শফি উল্লাহ
স্কুলের গন্ডি প্রায় শেষের দিকে, এসএসসি পাস করলেই কলেজে ভর্তি হয়ে যাবো। স্কুল আর কলেজ দুটিই বাড়ির কাছাকাছি। ফলে কলেজের বড়ভাইদের আনাগোনাও প্রতিদিন চোখে পড়ে, তাদের কথাবার্তা, চালচলনে মুগ্ধতা ছড়ায় শিশুমনে। যখন পারিপার্শ্বিক সবকিছু বুঝতে শুরু করেছি, রাজনীতি বলে যে একটা ব্যাপার আছে তা যখন বুঝতে পারছিলাম, সেই সময়েই প্রথম পাড়ার মুরুব্বীদের মুখে একজনের নাম শুনেছিলাম—‘প্রেসিডেন্ট জিয়া’। প্রেসিডেন্ট মানে দেশের প্রধান, সেটা তো বুঝতামই। শিশুমনে ভাসতো-তিনি দেশের সবার ওপরে, সবচেয়ে বড় মানুষ…এমনটিই। মুরুব্বীদের মুখেই প্রথম শুনেছিলাম ‘খালকাটা জিয়া’ শব্দটি, একটি ছবিও দেখেছিলাম কোথায়, প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজের হাতে কোদাল নিয়ে খাল কাটছেন শ্রমিকদের সাথে! ব্যাপারটি আমার কিছুতেই বুঝে আসছিল না যে, দেশের প্রেসিডেন্ট, সবচেয়ে বড় মানুষ যিনি; তিনি কেন শ্রমিকদের সাথে কাজ করবেন? এই কৌতূহলের মধ্যেই চলে এলো কলেজজীবন, সেখানে গিয়ে বড়দের কাছে উত্তর পেয়ে যাই।
যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে প্রেসিডেন্ট জিয়া খালকাটা কর্মসূচি গ্রহণ করেন, আর সেই কাজে শ্রমিকদের উৎসাহিত করতে, দলের কর্মীদের অনুপ্রেরণা দিতে নিজেই খালকাটার কাজে নেমেছেন, সেজন্য গ্রামের মানুষ তাকে সম্মান করে নামের সাথে যুক্ত করে অনেক এলাকায় খালকাটা জিয়া বলতেন।
এই তথ্য জেনেই, জিয়ার আদর্শের প্রেমে পড়ে যাই। কলেজে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। আমি অধ্যয়ন করেছি কক্সবাজার জেলার ঐতিহ্যবাহী চকরিয়া কলেজে (বর্তমানে সরকারি কলেজ)। কলেজে পড়ার সময়ই জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন, দেশপ্রেম এবং মানবতাবোধের অসাধারণ সব ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছিল। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একজন কর্মী হিসেবে রাজনীতি শুরু করে দ্রুতই চকরিয়া কলেজ শাখার সভাপতি নির্বাচিত হই। দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার পর জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে, দেশের মানুষের জন্য জিয়ার যে অবদান সেসব নিয়ে আরও বেশি অধ্যয়ন করেছি, যতই জেনেছি ততই মুগ্ধ হয়েছি, প্রেমে পড়েছি একজন সুদক্ষ রাষ্ট্রনায়কের। সেই যে জিয়ার আদর্শের প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেছিলাম সেখান থেকে ধাপে ধাপে চকরিয়া উপজেলায় যুবদলের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব পেয়েছিলাম, কক্সবাজার জেলা যুবদলের রাজনীতিরও অংশ হয়েছিলাম এবং পরে চকরিয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলাম…এই পথ বেয়ে আসার মূলমন্ত্র জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন, দেশপ্রেম এবং মানবকল্যাণ। আজ পর্যন্ত সেই আদর্শ লালন করে চলেছি, কেননা জীবনজুড়েই সেই রাষ্ট্রনায়ক অদৃশ্য এক ছায়া ফেলে দিয়েছেন।
আমাদের এই জাতির দুর্ভাগ্য যে, জিয়াউর রহমানের হাতে বাংলাদেশ পরিচালনার ভার বেশিদিন ছিল না। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তিনি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে শহীদ হয়েছেন। এই দিনটি আসলে তাই হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। চারদিকে যখন উন্নয়নের নামে লুটপাটের রাজত্ব চলেছে, যখন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে রাষ্ট্রীয় কোষাগার লুটের আয়োজন হয়েছে, তখনও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা ভেবে বারবার আশ্বর্য হয়েছি। কারণ, জিয়ার উন্নয়ন দর্শন ছিল একেবারেই ব্যতিক্রম। তার সেই চিন্তাভাবনাকে এই জাতির কাজে লাগানো গেলে, এই দেশটি অনেক আগেই উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছে যেত। জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ তার কয়েকটি দর্শন নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
এই অঞ্চলের ইতিহাসে অনেক রাষ্ট্রনায়ক এসেছেন, অনেকে গিয়েছেন। কেউ জনপ্রিয়তায়, কেউ উচ্চারণে, কেউবা প্রতীকে বেঁচে আছেন। তবে শহীদ জিয়াউর রহমানের নাম এলেই যে কথাটি অনিবার্যভাবে উঠে আসেÑতা হলো উন্নয়নকে ঘিরে তাঁর বাস্তববাদী, মাটি-কেন্দ্রিক, এবং আত্মনির্ভর রাষ্ট্রচিন্তা। তিনি শুধু কাগুজে পরিকল্পনায় নয়, নিজেই মাঠে নেমে, জনগণের মাঝে গিয়ে উন্নয়নের বাস্তবতা যাচাই করতেন। বাংলাদেশ যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত অর্থনীতির ভারে প্রায় স্থবির, তখন তিনি এক নতুন উন্নয়ন ধারা নিয়ে হাজির হন—যার কেন্দ্রে ছিল মানুষ, বিশেষত গ্রামীণ জনগণ। তিনি গ্রামের মানুষজনকে এত ভালোবাসতে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিগুলোর বেশিরভাগই গ্রামীণ কেন্দ্রিক করার জন্য কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ দিতেন, সুযোগ পেলেই গ্রামের মানুষের কাছে ছুটে যেতেন, সবার সাথে মিশে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাতেন।
শহীদ জিয়ার শাসনামলে ‘শ্রমই শক্তি’ স্লোগানটি শুধু প্রচারণা কর্মসূচি ছিল না বরং তা ছিল এক অন্তর্গত রাষ্ট্রদর্শনের বহিঃপ্রকাশ। তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের মূল মন্ত্র ছিল, শ্রম ও উৎপাদন ছাড়া জাতি আত্মমর্যাদাশীল হতে পারে না। তাঁর কাছে উন্নয়ন মানে বিলাসিতা নয় বরং নিজের ঘাম দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নির্মাণ। তাঁর এই দর্শনে পাওয়া যায় পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্রের জন্য এক বাস্তববাদী পন্থা যেখানে বিদেশি সাহায্য নয়, স্থানীয় সম্পদ ও শ্রমশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
জিয়াউর রহমান বলতেন, “কাজকে মর্যাদা দিতে না পারলে কোনো জাতি মর্যাদাবান হতে পারে না।” আর এটাকে বাস্তবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি নিজেই কাজে নেমে পড়তেন। খালকাটা কর্মসূচিই ছিল তার উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ।
জিয়াউর রহমান তাঁর নেতৃত্বের সময় গ্রামীণ বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে একধরনের ‘বটম-আপ’ উন্নয়ন মডেল দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। শহর-কেন্দ্রিক উন্নয়নের পরিবর্তে তিনি বলেছিলেন, “উন্নয়ন যদি গ্রামে না পৌঁছায়, তবে তা আসলেই পৌঁছায় না।”
সে কারণে তাঁর শাসনামলে যেসব প্রকল্প বা কর্মসূচি চালু হয়, তার একটি বড় অংশ ছিল গ্রামভিত্তিক: যেমন- কৃষি পুনর্জাগরণ প্রকল্প, পল্লী বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ, গ্রামীণ অবকাঠামো—বাজার, স্কুল, রাস্তাঘাট নির্মাণ। এসব প্রকল্পে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছিল, যেন উন্নয়ন শুধু উপরের দয়া না হয়ে নিচের আত্মবিশ্বাসে গঠিত হয়।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক ইতিহাসে ‘উপজেলা’ ব্যবস্থা চালুর কৃতিত্বও জিয়াউর রহমানের। তিনি বুঝেছিলেন-কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করে নয়, বরং স্থানিক নেতৃত্বের ক্ষমতায়ন ঘটিয়েই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। এই কারণে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের যৌথভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরি হয় এটি ছিল প্রকারান্তরে জনগণের হাতেই উন্নয়নের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়া।
