গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের গতিপথ

1

জসিম উদ্দিন মনছুরি

মানুষের আজন্ম স্বপ্ন স্বাধীনভাবে কথা বলা ও মুক্তভাবে চলাফেরার বাসনা। আকাশের পাখিটিও বন্দী খাঁচায় আবদ্ধ থাকতে চায় না। বন্দী পাখিকে পায়ে সোনার নূপুর পরিয়ে দিলেও প্রশান্তি অনুভব করে না। মানুষের জন্মই হয়েছে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কথা বলার জন্য। মানুষ দাসত্বের শৃঙ্খল পায়ে বদ্ধ থাকতে চায় না। পবিত্র কুরআনুল কারীমে মানুষকে মহান আল্লাহ প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো ধর্মই অন্যায়-অবিচার, জুলুম ও নির্যাতনকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়নি। জুলুমকারী শাসকের নাম খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথিবীর নিকৃষ্ট শাসক ফেরাউন, নমরুদ, চেঙ্গিস খান, হিটলার ও নেতানিয়াহুরা পৃথিবীর নিকৃষ্ট শাসক হিসেবে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন মতামত প্রকাশ ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার সব নাগরিকের সমানভাবে বিদ্যমান থাকে। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। মানুষকে সর্বপ্রথম বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভাজন করেছেন প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে। তিনি সেখানে মানুষকে চারটি ভাগে বিভাজন করেছে।
১. শাসকশ্রেণি ২. যোদ্ধাশ্রেণি ৩. ব্যবসায়ীশ্রেণি ৩. কৃষকশ্রেণি।
পরবর্তীতে রাজা বল্লাল সেন প্লেটোর আদলে মানুষকে চারটি শ্রেণীতে বিভাজন করেছেন।
১. ব্রাহ্মণ বা ধর্মীয় পুরোহিত ২. ক্ষত্রিয় বা যুদ্ধাশ্রেণি ৩. বৈশ্য বা ব্যবসায়ীশ্রেণি ৪. শূদ্র বা নিম্নশ্রেণি।
এসব বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও দাসত্ব প্রথার উদ্ভব হয়। হাজার হাজার বছর ধরে দাসপ্রথা সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রচলন ছিলো। অথচ গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হচ্ছে সমতা ,সমআইন ও সমঅধিকার। যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন স্বৈরাচারী সরকার মানুষের কন্ঠরুদ্ধ করে বাক স্বাধীনতাকে হরণ করেছেন। শাসনের নামে জনগণকে শোষণ করা হয়েছে। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে রাখার জন্য স্বৈরাচাররা নিজেদেরকে রক্ষা করতে জনগণের উপর স্টিমরোলার চালিয়েছে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মহান রাব্বুল আলামীন মানুষকে দুটি কাজের জন্য প্রেরণ করেছেন বলে উল্লেখ করেন। প্রথমত মন্দ কাজ বা অন্যায়কে কঠোর ভাবে প্রতিহত করা। দ্বিতীয়তঃ সৎ বা মঙ্গল কাজের জন্য মানুষকে আদিষ্ট করা। প্রিয় রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহি হাদিসে জুলুম নির্যাতন ও মন্দ বা নিন্দনীয় কাজকে কঠোরভাবে প্রতিহত করার কথা বলেছেন। তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে তাকে নিভৃত করার জন্য বলা হয়েছে। যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলেই জুলুমবাজ নির্যাতনকারী স্বৈরাচারকে মনে মনে ঘৃণা করার কথা বলা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায়, কোন ধর্ম কখনো মানুষের অকল্যাণ চায় না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রতিটি মানুষই সমান ও সমান মর্যাদাবান। কিন্তু মানুষ নিজেদের স্বার্থে মানুষকে বিভিন্ন পেশা ও বিভাজনের মাধ্যমে কণ্ঠরুদ্ধ করে রেখেছে। কোন স্বৈরাশাসক পৃথিবীতে স্থায়ী হয়নি। কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশকে পরাধীন করে বেশি দিন রাখা যায়নি। জান্নাতাবাদ নামে খ্যাত বাংলাদেশের সম্পদে আকৃষ্ট হয়ে ভিনদেশিরা লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে দেশে বারবার হানা দিয়েছে। ফলে স্বাধীনতা সূর্য বার বার অস্থিমিতো হয়েছে। প্রাচীন বাংলার স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের পর থেকে বাংলাদেশ বারবার নিজের স্বাধীনতা হারিয়েছে। সর্বশেষ ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অধিভুক্ত হয়ে বাংলাদেশের মানুষ সুখের স্বপ্ন দেখেছিলো। কিন্তু তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। ফলে স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয়েছে যুগেযুগে। দূর্বার আন্দোলনে মাথা নত করেছে স্বৈরাচারী হানাদার বাহিনী। ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। সর্বশেষ স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের পতন হলে মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। জালিম সরকার দীর্ঘদিন লুণ্ঠন কার্য চালিয়ে মানুষের বাকস্বাধীনতা কে হরণ করে জুলুম নির্যাতনের কারাগারে নিক্ষিপ্ত করেছিলো দেশের জনগণকে। নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়ীকরণের লক্ষ্যে তারা সীমাহীন জুলুম, নির্যাতন, খুন-গুম করে মানুষকে কণ্ঠরুদ্ধ করে রাখে। ২০২৪ সালে জুলাই বিপ্লবের পর দেশের জনগণ আশার আলো দেখতে শুরু করেছিলো। মানুষের বাকস্বাধীনতা ফিরে এসেছে এটা ঠিকই। ভঙ্গুর দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে শুরু করে। দীর্ঘদিন লুন্ঠনের পর দেশ যে এভাবে ফিরে আসবে সহজে তা বলা যায় না। এতদ্বসত্বেও স্বৈরাচারীরা এখনো বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। শান্তি-শৃঙ্খলা ও বাকস্বাধীনতা ফিরে আসায় তাদের জন্য চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচারীরা বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে রাজপথে আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে। কখনো রিকশা আন্দোলন, আনসার আন্দোলন, পুলিশ আন্দোলন, ঋণ আন্দোলন ও সাম্প্রতিক সময়ে ইসকনের নৈরাজ্য। চিন্ময় দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে নিশংসভাবে হত্যা উল্লেখযোগ্য। তারা আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে সচেষ্ট রয়েছে। দেশের জনগণ চায় না ইতিহাসের নিকৃষ্ট স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের মতো আরেকটি সরকার আসুক। মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ হোক কিংবা স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার হারিয়ে ফেলুক। বিভিন্ন কমিশন গঠিত হওয়ায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও স্বৈরাচারীরা মিলে বিভিন্নভাবে দেশকে অরাজকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ জনগণ স্বৈরাতন্ত্রকে বয়কট করেছে। এতদ্বসত্বেও নির্লজ্জ স্বৈরাচারীরা মানুষের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট করার জন্য আদা জল খেয়ে লেগে আছে। অথচ শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসার জন্য ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান ও আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলন তখনই সাফল ও সার্থক হবে যদি দেশের মানুষ শান্তি-শৃঙ্খলা এবং স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার কিংবা স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার ফিরে পায়। আশা করি অন্তর্বতীকালীন সরকার মানুষের জন্য কাজ করে দেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধশালী উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করবে। দেশের মানুষ আর কখনো কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে শিকল পায়ে আবদ্ধ থাকতে চায় না। দেশের অধিকাংশ জনগণের প্রত্যাশা ও দাবি হচ্ছে দ্রুততম সময়ে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। যদি তারা কঠোরভাবে স্বৈরাচারকে মোকাবেলা করতে না পারে তাহলে দেশ আবার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। এখনই সময় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিকারী স্বৈরাচারীদেরকে কঠোর হস্তে দমন করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।
লেখক : প্রাবন্ধিক