গড়ে তুলি শিল্প সংস্কৃতি ঋদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ

1

বাবুল কান্তি দাশ

শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মানুষ পরিশীলিত হয়। সৃজন মননে এর প্রভাব বিস্তর। কারণ সংস্কৃতি হলো সমাজের জীবনধারা। আর এই জীবনধারা আবর্তিত হয় – ভাষা, কলা, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আইন, দর্শন, রাষ্ট্র, নৈতিকতা, ধর্ম, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, মূল্যবোধ, প্রথা, প্রতিষ্ঠান এবং অনুষ্ঠানের মধ্যে। এ সকলের মাধ্যমেই সমাজে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলে। সংস্কৃতি চর্চা এবং বিকাশে আমাদের যত্নবান হওয়া আবশ্যক। সংস্কৃতি শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম। উন্নত জীবন সম্বন্ধে, চেতনা-সৌন্দর্য্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে বোধের উন্নত বিকাশ। এই বোধায়নে মানব মনের যে সূ² অনুভূতি অর্থাৎ আত্মার বিকাশ ও উর্ধ্বায়ন ঘটিয়ে তদনুগ চলনায় সচেষ্ট থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে সমর্পিত হওয়া সংস্কৃতির লক্ষ্য।নিজ নিজ কৃষ্টি, ঐতিহ্য এবং ভাবধারায় অটুট থেকে তা যথাযথ পরিপালন, পরিপোষণ। নিজত্ব হারিয়ে কাউকে খুশি করতে গেলে দুর্গতি পোহাতে হয়। সন্মুখীন হতে হয় বিপর্যয়-বিধ্বস্তির। সেই স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য অবলোকন করা সংস্কৃতির কাজ।সৌন্দর্য্যবোধের উন্মোচন, প্রতিভার বিচ্ছুরণ, নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা প্রদর্শন সংস্কৃতিবান লোকের বৈশিষ্ট্য। সত্যকে ভালোবাসা, সৌন্দর্য্যকে ভালোবাসা, ভালোবাসাকে ভালোবাসা, নিজের ক্ষতি স্বীকার করে ভালোবেসে যাওয়াই হচ্ছে সংস্কৃতি। আত্মার শুদ্ধতা, পরিপুষ্টিলাভ বিকাশ ও বিস্তার শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চায় সম্ভব। এর মাধ্যমে আসে মানবজীবনের পরিপূর্ণতা। সমাজ ও রাষ্ট্রে বজায় থাকে শান্তি শৃংখলা। সাংস্কৃতিক কর্মীরাই এগিয়ে আসে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংকটে। অন্যায়-অবিচার প্রতিরোধে। আন্দোলন সংগ্রামে নিজেদের সম্পৃক্ত করে তা’কে বেগবান করে কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে। সংস্কৃতির লালন, সাংস্কৃতিক কর্মীদের পরিপালনে রাষ্ট্রের আরো মনোযোগী হওয়া অত্যাবশ্যক। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ তৈরী এবং তার প্রচার প্রসারে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দায়িত্ব নিতে হবে আন্তরিকতায়। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার পথ রুদ্ধ হলে তা’র জায়গা দখল করবে অপসংস্কৃতি। দেখা দেয় চেতনার পচন। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিনষ্টি। অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় পতন। পচন থেকে রক্ষা পেতে হলে মানুষের বিকাশকে বড় করে দেখতে হবে। প্রয়োজন শুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি। সংস্কৃতির উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের বিকাশ ঘটিয়ে পতন থেকে রক্ষা করা। সংস্কৃতির বিকাশ এবং অধিকতর ক্রিয়াশীল করে তুলতে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্র