশ। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি শুধু আমলাশ্রেণি ও প্রতিষ্ঠানকেই কলুষিত করে না, তা সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংস করে দেয় স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাধীন পুলিশ বিভাগ, স্বাধীন গণমাধ্যম ইত্যাদি যা রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য। ওয়াশিংটনভিত্তিক ফ্রিডম হাউস নামক সংগঠনের মতে, ২০০৬ সালের পর থেকে বিশ্বে কর্তৃত্ববাদ বাড়ছে। কমছে গণতন্ত্রের আবহ। বিশ্বের সব মানুষের তিনজনের মধ্যে দুজনের বসবাস এখন পূর্ণ গণতন্ত্র নয় এমন পরিবেশে।
আমাদের বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে গণতন্ত্র বিপর্যয়ের প্রথম কারণ হচ্ছে- শিক্ষা। আমরা একাডেমিক শিক্ষায় অগ্রগামী হলেও জ্ঞান নির্ভর নৈতিক শিক্ষায় পিছিয়ে আছি। এই শিক্ষা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অন্তর্দৃষ্টির উম্মিলন, চিন্তাশক্তির বিকাশ ও প্রতিসম্ভিদার (পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণে) সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করে না। এই শিক্ষা কেবলমাত্র করণিক কর্মকান্ড পরিচালনায় অভিরমিত হতে শেখায়। প্লেটো বলেছেন যে, সামাজিক সংগঠনের শেষ অস্তিত্ব শেষ পর্যন্ত জ্ঞানের উপর নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত মনস্তাত্তি¡ক- অর্থাৎ গণতন্ত্রকে গ্রহণ ও চর্চা করার যে মানসিক প্রপঞ্চ সেগুলোর বিকাশ না হওয়া বা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং তৃতীয়ত গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বহীনতা। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হলে হবে না, রাষ্ট্রের জনগণকেও গণতান্ত্রিক হতে হবে। ড. আম্বেদকর বলেছেন- ‘একটি সমাজকে গণতান্ত্রিক হতে হলে ব্যক্তির সমস্ত সামর্থ্য ব্যবহার করার পথ খোলা রাখা উচিত।’ শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক গুণাবলী অর্জনের সাথে সাথে জনগণকেও গণতান্ত্রিক হওয়ার সেই গুণবাচক বিশেষ্যের অধিকারী হওয়া জরুরী। ব্যক্তি গণতান্ত্রিক হলে তার পরিবার গণতান্ত্রিক হয়, পরিবার গণতান্ত্রিক হলে সমাজ গণতান্ত্রিক হয় আর সমাজ গণতান্ত্রিক হলে রাষ্ট্রও স্বয়ংক্রিয়ভাবে গণতান্ত্রিক হতে বাধ্য। তাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রথমে ব্যক্তি থেকে উৎসারিত হওয়া দরকার। প্লেটোর মত হলো- ‘মানুষ যেমন হবে রাষ্ট্রও তেমনিই হবে। মানুষের চরিত্র দ্বারাই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।’ তাই ব্যক্তির সুশীলতা অর্থাৎ নৈতিকতা, সততা ও সচ্চরিত্রতাই সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সকল কার্যক্রমে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠাকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাষ্ট্রের সবাইকে সদয়, জ্ঞানী ও সঠিক মনের অধিকারী হতে হবে। নাগরিকগণ যতই বিশুদ্ধ জীবন যাপন করবে; ততই জীবনকে উপভোগ করতে পারবে। একজন শুদ্ধ, সংযত, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ নাগরিকের দ্বারাই আত্ম-কল্যাণ ও পরকল্যাণ সম্ভবপর হয়। অর্থাৎ একজন নৈতিকতাসম্পন্ন, গুণী, মেধাবী ও সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিকে ঋদ্ধ করতে পারে।
একজন লোক নৈতিকভাবে, আত্মিকভাবে যতবেশী শুদ্ধ হবে তার মধ্যে ততবেশি ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা আর পরকল্যাণের মানসিকতা বৃদ্ধি পাবে, যা সমাজ আর রাষ্ট্রের দুঃখ দুর্দশা লাঘব করে সুখি সুন্দর জনকল্যাণময় সমৃদ্ধ এক সমাজ ব্যবস্থার উম্মেষ ঘটাবে। কারণ ব্যক্তি থেকে পরিবারে, পরিবার থেকে সমাজে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রে এর চর্চা ও অনুশীলন ব্যাপকতা লাভ করবে এবং একটি জনকল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে; আর প্রতিষ্ঠিত হবে সেবাবান্ধব কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক ধারাকে বলবৎ করতে প্রয়োজন ব্যক্তির মধ্যে সদগুণাবলীর সমন্বয় ঘটানো। আর শাসককে চর্চা করতে হবে উদারতা ও পরার্থপরতার; তাঁকে হতে হবে নৈতিক চারিত্রিকগুণসম্পন্ন; জনগণের হিত-সুখ-মঙ্গল প্রতিবিধানের জন্য আত্মসুখ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে সর্বদা; হতে হবে দয়ালু ও বিনয়ী; তাঁর জীবনযাপন হবে সাধারণ; তিনি হবেন সকল প্রকার রাগ-ঘৃণা এবং পক্ষপাত মুক্ত; তিনি অহিংসা, সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার অনুশীলন করবেন এবং শান্তি ও ঐক্যকে সুসংহত করার লক্ষ্যে জনমতকে শ্রদ্ধা করবেন। মোটকথা, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী কার্যকর ও টেকসই করার জন্য সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে দেশের রাজনীতিবিদ ও মানুষের মনের (গণতন্ত্রের চর্চা ও ধারণ করবার মনস্তাত্তি¡ক বিষয়ের) উন্নতিসাধন, নৈতিক শিক্ষার (পরমতসহিষ্ণুতা, সততা, সহাবস্থান, ন্যায়বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী) বিকাশ ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গিকার ও দায়বদ্ধতা।
তাছাড়া গণতন্ত্রকে ধারণ করার জন্য যে ধরণের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণের সক্ষমতা, অন্তর্দৃষ্টি, নিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, প্রগাঢ় দেশপ্রেম, উদার ও নৈতিক শিক্ষার দরকার তার বিকাশ ও সংযোজন জরুরী। অন্যথায় গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রে পর্যবর্সিত হতে বাধ্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট