খাইমা রুফাইদা মুসলমানদের প্রথম হাসপাতাল

1

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন

চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রাচীনতম বিজ্ঞানের অন্যতম। কালের আবর্তনে অন্যান্য বিজ্ঞানের ন্যায় এর ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। পুরানো চিকিৎসা ব্যবস্থা বর্তমানের মত তত উন্নত না হলেও চিকিৎসা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চা হতো, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, সৃষ্টিলগ্ন থেকে মানুষ নিজের প্রয়োজনে সবকিছু আবিস্কার করার চেষ্টা করেছে। মিসরের পিরামিড তাদের সাংস্কৃতিক কীর্তির নমুনা হলেও এটি তাঁদের উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও প্রমাণ বহন করে। হিপোক্রেটিস (আনু: খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০)কে বলা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হলেন ইবন সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রি.)।
ইবন সিনা এ ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন পবিত্র কুরআন-হাদিস ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন থেকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নীতি-নৈতিকতার চর্চা ও ইবাদতের জন্য শুধু মসজিদ নির্মাণ করেননি, মসজিদ সংলগ্ন হাসপাতালও নির্মাণ করেছেন। সেখানে সাধারণ চিকিৎসা, শল্য চিকিৎসা, যুদ্ধাহতের চিকিৎসা দেওয়া হতো। হাসপাতালটির নাম ‘খাইমা রুফাইদা আল-আসলামিয়া’। এর প্রধান ছিলেন একজন আনসারি মহিলা সাহাবি, যাঁর নাম রুফাইদা। হাওয়াজিন গোত্রের উপশাখা আসলাম গোত্রে তাঁর জন্ম। তাঁর গোত্রীয় নাম আসলামিয়া। তাই তিনি রুফাইদা আসলামিয়া হিসেবে পরিচিত। হিজরতের পর আল্লাহর নবি (সা.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাদও ছিলেন একজন চিকিৎসক। স্বীয় পিতা থেকে চিকিৎসাবিদ্যা, নার্সিং, সার্জারি ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেছেন মর্মে তথ্য পাওয়া যায়।
মসজিদে নববির সাথে লাগোয়া বা মসজিদের একটি অংশে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটি ইতিহাসে খাইমা রুফাইদা আল-আসলামিয়া নামে পরিচিত। অর্থাৎ রুফাইদা মেডিকেল ক্যাম্প। এ বিষয়ে সাধারণ মুসলমানদের জানা না থাকলেও হাদিস ও ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ সমূহে এটি সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ইমাম বুখারি (রহ.) সহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাদিসবিশারদ ও সিরাতকার হযরত রুফাইদা (র.) ও তাঁর চিকিৎসা বিষয়ক অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। বনু কুরাইজার সরদার হযরত সাদ বিন মুয়াজ (র.) খন্দকের যুদ্ধে গুরুতর আহত হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ভ্রাম্যমান চিকিৎসা ক্যাম্প থেকে রুফাইদার হাসপাতালে রেফার করেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা তাকে রুফাইদার ক্যাম্পে নিয়ে যাও’। এর দ্বারা উক্ত হাসপাতাল এবং এর প্রধানের চিকিৎসার মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। হযরত রুফাইদা (র.) মদিনবাসীকে উক্ত ক্যাম্প থেকে চিকিৎসা দিতেন, যুদ্ধাহতদেরকে নার্সিং করতেন এবং প্রয়োজনে সার্জারি করতেন। পাশাপাশি তিনি মুসলিম মহিলাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতেন। তাঁর হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে মা আয়েশা, উম্মে আতিয়া, রুবাই বিনতে মুয়াউয়িজ, উম্মে সুলাইম, আসমা বিনত উমাইস, শিফা বিনত আব্দুল্লাহ, নুসাইব বিনত কাব (র.) প্রমুখ মহিলা সাহাবি রয়েছেন। তাঁরা সাধারণ চিকিৎসার পাশাপাশি নার্সিং বিদ্যাতেও পারদর্শী হয়ে উঠেন। বিভিন্ন যুদ্ধে তাঁদের রসদ সরবরাহ, পানি বিতরণ, নার্সিং, লাশ টানা, চিকিৎসা প্রদান ইত্যাদির তথ্য পাওয়া যায়। তাঁদের প্রধান ছিলেন হযরত রুফাইদা আল-আসলামিয়া (র.)। ইসলামের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নার্সিং বিদ্যা অর্জন ও প্রয়োগ করেন। নার্সিং কাজে যুক্ত থাকার কারণে খাইবার যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমতের মাল থেকে তাঁকে হিস্যা প্রদান করা হয়। তাঁর সংস্পর্শে থেকে অনেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে পারদর্শী হয়েছেন। ফলে রাসুলুল্লাহ (সা.) যুগেই একটি নার্সিং টিম সৃষ্টি হয়েছিল। হযরত রুবাই বিনত মুয়াউয়িজ (র.) বলেন, আমরা আল্লাহর নবি (সা.)-এর সাথে যুদ্ধে যেতাম। যোদ্ধাদের নিকট পানি সরবরাহ করতাম। যুদ্ধাহতদেরকে চিকিৎসা দিতাম এবং শহিদদের লাশ মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম (বুখারি, হাদিস নং- ২৮৮২)। হযরত উম্মে আতিয়া বলেন, আমি আল্লাহর নবি (সা.)