বাংলাদেশের কৃষি খাতে জিয়াউর রহমান এক বিপ্লব ঘটান। তিনি মনে করতেন—দেশের খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের জন্য কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাঁর আমলে শুরু হয়: আধুনিক সেচব্যবস্থা, উন্নত মানের বীজ বিতরণ, কৃষি যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা, কৃষকদের জন্য স্বল্পসুদে ঋণ, কৃষি উপকরণের মূল্যে ভর্তুকি দেওয়। ফলে বাংলাদেশ ১৯৮০ সালের মধ্যেই খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে, যা একসময় দুর্ভিক্ষপ্রবণ দেশের জন্য দুর্নামের ভাগিদার ছিল।
শহীদ জিয়ার উন্নয়ন দর্শনে যুবসমাজই ছিল ‘মূল চালিকাশক্তি’। তিনি চেয়েছিলেন, দেশের তরুণেরা যেন চাকরির পেছনে না ছোটে, বরং নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে উঠুক। তাঁর সময়ে চালু হয়: যুব উন্নয়ন অধিদফতর, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান কেন্দ্র, ক্ষুদ্রঋণ ও উদ্যোগ সহযোগিতা প্রোগ্রাম, তাঁর এই কর্মসূচিগুলোর লক্ষ্য ছিল আত্মনির্ভর একটি প্রজন্ম তৈরি করা, যারা রাষ্ট্রের ওপর নয়, বরং নিজেদের শ্রম ও দক্ষতায় গর্ববোধ করবে।
গ্রামের নারীদের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়নে শহীদ জিয়া বেশকিছু সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “নারীর উন্নয়ন ছাড়া কোনো উন্নয়নই পূর্ণতা পায় না।”
উন্নয়নের সবচেয়ে বড় রূপ হল মানুষের মানসিক জাগরণ। শহীদ জিয়া শিক্ষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে এক ‘চেতনার বিপ্লব’ ঘটাতে চেয়েছিলেন।
তাঁর সময়ে: প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব আসে, কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা স¤প্রসারণ পায়, মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষার মধ্যে সেতুবন্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জিয়ার চাওয়া ছিল, শিক্ষা যেন শুধু সার্টিফিকেটের মাধ্যম না হয়ে উৎপাদন ও মূল্যবোধের ধারক হয়।
অনেক রাষ্ট্রনায়ক উন্নয়নকে পরিসংখ্যান বা বড় প্রকল্প দিয়ে চিহ্নিত করেন। কিন্তু শহীদ জিয়া বলেছিলেন: “উন্নয়ন মানে শুধু বড় দালান নয়, উন্নয়ন মানে গ্রামের ছেলেটি যেন স্কুলে যেতে পারে, কৃষকের জমিতে যেন পানি আসে এবং মা যেন ক্লিনিকে চিকিৎসা পায়।”
এই মানুষ-কেন্দ্রিক চিন্তাই ছিল তাঁর উন্নয়ন দর্শনের হৃদস্পন্দন।
বর্তমান বাংলাদেশ উন্নয়নের নানা রূপকল্পে এগোচ্ছে-স্মার্ট বাংলাদেশ, টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, প্রযুক্তিনির্ভরতা। কিন্তু এসব ধারণার মূল স্তম্ভটি ঠিক কখন গঠিত হয়েছিল? উত্তর আসেÑশহীদ জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই। তাঁর দর্শনে ছিল আত্মমর্যাদা, শ্রম, স্থানিকতা, ধর্মনিরপেক্ষ মানবিকতা এবং গণমুখিতা। তিনি শুধু রাষ্ট্রের উন্নয়ন চাননি, তিনি চেয়েছিলেন “মানুষের উন্নয়ন”। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা যখন উন্নয়নের কাঠামোগত, প্রযুক্তিগত ও বৈশ্বিক রূপকল্পে বিভোর তখন শহীদ জিয়ার উন্নয়ন দর্শন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সবচেয়ে বড় উন্নয়ন হয় মানুষের চেতনায়, হৃদয়ে, সম্ভাবনায়।
লেখক : রোটারিয়ান, সাবেক ছাত্র-যুবনেতা