পরিচালনায় যাঁরা নিয়োজিত তাঁদের। দায়িত্ব পালন করতে হবে দায়িত্ব নিয়ে। এক্ষেত্রে শিথীলতা কাম্য নয়। সামাজিক স্তরবিন্যাসে যাঁরা উঁচুস্তরে সমাসীন তাঁরাই সাংস্কৃতিক কার্য্যক্রমকে অধিকতর ক্রিয়াশীল করে তুলতে পারে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধে তাঁদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। যে সংস্কৃতি আমার কৃষ্টি, ঐতিহ্য রক্ষায় মনোযোগী নয় বা যার চর্চায় নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়, আধুনিকতার নামে উচ্ছৃংখলতা পরিদৃষ্ট হয় তা সর্ব্বৈ বর্জনে আরো বেশী যতœশীল এবং আন্তরিক হওয়া জরুরী। এই যে আমাদের নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম আছে, আমরা কি তাদের কথা ভাবি? তারা ভবিষ্যতের হাল ধরবে, তাদের সেভাবেই তৈরি করতে হবে আমাদের। প্রত্যেক মা-বাবা কি তাঁদের সন্তানের খোঁজখবর রাখেন? সন্তানকে কিভাবে আদর্শ ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে কি ভাবেন? আমরা শুধু টাকার পেছনে দৌড়াই, এর জন্য আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি! কিন্তু একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে, রাষ্ট্রের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে আমরা কি দায়িত্ব পালন করছি? সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে! আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যে অবনমন তা পরিদৃষ্ট হয় সর্বক্ষেত্রে। খাবার, ওষুধ, শিক্ষাসহ সব কিছুতেই ভেজাল, দুর্নীতি এখন আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই ভেজাল ও দুর্নীতির হাত থেকে আমাদের বের হওয়ার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে কাজ করা এবং মানুষকে সংস্কৃতিবান হিসেবে গড়ে তোলা। নৈতিকতার শিক্ষা ও প্রকৃত সংস্কৃতিচর্চায় আমাদের মনোযোগী হতে হবে। আমাদের সমাজে মেধা ও মেধাবীর সংখ্যা দিন দিন কি হ্রাস পাচ্ছে? সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, এর জন্য আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের প্রয়োজন মেধার বিকাশ ও নতুন নতুন চিন্তার উন্মেষ, তার বিকাশ ও প্রসার ঘটানো। আমাদের প্রয়োজন আদর্শনিষ্ঠ ও সর্বজনীন সংস্কৃতিচর্চার। আমাদের উত্তরণের পথ দেখাতে পারে প্রকৃত সংস্কৃতিচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, যা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় দূর করে জাতিকে নতুন যুগের পথ দেখাতে পারে। অ্যারিস্টটলের কথায় আসি। তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘মানুষ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী, যখন সে আইন ও বিচার ক্ষমতাসম্পন্ন থাকে তখন সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব, আর যখন সে আইন ও বিচার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন সে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম প্রাণী।’ নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের দিক থেকে আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। চলুন, আমরা আবার সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়াই, নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ও প্রকৃত সংস্কৃতিচর্চায় মনোনিবেশ করি। আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে, নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় রোধ করে আমাদের মূল্যবোধ জাগিয়ে বাংলাদেশকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। আজকের সময়ে মানবিক মূল্যবোধ সমৃদ্ধ মান-হুঁশ এর বড্ড আকাল। সমাজ রাষ্ট্রে মানুষ গিজগিজ করছে অথচ মান-হুঁশ কই ? যার জন্য প্রতিনিয়ত ভুগতে হচ্ছে অজানা এক আশংকায়। চারদিকে অস্থির অস্থিতিশীল এক পরিবেশ। সমাজ ও রাষ্ট্রে এতো মানুষ থাকা সত্ত্বেও আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায় – এমন একটা মানুষ খুঁজে পেলাম না, যার মন আছে…’ গানের এই কলিটা অজান্তে কত মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে বলেই না বাংলা গানের জগতের একটি জনপ্রিয় গান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবুও কেন জানি গানটির স্রষ্টা একটা মনওয়ালা মানুষ খুঁজে পায়নি বলে সুরে সুরে আক্ষেপ করেছে। মন আছে বলেই তো মানুষ। মন নেই, তা’ কি করে হয় ! পশুদের তো আর মন হয় না। তবুও তো কত কুকুর-বিড়াল মানুষের মনের মণিকোঠায় আসন পেতে নেয়। যে মানুষ, আর একটা মানুষের মন বুঝে তাকে প্রিয়জনের আসনে বসাতে পারে না, সেই মানুষটাই হয়তো একটা কুকুরকে কোলে করে ঘুরে বেড়ায়, সাথে নিয়ে ঘুমোয়, তাই না ! আসল ব্যাপারটা বোধহয় তা’ নয়। আমি যখন সবার মন জয় করে চলার চেষ্টা করছি, তখন আমার মনের মণিকোঠা যারা ছুঁতে চাইছে না, বা আমার মনের মণিকোঠাকে ছুঁতে পারছে না, এমনটা যখন হয় তখনই ‘একটা মনের মানুষ পেলাম না’ বলে আক্ষেপ হতেই পারে। আর এই মনের মতো মানুষ অর্থাৎ যার মান এবং হুঁশ রয়েছে তেমন মানুষ যদি না থাকে বা সৃষ্টি না হয় তাহলে সমাজ ব্যর্থ হয়।
ব্যর্থ সমাজের প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে- রাশিয়ান লেখক আন্তন চেখভ বলেন- ব্যর্থ সমাজে মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে জেগে ওঠে না। সে জেগে ওঠে শ্লোগানে। এখানে- পাঠাগার কম থাকে। জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হয় না। মানুষ মুক্ত বুদ্ধির চর্চা করতে পারে না, যুক্তির ধার ধারে না। পর মত সহিষ্ণু হয়ে উঠে না। ব্যর্থ সমাজে প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের বিপরীতে হাজার হাজার বোকা থাকে এবং প্রতিটি সচেতন শব্দের বিপরীতে থাকে হাজার হাজার পচনশীল শব্দ। তারা সমস্যার উপরে ভেসে বেড়ায়, গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। চিন্তাশীল মানুষের মূল্য বা ওজন কেউ বুঝে না। অধিকাংশ মানুষ আজেবাজে কথায় সময় পার করে দেয়। আজে বাজে কথা বলে যে মানুষকে হাসায়, তার চেয়ে কঠিন সত্য বলে যে বাস্তবতাকে জাগিয়ে তোলে তাকে কেউ গ্রহণ করে না।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হয় সর্বদা নির্বোধ। সমাজের অতি তুচ্ছ বিষয়গুলি নিয়ে মানুষ আলোচনায় মেতে থাকে। মূল বিষয়গুলো হারিয়ে যায়। সমস্যা সমাধানের চেয়ে একে অন্যের উপর প্রতিনিয়ত দোষ চাপাতে থাকে। অর্থহীন গান ও সস্তা বিনোদনের পিছনে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে। ফলে, সস্তা বিনোদন করেও মানুষ প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এবং এইসব গান, বাদ্য বাজনার মানুষগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক নেতাদের দেবতার মতো করে পূজা-অর্চনা করা হয়। আর এক দলের দেবতাকে অন্য দল সহ্য করতে পারে না। যে কোনো একটা খেলা দিয়ে মানুষকে দিনের পর দিন নেশাগ্রস্থ করে রাখা হয়।
