কড়া নাড়ছে পহেলা বৈশাখ

14

তুষার দেব

গেল বছর পবিত্র রমজানেই হাজির হয়েছিল বাংলা নববর্ষ। এবার সিয়াম সাধনার মাস রমজান শেষে ঈদুল ফিতরের টানা ছুটির মধ্যেই উদযাপিত হতে যাচ্ছে বাংলা নববর্ষ বিদায় ও বরণ উৎসব। সেই হিসেবে দুয়ারে কড়া নাড়ছে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। তাই লম্বা ছুটিতে প্রাণের উৎসবে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির উচ্ছাস ও শুভ বার্তা ছড়িয়ে পড়বে বলে মনে করছেন অনেকে।
জীর্ণ-পুরাতন, অশুভ ও অসুন্দরকে পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে বাঙালি জাতি বাংলা নববর্ষকে বরণ করে পহেলা বৈশাখে। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’- বৈশাখকে এভাবে ধরাতলে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বছরের আবর্জনা ধুয়ে, দুঃখ-হতাশা-গ্লানিময় অতীতকে মুছে নতুনের আবাহনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে আসছে ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। আগামী ১৪ এপ্রিল নগরীতে বর্ষবরণকে ঘিরে নানা আয়োজন রয়েছে। একটি নতুন ভোরের সূচনার সঙ্গে যাত্রা শুরু হয়েছে নতুন বছরের। বারো মাসে তেরো পার্বণ উদযাপন করা এই বাংলায় বৈশাখ আসে উৎসবের রং ছড়িয়ে। পহেলা বৈশাখে জাতি-ধর্ম-বয়স, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব মানুষ মেতে ওঠে বর্ষবরণের সার্বজনীন লোক উৎসবে। মহাআড়ম্বরে নগরীসহ দেশজুড়ে মানুষ বর্ষবরণের উৎসবে মাতোয়ারা হচ্ছে মন-প্রাণ খুলে।
সংস্কৃতিসেবী ও বিদগ্ধজনদের মতে, বাঙালির নববর্ষ এক ব্যতিক্রমী ও অনন্য বৈশিষ্ট্যময় উৎসব। পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনও না কোনও ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় কোনও অনুষঙ্গ ও সংযোগ নেই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরেই এর উৎপত্তি ও প্রচলন। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বছরজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। দিনে দিনে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসবে। ধর্ম ও সম্প্রদায়গত পরিচয় নির্বিশেষে বাংলা ভূখন্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসবে পরিণত পয়লা বৈশাখে নববর্ষকে বরণ করা। এমন অসাম্প্রদায়িক উৎসব সত্যিই পৃথিবীতে বিরল।
পয়লা বৈশাখের উৎসব শুরুর দিকে ছিল মূলত গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক। গ্রামীণ মেলা, লোকজ নানা ধরনের খেলাধুলা ও নৃত্য-গীত ছিল উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। দিনে দিনে এই উৎসব শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে এবং বর্তমানে পয়লা বৈশাখের উৎসবের আড়ম্বর শহরগুলোকে ঘিরেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে সূচিত বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রার মত চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বনেদি ব্যবসায়ীরা খুলে বসেন হালখাতা। তরুণ-তরুণীরা বৈশাখী উৎসবের রঙিন পোশাক পরে বেরিয়ে আসে, ঐতিহ্যবাহী পাঁচনসহ দেশি খাবারের জমজমাট আয়োজন চোখে পড়ে। সর্বত্র দেখা যায় নতুন প্রাণের কল্লোলিত উচ্ছ্বাস। হালসময়ে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে দেশি পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যরুচির মর্যাদা বেড়েছে ও ধরন বদলেছে। এসব পণ্য বিপণনে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা। সর্বস্তরের মানুষের মিলন ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ তৈরি হয় পয়লা বৈশাখের এই অসাম্প্রদায়িক উৎসবেই। অবশ্য বিগত সময়ে পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে উগ্রবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর বোমা হামলায় মানুষের প্রাণ হারানোর বেদনাবিধূর ঘটনার স্মৃতিও ভোলা যায়নি। এরপরও নববর্ষ মানেই নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন সংকল্প।
নগরীর ডিসি হিলে সম্মিলিত পয়লা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের আয়োজনে নববর্ষকে বরণের নানা অনুষ্ঠান। এছাড়া সিআরবি’র শিরীষতলায় নববর্ষ উদযাপন পরিষদ এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে বর্ষবরণের নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন থাকছে। উৎসবের নিরাপত্তায় পুলিশের তরফ থেকে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনের পাশাপাশি বাড়তি নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
সম্মিলিত পয়লা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের আহব্বায়ক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজান শেষে ঈদের টানা ছুিিটতেই এবার আমাদের সামনে ধরা দিয়েছে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ। এ কারণে ঈদ আনন্দের সাথেই বর্ষবরণ উৎসব আয়োজনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। পহেলা বৈশাখের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পয়লা বৈশাখ বাঙালির, সবার যোগে জয়যুক্ত হোক’।

বৈশাখের স্বাদ পাঁচনে : বাঙালির ঐতিহ্যের বর্ষবিদায় ও বরণে অতিথি আপ্যায়নের অনিবার্য অনুষঙ্গ পাঁচনের নানা পদ এবং নাড়ু-মিঠাই তৈরি এবং কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছেন গৃহিণীরা। চৈত্র সংক্রান্তিতে অনেকের ঘরে রান্না হয়ে থাকে ঐতিহ্যের পাঁচন। নববর্ষে পহেলা বৈশাখে নাড়ু আর মিঠাইয়ের নানা পদ দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরনের চিরায়ত এই রীতির ব্যতিক্রম হচ্ছে না এবারও। তবে পান্তা-ইলিশের আওয়াজ অনেকটাই কম শোনা যাচ্ছে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় এখন থেকেই পাঁচনের নানা পদ কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে। কাঁচা কাঠাল থেকে শুরু করে সজনে ডাঁটাসহ পাহাড়ি নানা পদের সবজির পসরা নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। পাশাপাশি নববর্ষ আবাহনের বিহু ফুল আর নিমপাতার ডালেরও দেখা মিলছে বাজারে। বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের নাড়ু, মিষ্টি-মিঠাই কেনাকাটার ধুম পড়েছে দোকানগুলোতে। মুড়ি-মুড়কি, খইয়ের মোয়া, আটকড়ই, নারিকেল-গুড়, বাতাসাসহ হরেক পদের মিঠাইয়ের পসরা দেখা গেল দোকানে দোকানে। কেনাকাটা করতে আসা গৃহিনীরা জানান, নতুন বছরে বিহু ফুলের মালা ও নিম ডাটা লাগানো হবে ঘরের দরজায়। পুরাতন জরা-জীর্ণতাকে পেছনে ফেলে শুভ ও সুন্দরের আবাহনে সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের প্রত্যাশায় এই মালা ও পাতাসহ নিমডাটা লাগানো হয় ঘরদোরসহ বিভিন্ন স্থানে।
রহমতগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা বৈশাখী চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, বৈশাখের এই পাঁচন বছরে একবারই রান্না করা হয় বাঙালির ঘরে। নানা জাতের সবজি এবং মসলায় রান্না করা এই পাঁচনের আবার নানা ঔষধি গুণও রয়েছে। বছরের শুরুতে এই পাঁচন খেলে সারাবছর রোগ-বালাই থেকে দূরে থাকা যায়-এমন বিশ্বাস থেকেই বংশ পরম্পরায় পাঁচন রান্না ও খেয়ে আসছি আমরা। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়নেও পাঁচনের অনিবার্য উপস্থিতি থাকে।
বক্সিরহাটের মন্ডা-মিঠাইয়ের দোকানি পুতুল কান্তি দাশ জানান, নববর্ষকে সামনে রেখে এবার মুড়ি-মুড়কি ছাড়াও, খইয়ের মোয়া, মুড়ি ও খইয়ের নাড়ু, চিড়া, আটকড়ই, নারিকেল-গুড়, বরই ও মিষ্টি আল-গুড়ের নাড়ুসহ অন্তত ২০ ধরনের মিঠাই আইটেম দোকানে তুলেছেন ক্রেতাদের জন্য। বিক্রি-বাট্টাও বেশ জমজমাট হয়েছে। বৈশাখের পরও তারা দোকানে এ ধরনের মুখরোচক খাবার রাখেন। তবে তখন পহেলা বৈশাখের মত সব আইটেম পাওয়া যায় না।
চৈত্রের দাবদাহ কিছুদিন অব্যাহত থাকার খবরে নববর্ষের খাবার-দাবারে পানীয় বা শরবতের আইটেম বেশি রাখার পরামর্শ দিয়েছেন শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ভাগ্যধন বড়ুয়া। পূর্বদেশকে তিনি বলেন, বাঙালির রসনা-বিলাস অনেক পুরনো হলেও প্রকৃতির আচরণের দিকটা ভুলে বসলে চলবে না। বিশেষ করে, শিশু-কিশোরদের খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় ভাজা-পোড়া বাদ দিয়ে শরীর ঠান্ডা রাখে এমন আইটেমের খাবার তৈরি করা। আর অপরিহার্যভাবে রাখা উচিত বিভিন্ন ফলের শরবত। গরমে অতিরিক্ত মিষ্টি খাবারও বর্ষবরণের আনন্দের লাগাম টানতে পারে। তাই বিদ্যমান পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে খাবার গ্রহণ করাই সবচেয়ে নিরাপদ।