-এর সাথে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। আমি তাঁদের পেছনে থাকতাম। তাঁদের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করতাম। আহত এবং অসুস্থদের চিকিৎসা সেবা দিতাম (মুসলিম, হাদিস নং-১৮১২)। হযরত উম্মে সুলাইম বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাকে এবং কিছু আনসারি মহিলাকে যুদ্ধে নিয়ে যেতেন। তাঁরা পানি সরবরাহ করতেন এবং আহতদের চিকিৎসা দিতেন (প্রাগুক্ত, হাদিস নং-১৮১০)। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল (Florence Nightingale) ১৮৫০ সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অবদানের জন্য নার্সিং এর জনক হিসেবে অভিহিত হন। অথচ এর আরো প্রায় ১২০০ বছর পূর্বে রুফাইদা আল-আসলামিয়া নার্সিং এর কাজ করেছেন সফলভাবে। মুসলিম মহিলাদের একটি বড় দলকে তিনি চিকিৎসা ও নার্সিং এ প্রশিক্ষিত করেছেন এবং একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিশাল অবদান রেখেছেন। আল্লাহর নবি (সা.)- এর নির্মিত হাসপাতালের তিনি প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একাধারে সাধারণ, সার্জারি ও নার্সিং এর কাজ করতেন। হযরত সাদ বিন মুয়াজ (র.) চোখে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁর খাইমা বা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় মুসলিম মনীষীগণ চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চা করেছেন। উমাইফা খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক (৭০৫-৭১৫ খ্রি.) পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন। কালের আবর্তনে রুফাইদা বা খলিফা ওয়ালিদের অবদান বিস্মৃত হয়ে গেছে।
পশ্চিমাদের অবমূল্যায়নে আল-রাযি, আল-জাহরাউয়ি, ইবন সিনা, ইবন রুশদ, ইবন নাফিসরা হারিয়ে যাচ্ছেন। স্বজাতির লোকেরাও তাঁদের যথাযথ মূল্যায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। নার্সিং জগতের পুরুধা রুফাইদাকে মুসলিমরাও চেনেন না। আল্লাহর নবি (সা.)-এর মসজিদের ভেতরে একটি হাসাপাতাল ছিল- সেটিও অনেকের জানা নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সেই হাসপাতালের প্রধান ছিলেন একজন মহিলা। সেই আলোকে ইমাম বুখারি (রহ.) সহ হাদিস ও আইনবিশারদগণ ফতোয়া দিয়েছেন যে, মহিলা চিকিৎসকগণ পরপুরুষের চিকিৎসা, নার্সিং, লাশ বহন করতে পারবেন। তবে উত্তম হলো পুরুষ পুরুষের এবং নারী নারীর চিকিৎসা করা, যদি যথাযথ জ্ঞান রাখেন। আরো উল্লেখ্য, প্রয়োজনীয় মুহূর্তে মসজিদের অংশকে সাময়িকভাবে হাসপাতালে রূপান্তর করা জায়েয বলেও সমসাময়িক ইসলামি স্কলারগণ মনে করেন। কোভিড-১৯ এ আর্ন্তজাতিক মুসলিম উলামা ঐক্য পরিষদের সেক্রেটারি মুহিউদ্দিন র্কুরা দাগি এ ব্যাপারে ইতিবাচক ফতোয়া দিয়েছেন (মুনতাদা উলামা, ২০২০)। নার্সিং জগত মহিলারা পরিচালনা করে আসছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রাধান্য আল্লাহর নবি (সা.)-এর যুগ থেকে চলে আসছে। হযরত রুফাইদা র.)কে প্রধান্য দিয়েই তিনি নার্সিং জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাই চিকিৎসা জগতে মুসলমানদের অবদানকে অস্বীকার করার জো নেই। এক্ষেত্রে মহিলাদের অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। হযরত রুফাইদা (র.)-এর চিকিৎসা পদ্ধতি, চিকিৎসামান ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। সুখের বিষয় হলো, ইতোমধ্যে কিছু কিছু মুসলিম রাষ্ট্র ও সংস্থা হযরত রুফাইদার নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। তাঁর নামে এওয়ার্ড ও পদক দেওয়া হচ্ছে। ফিলিস্তিন, জর্ডান, মিসর, কুয়েত, সৌদি আরব, পাকিস্তানে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। জর্ডানের নার্সিং ও মিডওয়াইফারি বহুমুখী কলেজ, পাকিস্তানের আগাখান নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কলেজ হযরত রুফাইদার নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কুয়েতে ১৯৭৮ সাল থেকে রুফাইদা আল-আসলামিয়া এওয়ার্ড প্রদান করা হচ্ছে। সৌদি আরবে ১৯৯৫ সাল থেকে তাঁর নামে পদক দেওয়া হচ্ছে। কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসায় অবদানের জন্য তাঁর নামে এওয়ার্ড চালু করেছে। আয়ারল্যান্ড ও বাহরাইনের যৌথ উদ্যোগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবদানের জন্য রুফাইদা এওয়ার্ড দেওয়া হচ্ছে। রিয়াদে রুফাইদা মহিলা চিকিৎসা সেবা সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো তাঁর নামে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। তবে চট্টগ্রামের নূরীয়া বিষুদরবার শরীফ প্রতি বছর ১৪ জিলকদ ‘খাইমাতু রুফাইদা’ নামে ফ্রি চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। আগামীতে হযরত রুফাইদা (র.) সহ অবহেলিত মুসলিম মনীষীদের নিয়ে আরো লেখালেখি ও গবেষণা হবে এবং তাঁদের অবদানগুলো বিশ্ববাসীর নিকট তুলে ধরা হবে- এটাই সংশ্লিষ্টদের নিকট একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়