অজ্ঞ সংখ্যাগরিষ্ঠরা এখানে আপনার ভাগ্য নির্ধারণ করে। সবার যেমন একটি করে পশ্চাতদেশ থাকে। ঠিক তেমনি ব্যর্থ সমাজে যে কোনো বিষয়ের উপর সবার একটি করে মতামতও থাকে। ব্যর্থ সমাজে মানুষ ব্যর্থ হয় না, এখানে সুচতুরভাবে তাকে ব্যর্থ বানানো হয়। প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক, বক্তা এবং শিক্ষাবিদ স্যার কেন রবিনসন তার সাড়া জাগানো ‘Out of Our Minds-(2011) গ্রন্থে বলেছেন, ‘The more complex the world becomes, the more creative we need to be to meet its challenges’ অর্থাৎ পৃথিবী যতই জটিল হয় তার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য আমাদের ততই সৃষ্টিশীল হওয়া দরকার। বর্তমান বিশ্বের শিক্ষাঙ্গনে এবং কর্মক্ষেত্রে রবিনসনের এই তত্ত¡ বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। মানুষের এখন সফল হতে হলে সৃষ্টিশীল হতেই হয়। কিন্তু সাফল্যের ধারণা যেহেতু পরিবর্তনশীল তাই শিক্ষা পদ্ধতিকেও বারবার পরিবর্তিত অর্থাৎ যুগপযোগী হতে হয়। বিশ শতকের শিক্ষাব্যবস্থায় অবশ্য সৃষ্টিশীলতার চাইতে সম্মতি (Compliance) এবং ‘সংগতি’ (Comformity)-এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। একটা পেশাদার করপোরেট পরিবেশে যুগ যুগ ধরে ভালো চাকরির নিশ্চয়তার জন্য বিশ্বস্ত গুণাবলি হিসেবে কাজ করেছে এই সম্মতি এবং সংগতি। কিন্তু দ্রুততম পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে তথ্য ও যোগাযোগ-প্রযুক্তির অভাবিত উন্নয়নের যুগে এবং প্যানডেমিকের মতো বৈশ্বিক বিপর্যয়ের চরম অনিশ্চয়তার যুগে জীবন ও জগতকে টিকিয়ে রাখতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার। আমরা এক নজিরবিহীন প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যুগে বাস করছি। আমাদের হাতে রয়েছে এক বিশাল বিস্ময়কর তথ্যবিশ্বের চাবি। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ প্রায় ৫ বিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহার করে। প্রায় ৪ বিলিয়ন গুগল সার্চ হয় প্রতি মিনিটে। প্রতি দুই দিনে আমরা এত তথ্য সৃষ্টি করি, যা সভ্যতার শুরু থেকে ২০০৩ পর্যন্ত সৃষ্ট তথ্যরাশির সমান অর্থাৎ ৫ এক্সাবাইট। বিশ্ব তথ্যভান্ডারের ৯০ শতাংশ সৃষ্টি হয়েছে মাত্র গত দুই বছরে। এই দ্রুততমভাবে বর্ধনশীল সংযোগ নজিরবিহীন প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণ ক্ষমতা, সীমাহীন তথ্য প্রবেশাধিকার। যে কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা প্রযুক্তির উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় তাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের পন্থা উদ্ভাবন। মানুষের মনে হিংসা ও হিংস্রতার ন্যক্কারজনক প্রদর্শন প্রকট হয়ে ওঠে: কখনও ধর্ম, কখনও জাতীয়তাবাদ বা রাজনীতির নামে। মনে হয়, মানুষ নামের প্রজাতিটি সম্ভবত গুরুমস্তিষ্কের এমন এক বিবর্তনের পথে চলেছে, যেখানে রিপুর প্রাবল্য মহতী আবেগকে নিষ্ক্রিয় করে হিংস্রতার পথে ধাবমান। প্রাগিতিহাস বলে, আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে মানুষ-পূর্ব মানব-প্রজাতি নিয়েনডারথালের অন্তর্ধানের জন্য অন্যতম দায়ী মানুষই। অপেক্ষাকৃত উন্নত মস্তিষ্ক ও বুদ্ধির বলে মানুষ নিয়েনডারথালের সঙ্গে সহ-বাস করেও শুধু নিজের প্রতিদ্ব›দ্বী রাখবে না বলে তাদের শেষ করে দিল। সেই হিংস্রতার বীজ বাহিত হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে, যখনই যেখানে সুযোগ পেয়েছে বিপরীত মনের স্ব-প্রজাতিকে হত্যা করতে তার এতটুকু সঙ্কোচ হয়নি। শুধু যে অস্ত্রবলে সে শক্তিমান হয়ে উঠেছে তা নয়, খাদ্য ও জলের মতো দৈনন্দিন আবশ্যক প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃত অভাব তৈরি করে, মানুষকে না খাইয়ে অপুষ্টির শিকার বানিয়েছে, মেরেছে পরোক্ষ ভাবে। আধুনিক সভ্যতার শুরু সংগঠিত কৃষি দিয়ে। পৃথিবীর এই মাটিতে উৎপাদিত সব শস্যতেই সবার সমান অধিকার, এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তাচ্ছিল্য করে বিপুল সংখ্যক মানুষকে ভুখা মেরেছে অন্য এক দল শক্তিশালী মানুষ। এক-একটা দেশ-মহাদেশের আদি অধিবাসীদের আধুনিক অস্ত্র ও দুর্বুদ্ধিতে পরাস্ত করে, জঙ্গলে নির্বাসিত করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। এতেই ক্ষান্ত না হয়ে জঙ্গলের জমির নীচে খনিজ পদার্থ ও জ্বালানি তেল সংগ্রহের জন্য তাদের সেখান থেকেও উচ্ছেদ করেছে, করে চলেছে এখনও। নিজভূমে পরবাসী হয়ে বাঁচছে জনজাতিরা। মার্টিন স্করসেসে-র কিলার্স অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন ছবিতে আমেরিকার ওকলাহোমায় ওসেজ জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় খনিজ তেল আবিষ্কারের পর শক্তিশালী শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের হাতে নিরীহ ওসেজদের হত্যাকাহিনি এমনই এক খন্ডচিত্র। এ গল্প আজকের নয়, যখন থেকে ভূখন্ডের অধিকার মানুষ বুঝে নিতে শিখেছে, অন্যের ভূখন্ড ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে, তখন থেকেই। মহাকাব্য-পুরাণ সময়ের প্রতিচ্ছবি হলে বলতে হয়, সভ্যতার নামে বিশ্বে হত্যালীলা চলেছে সেই সময় থেকেই। অপশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমতকে দমিয়ে দিতে নির্বিচার অত্যাচার ও নিধন চলেছে। আঠারো শতকে ফ্রান্সে জনজাগরণ ও বিপ্লব বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তার পর এসেছিল যন্ত্রশিল্পের প্রসার। যন্ত্র সভ্যতাকে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেলেও, ক্রমে খসে গেছে মানবতার প্রলেপ। অনৈতিক প্রতিযোগিতা মানুষকে প্রলুব্ধ করেছে, নির্মমও। একদা মধ্য এশিয়ায় প্রথম ঘোড়া বশ করে মানুষ পেয়েছিল গতি, ম্যাসিডোনিয়ার শাসকেরা যুদ্ধে তার ব্যবহার করেছিল। উনিশ-বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে বিমান আবিষ্কারে আরও গতিবৃদ্ধি হয়েছে। দু’টি বিশ্বযুদ্ধে তার ব্যবহার লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়েছে। মানুষকে লক্ষ্য করে বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র-সহ মানুষ মারার সরঞ্জাম দেশে দেশে মজুত কিংবা উৎপন্ন হয়েই চলেছে। অস্ত্রভান্ডারের হিসাব এখন বড় দেশগুলোর শ্লাঘার বিষয়। দেশ দখলের যুদ্ধ এখনও হয়, আর অন্য দেশের খনিজ সম্পদ ও তেল দখলে এনে বাণিজ্য বৃদ্ধির যুদ্ধও ছড়িয়ে গেছে মানচিত্রময়। আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ দখলের জন্য গত শতকে আমেরিকা ও রাশিয়ার দড়ি টানাটানি চলেছে, বিস্তর আফগান জনজীবনের মূল্যে। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার তেলের দখল নিতে যুদ্ধ হয়ে চলেছে হামেশাই, অন্য কারণ দেখিয়ে। সাম্প্রতিক কালে রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যই সাধারণ মানুষ, নারী, শিশু। রাষ্ট্রপুঞ্জও অনেক সময়ই নীরব সাক্ষী, কার কাছে মানুষ বিচার চাইবে! রবীন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যে সেই মহামানবকে দেখেছিলেন, যার চৈতন্য আলোকের মতো মহাবিকিরণের দিকে চলেছে— জ্ঞানে কর্মে ভাবে। সেই প্রসারণেই তার মহত্ত¡। কিন্তু আজকের মানুষ চলেছে কোথায়! তথ্যসর্বস্ব জ্ঞান যত বাড়ছে, মন বিকশিত না হয়ে আত্মমগ্ন হচ্ছে, স্বার্থসর্বস্ব ব্যক্তিত্ব তৈরি হচ্ছে। মানুষের চাহিদার শেষ নেই, অবশ্যই তা এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। কিন্তু ক্ষুদ্র আরামের মধ্যে জড়ত্বপ্রাপ্ত হয় বিবেক, মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়। মানুষ আজ ক্ষমতাবান স্বেচ্ছাচারী সহ-মানুষের শিকার, নির্দ্বিধায় হত্যায়ও যারা বিচলিত হয় না। মানবিক বোধের এই ক্রমবিলুপ্তই কি ভবিতব্য? আজ সারা বিশ্ব অস্থির এক সময় পার করছে। প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার পদদলিত হচ্ছে মানবতা। ভোগ আর ভাগের উলঙ্গ নৃত্যে বিশ্ব প্রকম্পিত। শান্তি স্বস্তি উধাও। সৃজন মনন কলুষিত। মনুষ্য মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত। সততা নির্বাসনে। এ যেন অচেনা এক বিশ্ব। প্রজন্ম কেমন জানি বেপরোয়া। মানুষ ক্রমশ নীতি নৈতিকতা সততায় দূর্বল হয়ে পড়ছে। শিক্ষা ও ধর্ম ব্যর্থ হচ্ছে তাদের বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে রাখতে। আজকে যে সততা পরিদৃষ্ট হচ্ছে তা কেবলমাত্র ঐহিক কিংবা পারত্রিক শান্তিভীতিজাত। যার নৈতিক সামাজিক ও চারিত্রিক মূল্য সামান্য। সততা যদি হয় আত্মপ্রত্যয় আত্মসম্মান ও সংযম রুচি বুদ্ধি বিবেক বিবেচনা প্রসূত তাহলে তার মূল্য মর্যাদা অনেক। এখন প্রয়োজন সততা যুক্ত সংস্কৃতিবান মানুষের।
সংস্কৃতিবান মানুষ সাধারণত শিক্ষিত মার্জিত। মানবাধিকার লঙ্ঘন বা মানবতার বিপর্যয়ে এঁরা প্রচন্ড শক্তিতে জেগে উঠে তার প্রতিকার ও প্রতিরোধে। তারা ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে। এমনকি অন্যায় নিষ্ঠুরতা তো বটে, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও এঁরা ঘৃণা করে। এঁরা প্রতিনিয়ত সক্রিয় থাকেন নিজের মধ্যে যে আমি রয়েছে তাকে সুন্দর করে তোলায়। যার প্রেক্ষিতে এরা সমাজ প্রগতির প্রতিভূ হয়ে উঠেন। সমাজ রাষ্ট্রে এমনতরো লোকের সংখ্যা যত বাড়বে দেশ হবে ততবেশী সুস্থির এবং উন্নত ও সমৃদ্ধ। প্রজন্ম সহ সকলের মধ্যে এমন চেতনার চৈতন্য ঘটুক এই প্রত্যাশা। যার প্রেক্ষিতে গড়ে উঠবে মানবিক বিশ্ব। বিশ্বগ্রাম হয়ে উঠবে শান্তি স্বস্তির আকর ভূমি।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক