রেজা মুজাম্মেল
একটা মৃত্যু মানে কি কেবলই একটি মরদেহ? একটি সংখ্যা, একটি পরিসংখ্যান, একটি দুর্ঘটনা? না, তা মোটেও নয়। একটি মৃত্যুর সঙ্গে অনেক কিছুই জড়িত। কত আবেগ, কত ভালোবাসা, কত অনুভূতি, কত স্মৃতি, সুখ-দুঃখ জড়িত। কিন্তু আমাদের এই নগরে দুর্ঘটনায় মৃত্যু অনেক বেশি একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা হত্যাকান্ডের মত নির্মম ঘটনা তো আছেই, এখন বড় দুর্বিষহ ঘটনা হয়ে ক্রমেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে খাল, নালা-নর্দমায় পড়ে মৃত্যু ও নিখোঁজের মত অস্বাভাবিক ঘটনা। একুশ শতকে বিজ্ঞান এবং উন্নয়নের চরম উৎকর্ষের এই সময়েও যদি খাল-নালায় পড়ে মানুষের মৃত্যু হয়, তাহলে এটাকে কী বলা যায়, নির্মম, হৃদয়বিদারক, লোমহর্ষক, দুর্বিষহ? নাকি কর্তৃপক্ষের অবহেলা, দায়বদ্ধতাহীনতা ও উপেক্ষার কারণে মৃত্যুর মত দুঃখজনক অনুষঙ্গের আয়োজন করে রাখা। এটা কি একটি সভ্য নগরের বৈশিষ্ট্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। গত ছয়টি বছরে শিশু-নারীসহ ১৪টি প্রাণের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কেন। এভাবে আর কত। আর কত মরদেহ দেখতে হবে এই নগরকে। সমস্যা-সংকট উত্তরণে আর কত লাশ চায়। লাশের সারি আর কত দীর্ঘতর হলে কর্তৃপক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। কখন ভাঙবে কুম্ভকর্ণের ঘুম। একটা মৃত্যু হলেই সেবা সংস্থাগুলো টনক নড়ার এই ঘৃণ্য প্রবণতা কখন শেষ হবে। চট্টগ্রাম নগরের খাল-নালাগুলো সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ এবং তত্ত¡াবধানের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)। বর্তমানে নগরে খাল-নালা আছে ১ হাজার ১৩৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে নিরাপত্তাবেষ্টনী ছাড়াই খালের পাড় আছে প্রায় ১৯ কিলোমিটার। উন্মুক্ত নালা রয়েছে ৫ হাজার ৫২৭টি স্থানে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ নালাতেও নিরাপত্তাবেষ্টনীর কাজ হয়নি। নগরে খাল আছে ৫৭টি। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অধীন সংস্কার করা হচ্ছে ৩৬টি। বাকি ২১টি খাল দীর্ঘদিন অবহেলিত হয়ে পড়ে ছিল। এখন চসিক খালগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।
দুই.
গত ছয় বছরে নগরের খাল-নালায় পড়ে অন্তত ১৪ জন মানুষ মারা যান এবং নিখোঁজ হন। গত ১৮ এপ্রিল কাপাসগোলা এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছয় মাস বয়সী এক শিশু, শিশুর মা ও দাদী। পরদিন চাক্তাই খালের চামড়া গুদাম অংশে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০২৪ সালের জুনে গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় সাত বছরের শিশু সাইদুল ইসলাম নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়, পরদিন নাছির খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ১১ জুন চাক্তাই খালে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হয় দুইশিশু। পরদিন চাক্তাই খালে একটি মরদেহ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ৯ এপ্রিল সদরঘাট নালাপাড়া এলাকায় অরক্ষিত ড্রেনে পড়ে ৩ বছরের শিশু ওজাইফা মারা যায়। তাছাড়া, ২৭ মে আছাদগঞ্জ শুটকি পল্লী এলাকায় কলাবাগিচা খালে পড়ে মারা যান আজিজুল হাকিম (৩০) নামের এক যুবক। ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর নগরের সিডিএ আবাসিক এলাকার খালে নেমে নিখোঁজ হয় আবদুল্লাহ (৫)। একদিন পর তার মরদেহ পাওয়া যায়। ওই বছরের ৭ আগস্ট ১নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেহপুর ইসলামিয়া হাটসংলগ্ন বাদামতলা এলাকায় বৃষ্টির মধ্যে নালায় পড়ে মৃত্যু হয় কলেজছাত্রী নিপা পালিতের (২০)। একই বছরের ২৭ আগস্ট আগ্রাবাদের রঙ্গিপাড়ায় ইয়াছিন আরাফাত নামের দেড় বছর বয়সী এক শিশু নিখোঁজ হয়। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল কালুরঘাট এলাকার ওসমানিয়া খাল থেকে এক নারীকে উদ্ধার করে। ২০২১ সালের ৩০ জুন ষোলশহর চশমা পাহাড় এলাকায় একটি অটোরিকশা খালে পড়ে নিখোঁজ হয় তিনজন। পরে চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগমের (৬৫) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে পানির তীব্র স্রোতে নালায় পিছলে পড়ে ডুবে যান সালেহ আহমেদ (৫০) নামে এক সবজি ব্যবসায়ী। পরে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরীর আগ্রাবাদ মোড়ে ড্রেনে পড়ে শেহেরিন মাহমুদ সাদিয়া (১৯) নামে আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের এক শিক্ষার্থী মারা যান। একই বছর ৭ ডিসেম্বর ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকার খালে পড়ে নিখোঁজ হয় কামাল উদ্দিন (১০) নামের এক শিশু। তিনদিন পর তার মরদেহ উদ্ধার করা হয় আরেকটি খাল থেকে। ২০১৮ সালের ৯ জুন নগরীর আমিন জুট মিল এলাকায় আল আমিন নামে এক শিশু ড্রেনে পড়ে যায়। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই হাটহাজারীর মির্জাপুর এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শীলব্রত বড়ুয়া নগরের এমএম আলী সড়কের পাশের বড় নালায় পড়ে নিখোঁজ হন। পরে বাকলিয়া এলাকা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় বৃষ্টির পানিতে নালা-সড়ক একাকার হয়ে যায়। অরক্ষিত খাল-নালায় পড়ে মৃত্যু হওয়া ১৪ জনের মধ্যে ৬ জনই শিশু। তাদের একজনের বয়স মাত্র ছয় মাস। নারী মারা গেছেন পাঁচজন, আর পুরুষ তিনজন। তাঁদের মধ্যে একজনের মরদেহ এখনো পাওয়া যায়নি। ১৪ জনের মধ্যে ৪ জনের মৃত্যু হয় চশমা খালে পড়ে, তিনজন মহেশ খালে পড়ে। চাক্তাই, কলাবাগিচা, নাসির খাল ও হিজড়া খালে একজন করে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনজনের মৃত্যু হয় নালায় পড়ে।
তিন.
প্রশ্ন হল, একই জাতীয় ঘটনার বার বার অবতারণা হচ্ছে কেন। কেন খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। অধিকন্তু, বার বার ঘটনা ঘটলেও কোনো ঘটনারই তদন্ত কমিটি হয় না। অথচ চসিক-সিডিএ চাইলে ঘটনার পরই প্রকৃত কারণ উদঘাটনে তদন্ত কমিটি গঠন করে কেন, কি কারণে, কাদের অবহেলায় এমন ঘটনা বার বার ঘটছে, তা চিহ্নিত করতে পারত। সঙ্গে
প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থাও নিতে পারত। কিন্তু কোনো ঘটনার পর মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে সিডিএ-চসিক কখনো তদন্ত কমিটি গঠন করে না। হয়তো তাদের কাছে প্রাণগুলোর কোনো মূল্য নেই। উল্টো চসিক-সিডিএ ঘটনায় দায় চাপাতে পরস্পরের মধ্যে দোষারোপের রাজনীতি চর্চা করতে দেখা গেছে অতীতে। দুই সংস্থা দোষারোপে ব্যস্ত থাকলেও নগরের অধিকাংশ খাল-নালার পাড়ও উন্মুক্ত। ঝুঁকি নিয়ে পথচারি ও যানবাহন চলাচল করছে। দায়িত্বশীল প্রধান দুই সংস্থা- চসিক ও সিডিএ অনেকটা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। একটি মৃত্যু-নিখোঁজের মত বড় দুর্ঘটনা ঘটার পরই টনক নড়ে। এরপর বাঁশ দিয়ে সাময়িক ঘেরাও দেয়া হয়। কিছুদিন পর সেগুলা আবার নষ্ট হয়ে যায়। এরপর আবারও সব উদ্যোগ-তৎপরতা হিমাগারে চলে যায়। দুর্ঘটনার পর বাঁশের ঘেরাও দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে সংস্থাটি। তবে এবার চসিক নগরে নিরাপত্তা বেষ্টনীহীন কতটি খাল-নালা আছে তার একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু করছে। কিন্তু এভাবে বাঁশের বেষ্টনী দিয়েই কি মৃত্যু ঠেকানো যায়। তাতে কি দায়িত্ব শেষ? প্রতি বছরই তো বর্ষা মৌসুমে উন্মুক্ত খাল-নালায় পড়ে মৃত্যু ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটছে। তাহলে স্থায়ী সমাধানে আসা হচ্ছে না কেন। পৃথিবীর কোনো সভ্য শহরে কি এমন নির্মম ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি হয়? অথচ বাস্তবতা হল- এই নগরে অন্তত গত ছয় বছর ধরে এমনটিই ঘটে আসছে। তাই নগরবাসীর প্রশ্ন- আর কত মৃত্যু হলেই কর্তৃপক্ষগুলোর টনক নড়বে। এবার একটু কার্যকর উদ্যোগ নিন। আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়। আর নয় কোনো আহাজারি। নিরাপদ হোক খাল-নালার পাড়। বাসযোগ্য হোক এই নগর।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী